শামসুদ্দোহা তালুকদার
আলহাজ্ব খন্দকার গোলাম মাওলা। যিনি চাকরি জীবনে জি মাওলা নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি কথায় কথায় গল্প বলে আমাদেরকে নসিহত করতেন। তিনি নিজেকে অতি নগণ্য মনে করতেন। তাঁর সামনে যারা বসতেন- তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে হলে প্রথমেই নিজের অপারগতা প্রকাশ করে বিনয়ের সর্বোচ্চ নমুনা দেখাতেন। যেখানে শাসনের দরকার সেখানে একটি শিক্ষনীয় গল্প করে বোঝাতেন, কোনটা সঠিক আর বেঠিক।
তাঁর জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় মুগ্ধ হতাম সবাই। কথায় কথায় প্রবাদ ও ছোট গল্প বলতে পারতেন। প্রতিটি কথা ছিল ওজনদার।
বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা বোর্ডের অভিভাবক হিসেবে তিনি যথেষ্ট ভূমিকা রাখতেন। পীর সাহেব হুজুর তাঁকে মুজাহিদ কমিটির দায়িত্ব দিয়ে নির্ভার ছিলেন। যেকোনো জরুরি আলাপ তাঁর সঙ্গে প্রথমেই করে নিতেন।
আস্তে আস্তে কথা বললেও প্রতিটি কথা যে কারো হৃদয়ে গেঁথে থাকতো। বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা বোর্ডের প্রয়োজনে তিনি ছুটে আসতেন চরমোনাই। দিনভর আলোচনা করতেন। খাবার বৈঠকেও কুরআন শিক্ষা বোর্ডের উন্নতি ও শৃঙ্খলার বিষয়ে কথা বলতেন। উপস্থিত সবাই মুগ্ধ ভরে শুনতাম তাঁর কথা।
তিনি আমাকে এতো স্নেহ করতেন- যা এখন অনুভব করি-কারণ, তাঁর মতো কেউ স্নেহ ও শাসনমাখা আদর করার আর কেউ নাই বলে।
চরমোনাই এলে মাহফিল ছাড়া অধিকাংশ সময় তিনি কুরআন শিক্ষা বোর্ডের ভিআইপি মেহমান খানায় থাকতেন। এজন্য তাঁর সান্নিধ্য উপভোগ করতাম।
তাঁর জীবনের শেষ সফর ছিল বরিশাল ও চরমোনাইতে। গত ৯ তারিখ জুমার পর রাত এশা পর্যন্ত বৈঠক করেছেন নির্বাহী চেয়ারম্যানসহ আমাদের সঙ্গে। নানা বিষয়ে ডিকটেশন দিয়েছেন। খসড়া আমার দ্বারা লেখিয়েছেন। ঢাকায় ফিরে ফোন, দোহা সাহেব খসড়াটা আপনার ভাষায় লিখে ই-মেইল করেন, আমি দেখি। আর আপনি ঢাকা আসেন, তখন চূড়ান্ত করবোয়ানে।
আমি ঢাকায় আসছি ঠিকই, তিনি চলে গেলেন বৈঠক না করেই।
বরিশাল থেকে ফেরার দুদিন পর তাঁর অসুস্থতার সংবাদ পাই।
বারডেম হাসপাতালে গিয়ে এনজিওগ্রাম করেছেন, হার্টে একটি ব্লক ধরা পড়েছে। ডাক্তারের পরামর্শ, শরীর খুব দুর্বল হেতু বাসায় কিছুদিন রেস্ট নিতে হবে। শরীর স্থিতিশীল হোক তারপর মাসের শেষের দিকে ভর্তি হোন। তখন রিং বসানো হবে।
বাসায় ফুল রেস্টে আছেন তাই ফোন করে বিরক্ত করিনি। হাসপাতাল থাকাকালীন তাঁর ছেলের কাছে মোবাইল আছে জেনেছি, তাই পীর সাহেব হুজুরের নির্দেশে খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য ফোন দিয়েছিলাম কিন্তু পিক আপ করেননি।
গত ৯ তারিখ ভোরে রওয়ানা দিয়ে চরমোনাই পৌঁছেছেন। আগের দিন ৮ তারিখ মাতুয়াইল মাদরাসার সম্পত্তি বিষয়ে দাতার ওয়ারিশদের সাথে মহাসচিব ও যুগ্ম-মহাসচিবসহ মিটিং করি।
এর আগের দিনের কথা ইতিহাস হয়ে থাকবে তার দায়িত্বকালীন ক্রয়কৃত ভবন অর্থাৎ মারকায ভবনে কুরআন শিক্ষা বোর্ডের কার্যকরী সদর দফতর উদ্বোধন করা হয়। যেখানে পীর সাহেব হুজুর শায়খে চরমোনাই হুজুর, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর মহাসচিব হুজুর ও তিনিসহ শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ হাজির ছিলেন। সেদিন তিনি নসিহতমূলক বক্তব্য দিয়েছেন।
তাঁর নামের চেয়ে পদটা ছিল ওজনদার। সেক্রেটারি জেনারেল, বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি। তাঁর জীবনের শেষ সফর চরমোনাই তথা বরিশালে। বরিশাল মহানগর মুজাহিদ কমিটির নতুন কমিটি গঠন করাই ছিল শেষ দাপ্তরিক কাজ।
কুরআন শিক্ষা বোর্ডের কার্যক্রম দেখাশোনা ও দিকনির্দেশনা দিতে তিনি কখনো বিরক্ত হননি। অথচ এ দায়িত্ব ছিল অতিরিক্ত।
গত কয়েক বৎসরে তিনি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। সদকায়ে জারিয়া হিসেবে গ্রামের বাড়ি বাকেরগঞ্জের কলসকাঠীতে নিজের অর্থায়নে একটি মাদরাসা ভবন তৈরি করে পাঠদানের ব্যবস্থা করেছেন। এর সমুদয় খরচ তিনি নিজে বহন করতেন। মৃত্যুর পর কাজে দিবে- হাসতে হাসতে এ কথা বলতেন।
তিনি অসম্ভব বিনয়ী, জ্ঞানী ও নিরহংকার ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। সমগ্র বাংলাদেশেমুজাহিদ কমিটির কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে বৃদ্ধ বয়সে সারা দেশে সফর করতে ক্লান্তি বোধ করতেন না। মুজাহিদ কমিটির জন্য চব্বিশ ঘণ্টা মন, মগজ ও শরীর সমর্পণ করেছিলেন। এর বিনিময়ে একটি পয়সাও গ্রহণ করতেন না। এটা একজন খাঁটি মুজাহিদের পরিচয়।
আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে তাঁর নির্ধারিত সময়ে এভাবে তুলে নেন। যা আমরা ঘূর্ণাক্ষরেও আঁচ করতে পারি না। বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে তাঁর অবদান বিস্মৃত হবে না কখনো।
তিনি বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির পাশাপাশি বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা বোর্ডকেও ঋণী করে চলে গেলেন কাউকে কিছু না বলেই।
তাঁর ভাগ্যের তুলনা হয় না। তাঁর শেষ বিদায়ের দিনে তাঁর শায়খ দু'জনই ঢাকায় হাজির। বায়তুল মোকাররমে তাঁর জানাজা পীর সাহেব হুজুর পড়াবেন। এটা একটা সৌভাগ্যের বিষয়। তাঁকে দাফন দেওয়া হবে গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জের কলসকাঠী পারিবারিক গোরস্থানে।
আল্লাহ তায়ালা এমন একজন কর্মবীর মুজাহিদকে অতিথি হিসেবে বরণ করবেন, যা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস এবং তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউসের বাসিন্দা হিসেবে কবুল করবেন। আল্লাহুম্মা আমিন।
লেখক: বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা বোর্ড কর্মকর্তা
এনএইচ/