মুফতি লুৎফুর রহমান ফরায়েজী।।
গুম নাটক আপনাকে সারা দেশে বেশ পরিচিত বানিয়েছে। জিও পলিটিক্স আর দাজ্জাল, কিয়ামত বিষয়ে বক্তব্য দিয়ে যুবকদের হৃদয় কেড়েছেন। ভালো। সালাফী মাদরাসায় কিছুদিন পড়াশোনাও করেছেন। তারপর আরবী ভাষাটাও শিখেছেন।
দাওয়াতী কাজ করছেন। ভালো কথা। আমরা আপনার বিরোধী নই। শত্রুও নই। দ্বীনী ভাই।
ইসলাহ না হয়ে মুসলিহ হওয়া উচিত নয়। যে বিষয়ে গভীর জ্ঞান নেই সে বিষয়ে মন্তব্য করাও উচিত নয়। আপনি আপনার এক বক্তব্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আত্মহত্যা বিষয়ে ভুল তথ্য পেশ করেছিলেন। তারপর আমাদের ওয়েব সাইট www.ahlehaqmedia.com এ প্রকাশিত আমার একটি লেখা পড়ে সেটি আপনার ওয়ালে কপিপেষ্ট করে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন।
এতে আমরা খুশি হয়েছি। শুধরানোর মানসিকতা আপনার আছে বলেই বিশ্বাস করি। এইতো আজ। আপনার একটি বক্তব্য দেখলাম। বাম হাতে কুরআন ধরে চরম ধৃষ্টতার সাথে আপনি মোটা দাগে কয়েকটি ভুল কথা বলেছেন। অন্য শব্দে বললে মারাত্মক বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন।
১. কুরআনের অর্থ না বুঝে মুখস্ত করার কোন ফায়দা নেই বলে উপহাস করেছেন।
২. সেক্সপিয়রের থিউরীক্যাল বই আর কুরআনকে সমমানের বানিয়ে দিলেন অর্থ না বুঝে পড়ার বিষয়ে।
৩. আরবী ভাষা জানলেই কুরআন বুঝে আসবে মর্মেও বিভ্রান্তি ছড়ায় আপনার বক্তব্য থেকে।
৪. ইংরেজ আমলে ইংরেজী শিক্ষা হারাম মর্মের তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী কালজয়ী মুজাহিদ আলেমদের বিষয়ে চরম ধৃষ্টতাসূচক মন্তব্যও আপনার জবান দিয়ে বেড়িয়েছে।
সংক্ষেপে বলি। নিজের সাধ্যের বাইরে পণ্ডিত সাজা উচিত নয়। পণ্ডিতি করাও উচিত নয়। অতীতের বড়দের ব্যাপারে মন্তব্য করার আগে তাদের ইতিহাস সম্পর্কে পড়াশোনা করাও উচিত।
১ম বিভ্রান্তির জবাব
কুরআন অর্থ না বুঝে পড়লেও অনেক ফায়দা আছে:
ক) প্রতিটি হরফে দশটি করে নেকী হয়। যা অন্য কোন কিতাব বা বইয়ের ক্ষেত্রে নেই।
বিশুদ্ধ হাদীসে আসছে:
عَبْدَ اللَّهِ بْنَ مَسْعُودٍ، يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم  " مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا لاَ أَقُولُ الم حَرْفٌ وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلاَمٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ "
আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা'আলার কিতাবের একটি হরফ যে ব্যক্তি পাঠ করবে তার জন্য-এর সাওয়াব আছে। আর সাওয়াব হয় তার দশ গুণ হিসেবে। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ, বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ। [সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২৯১০]
সুতরাং অর্থ না বুঝে কুরআন মুখস্ত করা ও পড়ার উপকারীতা অস্বীকার করা মানে হাদীস অস্বীকার করার নামান্তর।
খ) কুরআনে কারীম হিফজ করার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা কুরআন হিফাযতের যে দায়িত্ব নিয়েছেন সেটিকে সহযোগিতা করা।
যদি কোন কারণে (আল্লাহ না করুন) পুরো পৃথিবী থেকে কুরআনের সকল কপি ধ্বংসও করে দেয়া হয় তবুও কুরআন কোটি হাফেজের সীনায় সংরক্ষিত থাকায় তা অবিকৃত ও সংরক্ষিত হিসেবে বাকি থাকবে।
গ) গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামায বিশুদ্ধভাবে, সুন্নাত মুতাবিক যেমন তিওয়ালে মুফাসসাল, আওসাতে মুফাসসাল ও কিসারে মুফাসসাল কিরাত পড়ার জন্য এবং রমজানে তারাবীতে খতমে তারাবীহের সুন্নাত জিন্দা রাখতে কুরআন মুখস্ত করা জরুরী।
এছাড়া আরো বহুবিধ ফায়দা নিহিত কুরআন মুখস্ত করায়।
একথা ঠিক যে, কুরআন মুখস্ত করার সাথে সাথে সেটির অর্থ ও তাফসীর সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করাও জরুরী এবং উচিত।
এ কারণে আমাদের মাদরাসাগুলোতে হিফজের পড়েই কুরআন বুঝার জন্য একাডেমিক পদ্ধতির জামাত ব্যবস্থা চালু আছে। তাই কুরআন মুখস্ত বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো বোকামী অথবা গোমরাহী ছাড়া কিছু নয়।
২য় বিভ্রান্তির জবাব
সেক্সপিয়রের বই আর কুরআন কি সমান? মানুষের লেখা বই না বুঝে পড়ে লাভ নাই, আর আল্লাহর কালামও যদি না বুঝে পড়লে কোন ফায়দা না হয়, তাহলে দু’টির মাঝে পার্থক্য রইল কোথায়?
মানুষ ও রবের কালামে পার্থক্যই এখানে যে, মানুষের বই না বুঝে পড়া অর্থহীন। আর আল্লাহর কালাম না বুঝে পড়লেও সওয়াব হবে। আর বু্ঝে পড়লে যিন্দীগী পাল্টে যাবে। আখেরাত সুন্দর হবে। সুতরাং এ তুলানাটাই হাস্যকর ও বালখিল্যতা।
৩য় বিভ্রান্তির জবাব
আমাদের আবু ত্বহা ভাই কতটুকু কুরআন বুঝেছেন আরবী শিখে তা আমাদের কওমী মাদরাসাগুলোর কোন মানসম্মত শিক্ষকের সামনে এনে বসালেই পরিস্কার হয়ে যাবে।
যদি শুধু আরবী পড়লে আর বুঝলেই কুরআন বুঝা যেতো, তাহলে আরবে কোন ইউনিভার্সিটির দরকার হতো না। কারণ তাদেরতো আরবী ভাষা মাতৃভাষা। তাদের জন্য কেন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে কুরআন শিখতে হয়? এর মানে শুধু আরবী শিখার সাথে কুরআন বুঝার সম্পর্ক নয়।
হ্যাঁ, একথা ঠিক যে, আরবী ভাষাটাই কুরআন বুঝার মূল। কিন্তু এতটুকুতেই যথেষ্ঠ নয়। বরং আরবীর ব্যাকরণ তথা নাহু, সরফ, ফাসাহাত, বালাগাত, তারীখ, আরবীয় বাকরীতি, বাগধারা, এ সংক্রান্ত পূর্বাপর কবিদের ভাষাজ্ঞান, কবিতা, হাদীসের ব্যাখ্যা, পূর্ববর্তী মুফাসসিরদের মন্তব্য ইত্যাদি সবই নজরে রাখতে হবে। তারপরই কুরআন পরিপূর্ণভাবে বুঝে আসবে।
এছাড়া শুধুমাত্র ভাসা ভাসা আরবী জ্ঞানে কখনোই কুরআন পূর্ণভাবে বুঝা সম্ভব নয়।
৪র্থ বিভ্রান্তির জবাব
অতীতের কোন ঘটনা বা ব্যক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করার আগে তাদের ইতিহাস আগে পড়া উচিত। এতটুকু জ্ঞান আশা করি আবূ ত্বহা ভাইটার আছে।
যে আবু ত্বহা সাহেব কিয়ামত সম্পর্কে এতো লেকচার দেন, তিনি আশা করি কিয়ামত সম্পর্কিত এ হাদীসটাও পড়েছেন যে, কিয়ামতের একটি আলামত হল, কিয়ামতের আগে লোকেরা পূর্বসূরী কীর্তিমান মানুষদের লাগামহীন সমালোচনা করবে।
কিয়ামত সম্পর্কে মানুষকে সতর্ককারী আবূ ত্বহা সাহেব নিজেই কেন কিয়ামতের আলামত হয়ে যাচ্ছেন তা তার নিজের ভেবে দেখা দরকার।
ইংরেজরা যখন জগদ্দল পাথর হয়ে আমাদের এ উপমহাদেশে চেপে বসেছিল। তখন তারা আমাদের উপর তাদের শোষণ স্থায়ী করার জন্য সেনাবাহিনী এ দেশ থেকেই নেয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
তখন যেহেতু ইংরেজী ভাষা ছাড়া ইংরেজ বাহিনীতে ভর্তির সুযোগ ছিল না। তাই কিছু মানুষ লোভে পরে দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ইংরেজী শিখে ইংরেজ বাহিনীতে শরীক হচ্ছিল। তখন ইংরেজী ভাষা শিখার অর্থই এটা ছিল যে, হানাদার ব্রিটিশদের চামচামী করার সার্টিফিকেট পাওয়া।
তাই সেই সময়কার দেশপ্রেমিক উলামাগণ ইংরেজী শিক্ষাকে হারাম ফাতওয়া দিয়েছিলেন। যা ছিল সেই সময়ের জন্য দেশ ও জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুগান্তকারী এক ফাতওয়া।
যার ফলশ্রুতিতে দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তদানের বিনিময়ে আমরা আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বাদ পেয়েছি।
ইংরেজদের বিদায়ের পর সেই প্রয়োজনীয় ফাতওয়াটি সময়ের পরিবর্তনে তার আবেদন হারিয়েছে। তাই পরবর্তীতে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার কওমী মাদরাসাগুলোতে প্রয়োজনীয় ইংরেজী শিক্ষাকে আবশ্যকীয় সাবজেক্ট হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল কওমী মাদরাসায়ই এখন প্রয়োজনীয় ইংরেজী পড়ানো হয়। সুতরাং ব্রিটিশদের সময়ে কেন উলামাগণ ইংরেজী পড়া হারাম বলেছেন বলে তাদের দায়ী করা অজ্ঞতারই পরিচায়ক।
আবূ ত্বহা আদনান সাহেবের এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্যের দায়ভার কে নেবে? আমাদের এ প্রশ্নটা কি খুব অযৌক্তিক?
তার জন্য পরামর্শ:
১. বিজ্ঞ ও যোগ্য কোন আলেমের তত্বাবধানে আরো পড়াশোনা করুন।
২. স্পর্শকাতর কোন বিষয়ে কথা বলার আগে অবশ্যই কোন বিজ্ঞ আলেমের শরানাপন্ন হোন। অহেতুক পণ্ডিতি করে নিজেকে হাসিরপাত্র বানাবেন না।
আপনার উত্তরোত্তর কল্যাণকামী এক দ্বীনী ভাইয়ের এমনটাই আশা।
এনটি
 
                              
                           
                              
                           
                         
                              
                           
                        
                                                 
                      
                                                  
                                               
                                                  
                                               
                                      
                                         
                                      
                                         
                                      
                                        