।।তাওহীদ আদনান ইয়াকুব।।
দরস ও তাদরিসে যুক্ত হওয়ার পর থেকে আউট বই কম পড়ি। দরসি কিতাবের মাঝেই কাটে সিংহভাগ সময়। তবে সিরাতের বইয়ের বিষয়টি এর ব্যতিক্রম। এই বই যতই পড়ি ততই পড়তে মনে চায়, ততই তৃষ্ণা বাড়ে।
সবশেষ অধিক বিমোহিত হয়েছিলাম আবদুল আযিয আমানের সিরাত সিরিজি হাতে পেয়ে। সিরিজটি দেখার পর কেনার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। সিরিজটি আমাকে আকর্ষিত করেছিল ভাষাতীত। ফলে সিরিজটি চট করেই কিনে ফেলেছিলাম সিরাত থেকে মধু আহরণে।
অনুরূপ কিছুদিন পূর্বে শুনেছিলাম সিরাতগবেষক কবি আতাউর রহমান আলহাদীর ছড়ায় ছড়ায় লিখিত দিবাকর নামক সিরাত সিরিজিগুলো এক মলাটে বের হচ্ছে 'মরুর ফুল' নামে। তখন থেকেই মুখিয়ে ছিলাম বইটি হাতে পাওয়ার জন্য। এরপর দেখতে দেখতেই বইটি হাতেও পেয়ে যাই এবং শুরু করি ছড়ায় ছড়ায় সিরাতের সুবাস গ্রহণ।
বইটি পেয়েই সিরাতের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, লেখকের লেখার; কবির কবিতার যাদুময় প্রভাব আমাকে কাবু করে রেখেছিল বইটির পাঠে। হাল যামানার এক অনবদ্য সংকলন এই মরুর ফুল। ছড়ায় ছড়ায় অঙ্কিত নবী জীবনের চিত্রগুলো দারুণভাবে ফুটে উঠেছে এই গ্রন্থ মাঝে; বরং তা ফুটিয়ে তুলেছেন কবি আতাউর রহমান আলহাদী।
বইটি সম্পর্কে মূল্যায়ন করার মতো যোগ্যতা আমার নেই। কথায় বলে, যার কাজ তারই সাজে, আনাড়ারি লাঠি বাজে। তো এই বই সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গেলে আমার কেবল লাঠিই বাজবে আর কিছুই হবে না ভুলেও।
তবুও লিখতে যেহেতু বসেছি কিছু কথা লিখি। বইটি পাঠ করে যা বুঝলাম, এই বইয়ের সঠিক মান ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব আমার লেখায়। কারণ, এই বইয়ের পরতে পরতে ছড়ানো আছে হীরা জহরত আর মণি-মুক্তা। তো যেই চোখ কোনোদিন দেখেনি এই হীরা জহরত, সেই চোখ কিভাবে মূল্যায়ন করবে তার?
বইটির ঝকঝকে প্রচ্ছদ ও ছাপায়, উন্নত বাইন্ডিং ও সুন্দর অঙ্গসজ্জায় আমি বইটি পড়তে আরো বেশি উদ্যোমী হই। এরপর আমি ভাবছিলাম, এর নাম মরুর ফুল কেনো? মরুর ফুল বলতে মরুভূমির বিশেষ কোনো ফুলকে বুঝানো হয় কিনা, একটু দেখি।
মরুর ফুল লিখে গুগলে সার্চ দিলাম। কোনো ফুল এলো না। এলো কেবল এই একটি বইয়ের অসংখ্যা লিঙ্ক। আমার তো চোখ ছানাবড়া। এ কী? মরুর ফুল লিখে সার্চ করলে সমস্ত লিঙ্ক এই বইয়ের কেনো? দুই একটা ফুল টুল তো আসবে! কিন্তু আসছে না কেনো?
পরক্ষণেই বসে বসে ভাবলাম, এই বইয়ের সার্থকতা এখানেই। হয়তো মরুর ফুল লিখে এই বই ছাড়া অন্য কিছু সার্চ করে বের করা সম্ভব হবে না আর। কারণ এই বই তার যথাযথ স্থান দখল করে নিতে পেরেছে যথাযথভাবেই।
বইটি পাঠ করে আমি এতটাই মুগ্ধ যে, এখন মনে হচ্ছে, 'মরুর ফুল কী?' এই কথা কাউকে জিজ্ঞেস করা হলে, এর উত্তর হওয়া দরকার একটাই যে, এটি কবি আতাউর রহমান আলহাদীর ছড়ায় ছড়ায় লিখিত একটি সিরাতগ্রন্থ।
লেখক আতাউর রহমান আলহাদী একজন সিরাত গবেষক। তিনি একজন কবি। তিনি পুরো বইটিতে নবীজির জীবনী ফুটিয়ে তুলেছেন ছড়ায় ছন্দে। তবে এর প্রতি সীমাহীন মুগ্ধতার মাঝে আমি একটু হতাশ হয়েছি যে, পুরো বইয়ে এতো কঠিন কঠিন বিষয়গুলোকে ছড়ায় ছন্দে মলাটবন্ধ করে বইয়ের অর্পণনামা কেনো ছড়াহীন ছেড়ে দিয়েছেন তিনি?
মনে মনে ভাবছিলাম, লেখকের কথা বা পূর্ব কথা নামে কিছু কথা থাকে শুরুতে, যা মুখবন্ধ শিরোনামেও উল্লেখ হয়। ব্যতিক্রমী আয়োজনের মাঝে আরেকটু ব্যতিক্রমী আয়োজন হতো যদি তিনি মুখবন্ধটাও ছড়া-কাব্যে উল্লেখ করতেন। কারণ, তিনি তো কবি, যিনি কবিতায় লিখতে পারে সবই।
আমি ছড়া ছন্দ ও কাব্য কবিতা লেখার নিয়ম কানুন ও কলা কৌশল ইত্যাদি নিয়ে টুকটাক অধ্যায়ন করেছিলাম এই কবি আতাউর রহমান আলহাদীর কাছেই। আগে ছন্দ ছড়া লিখতাম প্রচুর। নিয়ম কানুন শেখার সব ছেড়ে দিয়েছি। এত কঠিন কাজ কেউ করে?
আমি ভেবে অবাক হতাম, ছড়া ছন্দ ও কাব্য কবিতা লেখা এতো কঠিন তবে পাঠ করা এতো সহজ কেনো? উত্তর আমার জানা নেই। ছন্দ পড়তে বসলে ছন্দের তালে তালেই পড়া হয়ে যায় অনেক কিছু, বিষয়বস্তুর প্রতি আগ্রহ না থাকলেও।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সিরাত আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু তথাপি কারো যদি গদবাধা পাঠের ধৈর্য নাও থাকে, সেও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পাঠ করতে বাধ্য হবে এই সিরাতগ্রন্থটি। ছড়ায় ছড়ায় সিরাত গ্রন্থটি লেখার হয়তো এটাও একটি কারণ, যেনো কেউ না চাইলেও রাসূলের সিরাত পাঠ করে ফেলে অনায়াসেই। সিরাত পাঠ করানোর এক অভিনব বুদ্ধি এটি।
এই বই সম্পর্কে আর কত বলবো? বলতে গেলে সময় ফুরাবে, স্তুতি ফুরাবে না। তাই আর স্তুতি না গেয়ে এবার সংক্ষেপ করি। এক কথায় বলে যাই কিছু। আচ্ছা কী বলা যায় এক কথায়? এক কথায় বলার মতো কোনো শব্দ কি আছে এই বইয়ের জন্য উপযুক্ত?
না থাকলে নেই,
তবু বলতে আমায় হবেই,
ব্যতিক্রমী সিরাতগ্রন্থ মরুর ফুল,
পাঠহীন থাকাটা হবে চরম ভুল।
আল্লাহ পাক কবিকে কামিয়াব করুন, গ্রন্থটির সার্থকতা কবুল করুন এবং সিরাত চর্চার লক্ষ্যে এর ব্যাপক প্রসার ঘটান, আমীন।
লেখক: ফাযেলে দারুল উলুম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল উলামা লাখনৌ,
মুহাদ্দিস: আল-মাদরাসাতুল ক্বওমিয়্যাহ আল-ইসলামিয়্যাহ নশাসন,শরীয়তপুর।
এনএ/