উত্তরের জেলা লালমনিরহাটের ইমাম-মুয়াজ্জিনরা যৎসামান্য সম্মানির টাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সংসারের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে না পারায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। সরকারি মসজিদগুলোতে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য সরকারি বেতন-ভাতার ব্যবস্থা থাকলেও অবর্ণনীয় কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন ব্যক্তি পর্যায়ে নির্মিত মসজিদগুলোর ইমাম-মুয়াজ্জিনরা।
এ অবস্থায় দেশের সকল মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য সম্মানজনক সরকারি বেতন-ভাতা নির্ধারণ করার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
মুসলিম সমাজে ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আত্মমর্যাদা ও ধর্মপ্রেম থেকেই তাঁরা মসজিদ পরিচালনায় নিজেদের নিয়োজিত করেন। অথচ, লালমনিরহাট জেলায় মসজিদগুলোতে এই তিন গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য যোগ্য লোক নিয়োগে আগ্রহ থাকলেও তাঁদের ন্যায্য চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণে দেখা যায় চরম উদাসীনতা।
সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন মসজিদ ঘুরে দেখা যায়, সময়মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে ইমাম-মুয়াজ্জিন ও খাদেমদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই তাঁরা নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু এর বিনিময়ে যে সম্মানি দেওয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। বিশেষ করে গ্রামের অধিকাংশ মসজিদের দায়িত্ব পালনে যারা নিযুক্ত থাকেন তারা নামমাত্র সম্মানিতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এমন পরিস্থিতিতে সরকারিভাবে বেতন-ভাতার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
জানা যায়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শহরগুলোতে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমরা তুলনামূলকভাবে ভালো সম্মানি পেলেও তা অনেক সময় নিয়মিতভাবে পরিশোধ করা হয় না। অন্যদিকে, গ্রামীণ মসজিদগুলোতে তাঁদের সম্মানি অত্যন্ত সামান্য, যা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ি শিমুলতলা বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান (৫৮) জানান, তিনি গত ৩০ বছর ধরে এই মসজিদে মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ প্রতি মাসে সম্মানি হিসেবে পান মাত্র ৩,৫০০ টাকা। পাঁচ সদস্যের পরিবারের চাহিদা মেটাতে তিনি মসজিদের পাশাপাশি একটি ছোট চায়ের দোকান পরিচালনা করেন। তাই থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে।
একই মসজিদের ইমাম মাওলানা মোহাম্মদ লুৎফর রহমান (৪২) বলেন, ‘মাসিক ৫,০০০ টাকা সম্মানি পাই। বর্তমান বাজারে এই টাকায় সংসার চালানো কঠিন । সরকারিভাবে সম্মানি পেলে কিছুটা সুরাহা হতো।’
নয়ারহাট নিদাড়িয়া জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন মোহাম্মদ আনসার আলী (৫৬) জানান, তিনি সাপ্তাহিক মুষ্টির চাল ও মাসিক ১,৫০০ টাকা সম্মানিপান।একইসাথে তিনি পেশ ইমামের দায়িত্বও পালন করেন। তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘উপযুক্ত পারিশ্রমিক না পাওয়ায় সন্তানদের সঠিকভাবে পড়াশোনা করাতে পারিনি।’
সদরের সাদেকনগর জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন ও পেশ ইমাম মোহাম্মদ আখিয়ুল ইসলাম (৪৮) বলেন, ‘আমার পরিবারে ৬ সদস্য। যে বেতন পাই, তা দিয়ে জীবন চালানো দুঃসাধ্য। আমাদের কথা কেউ ভাবেন না।’
একই মসজিদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদার রহমান (৭৫) বলেন, ‘মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা কম, ফলে তেমন অনুদানও ওঠে না। মাসে যা তোলা যায়, তাই তাঁদের দিয়ে দেই। বিষয়টি আমাদের জন্যও কষ্টকর।’
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় অধিকাংশ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমরা অল্প সম্মানিতেই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। মসজিদ কমিটির সদস্যরাও তাঁদের অসহায়ত্বের কথা স্বীকার করেন। তাই তাঁরা সরকারিভাবে বেতন-ভাতা চালুর জোর দাবি জানান।সংশ্লিষ্টদের মতে, ইমাম-মুয়াজ্জিনদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানী নির্ধারণ করা হলে হাজারো পরিবারে স্বস্তি ফিরবে এবং তাঁরা আরও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন লালমনিরহাটের উপপরিচালক রেজাউল করিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘জেলায় প্রায় ৩,৩২৯টি মসজিদ রয়েছে এবং নতুনভাবে গণনার কাজ চলমান রয়েছে। বর্তমান বাজারে অল্প সম্মানিতে টিকে থাকা অনেক কঠিন। এ বিষয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে জানানো হয়েছে। তাঁদের আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে আমরা গুরুত্বের সাথে কাজ করছি।’
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, ‘জেলায় যে সব মডেল মসজিদ রয়েছে, সেগুলোতে সরকারিভাবেই বেতন-ভাতার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ব্যক্তিমালিকানাধীন মসজিদগুলোর যাবতীয় সিদ্ধান্ত মসজিদ কমিটি নিয়ে থাকে। তবুও যারা উল্লেখযোগ্য বেতন-ভাতা পান না, সেসব মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা যদি আর্থিক সহযোগিতার জন্য আবেদন করেন, তাহলে বিষয়টি আমরা বিশেষ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে থাকি।’সূত্র: বাসস
এমএম/