শনিবার, ১১ মে ২০২৪ ।। ২৮ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ৩ জিলকদ ১৪৪৫


ইসলাম ও সমাজতন্ত্র: একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা মাহমুদুল হাসান।। শ্রমিকের উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব- এর বাইরে সমাজতন্ত্র বৃহত্তর মানবাধিকার সম্পর্কে কোন কথা বলে না। যেমন একজন শ্রমিক কারখানায় কাজ করে যে মূল্য উৎপাদন করে তার একাংশে বেতন দিয়ে বাকিটা মালিক আত্মসাৎ করে। বেতনের অতিরিক্ত যে টাকাটা মালিক নিয়েছে এটাকেই বলা হয় উদ্বৃত্ত মূল্য।

শ্রমিকের উৎপাদিত মূল্যের সবটাই যাতে সে পায় মালিক তার রক্ত চুষে মুনাফা অর্জন করতে না পারে তার জন্য সমাজতন্ত্রের ফয়সালা হলো- উৎপাদন উপকরণ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিতে হবে। তখন সবাই নিজ নিজ সমর্থ্য অনুযায়ী শ্রম দিবে আর প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রহণ করবে। ব্যস এর বাইরে সর্বহারা অক্ষম দুর্বল সম্পর্কে সমাজতন্ত্র কোন কথা বলে না।

এখন প্রশ্ন হল বৃহৎ বুর্জোয়া গোষ্ঠী তো দূরের কথা সাধারণ পেটি বুর্জোয়া- যার একখণ্ড জমি আছে বা দোকান আছে বা ছোট একটা কারখানা আছে সে কি এসব সরকারি মালিকানায় ছেড়ে দিয়ে স্বেচ্ছায় শ্রমিকত্ব গ্রহণ করবে? এ কাজ কত দুরূহ তা আমরা সুভিয়েত ইউনিয়ন চীন ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশে দেখেছি।

এই সমাজতন্ত্রের নামে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে রক্ত গঙ্গা বইয়ে দেয়া হয়েছে, ২০০ কোটি মানুষ হত্যা করা হয়েছে। তাছাড়া কত দেশ জাতি উজাড় করে দেওয়া হয়েছে কত লাঞ্ছনা বঞ্চনা পঙ্গুত্ব অসহায়ত্ব ও দুর্ভিক্ষের কারণ হয়েছে তার হিসাব কেউ দিতে পারবে না। অথচ ইসলাম এ বিষয়ে কতই না উত্তম বিধান দিয়েছে।

ইসলাম প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি করে। ইসলামী রাষ্ট্র সর্বহারা ছিন্নমূলদের পুনর্বাসন করবে, সক্ষমদের কর্মসংস্থান করবে। এক্ষেত্রে শ্রমিকের বিধান হল শ্রমিক মালিকের সম্পর্ক ভাই ভাই, প্রভু- ভৃত্যের মতো তাদের মধ্যে মর্যাদাগত কোন পার্থক্য নাই। শ্রমিক মালিকের জীবনমান সমান হবে, তার মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হবে।

অন্যত্র এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তারপর অক্ষম শ্রেণী অর্থাৎ বিকলাঙ্গ প্রতিবন্ধী ইয়াতিম বিধবা বয়োবৃদ্ধ ইত্যাদিদের সরকারি ভাতায় প্রতিপালন করতে হবে। পৃথিবীর অন্য কোন ধর্ম বা মতবাদ এই শ্রেণীকে প্রতিপালন ফরজ করেনি এবং তাদের জন্য কোন হিস্যা নির্ধারণ করেনি।

কিন্তু ইসলাম এই অক্ষম শ্রেণীর প্রতিপালনের জন্য ধনীদের সম্পদে নির্দিষ্ট হিসসা ফরজ করে দিয়েছে।
যেমন যাকাত, কিন্তু যাকাতে দরিদ্রের প্রয়োজন না মিটলে ইনফাক বা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হবে। এ সম্পর্কে ফোকাহায়ে কেরাম বলেন-
১। ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন ‘যাকাত দ্বারা যদি অভাবগ্রস্থদের অভাব মোচন সম্ভব না হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় কোষ থেকে তাদের জন্য অন্যান্য কাজ বাদ দিয়ে হলেও অর্থ ব্যয় করতে হবে, (আস সিয়াসাতুশ শারইয়া)।

২। ইবনে আবেদিন বলেন ‘বিচারপতি যেমন অক্ষম দরিদ্র ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণের জন্যে তার ধনী অভিভাবক বা নিকটাত্মীয়কে বাধ্য করবে, তেমনি রাষ্ট্র প্রধানকেও বিচারের মাধ্যমে এজন্যে বাধ্য করবে। (আত তাশরীউল ইসলামী)।

৩। ফিকাহবিদদের সর্বসম্মত অভিমত ‘যাকাত ও বায়তুল মালের সাধারণ অর্থ সম্পদ যদি অসমর্থ হয়, তাহলে বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান ও অভুক্তকে অন্নদান প্রভৃতি জরুরী কাজ আনজাম দেয়ার দায়িত্ব পড়বে তাদের মধ্যে সচ্ছল ও সামর্থবান লোকদের উপর। এ দায়িত্ব তাদের জন্য ফরযে কেফায়া হিসাবে অতিরিক্তভাবে চাপবে। (আল মিনহাজ, ইমাম নবভী এবং তার শরাহঃ ৭ম খণ্ড, ১৯৪ পৃ)।

৪। ইবনে হাজম বলেন ‘যাকাত ফান্ড দরিদ্র জনগণের প্রয়োজন পূরণে অক্ষম হলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাদের পেটভরা খাবার ও শীত গ্রীষ্মের উপযোগী পোশাক দিতে হবে। বর্ষা, শীত ও রৌদ্রতাপ থেকে বাঁচার জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। পথচারীদের জন্যও এরূপ ব্যবস্থা করতে হবে। (আল মুহাল্লা, ইবনে হাজম, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ১৫৬ পৃ)।

ইনফাকেও দরিদ্রের প্রয়োজন না মিটলে সম্পদ জমা করা যাবে না, পারিবারিক ব্যয়ের অতিরিক্ত সম্পদ দরিদ্রদের মাঝে দান করে দিতে হবে। এটাকে ইসলামী সমাজতন্ত্র বলা হয়। যেমন এরশাদ হচ্ছে- ১। আয়াতঃ আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা (কানয) করে রাখে কিন্তু আল্লাহর পথে ব্যয় করে না- তাদের কঠোর আযাবের সংবাদ শুনিয়ে দিন। (৯:৩৪)

২। আয়াতঃ আর লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করে, তারা কী ব্যয় করবে? বলে দাও, আফবু অর্থাৎ নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পর যা বাঁচে তাই খরচ করবে। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্যে নির্দেশ সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা করতে পার। (বাক্বারাঃ ২১৯)
মুফাসসিরিনে কেরামের অভিমতঃ ক। হযরত আলী (রাঃ) বলেন, চার হাজার দিরহামের কম হলে সেটা পারিবারিক ব্যয়, আর বেশি হলে কানয হিসাবে গণ্য হবে তার যাকাত দেয়া হউক বা না হউক।

খ। ইমাম কুরতুবি বলেন, উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বিভিন্ন মতামতের মধ্যে উত্তম অভিমত হল আফবু অর্থ কোন ব্যক্তি তার নিজের ও পরিবারের পিছনে প্রয়োজনীয় ব্যয় সংকুলানের পর যা অতিরিক্ত থাকে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ সওয়াবের নিয়তে ব্যয় করতে হবে-এটা রাসূল (সাঃ) এর বিভিন্ন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন হযরত আবু হুরায়রা ও জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীস।

দরিদ্রের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই হল ইসলামের বিধান- যা অন্য কোন ধর্ম বা মতবাদে পাওয়া যায় না। এখন সমাজতন্ত্রের অনুসারীদের প্রতি নিবেদন আপনারা চিন্তা করে দেখুন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে সমাজতন্ত্র ভালো নাকি ইসলাম ভালো?

শুধু উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্বের জন্য ব্যক্তি মালিকানা খতম করার মতো চরম পন্থায় যাওয়া ভালো নাকি ইসলাম প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী ধনীদের সম্পদ থেকে যুক্তিসঙ্গতভাবে ক্রমান্বয়ে সম্পদ উসুল করে দরিদ্রের প্রয়োজন মেটানো ভালো? তাছাড়া ইসলাম আপনাদের নিজের সম্পদ আর সমাজতন্ত্র ভিনদেশ ও ভিনজাতির সম্পদ, নিজের ভালোটা ত্যাগ করে অন্যের মন্দটা গ্রহণ করার কি কোন যৌক্তিকতা আছে?

এখন আলেম সমাজের কাছে আবেদন হলো, হুকুমত ও মানবাধিকার বিষয়গুলি ইসলামী শিক্ষা ও মাদ্রাসা সিলেবাস থেকে বাদ পড়ে গেছে। এসব বিষয় পুনরায় সিলেবাসভুক্ত করে জনগণকে ইসলাম জানার সুযোগ করে দিতে হবে, সেই সাথে জনগণ ও সমাজতন্ত্রের অনুসারীদের এসব বিষয় বুঝিয়ে দরিদ্র ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করতে হবে।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ