জাহিদ জাওয়াদ।।
মুক্তমনার সাইনবোর্ড ব্যবহারকারী সেক্যুলার ও নাস্তিক গোষ্ঠী ইসলামের দাস-দাসীর বিধান নিয়ে নানা অবান্তর প্রশ্ন তুলে। এই বিধানকে তারা বর্বরতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে দাবী করে থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দাস-দাসীর ব্যাপারে ইসলাম যে নির্দেশনা দিয়েছে তাতেই নিহিত রয়েছে ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কল্যাণ।
মানুষ দাস গণ্য হয় কখন? যুদ্ধের ময়দানে মুসলমানদের হাতে ধৃত কাফের শত্রুরা দাস হিসেবে গণ্য হয়। এখন এই শত্রুসেনাদের কি করা হবে এটা নিয়ে অনেক প্রস্তাব থাকতে পারে।
১. এই শত্রুসেনাদের সবাইকে যুদ্ধ শেষে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। ২. সকল বন্দীকে তাৎক্ষণিক হত্যা করে ফেলা হবে। ৩. সকল বন্দীকে জেলখানায় আবদ্ধ করে রাখা হবে।
কিন্ত এই তিনটি প্রস্তাবনার কোনোটিই কারো জন্য এত উপকারী নয়। সবাইকে ছেড়ে দিলে যে শত্রু পক্ষ শক্তিশালী হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার এই হাজার হাজার যুদ্ধবন্দীকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক সব ধরনের উন্নতি থেকে বঞ্চিত করে কারা প্রকোষ্ঠে রেখে দেওয়া বা সবাইকে হত্যা করে ফেলাতেও ফায়দা নেই।
ইসলামী সমাধানের যৌক্তিকতা: এ সকল কারণে ইসলাম এই হুকুম দিয়েছে যে, যত শত্রুসেনা বন্দী হবে তাদেরকে নিজ দলের যোদ্ধাদের মাঝে ভাগ করে দিতে হবে। সব যোদ্ধার ভাগে যদি দুই-একজন করে যুদ্ধবন্দী পড়ে তাহলে রাষ্ট্র এক বিশাল ব্যয় ও ব্যবস্থাপনার ঝামেলা থেকে বেঁচে যাবে।
গোলাম এর মালিক যেহেতু গোলামের কাছ থেকে সেবা গ্রহণ করবে তাই গোলামের সমস্ত খরচ মালিককেই বহন করতে হবে। মালিকের জন্য এটা খুব কঠিন কিছু হবে না। কারণ তখন সে ভাববে কর্মচারী রাখলে তো আমার বেতন দিতে হতোই, আমি সেটা এখন গোলামকে দিচ্ছি।
দ্বিতীয়তঃ গোলাম যেহেতু স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে তাই তারমধ্যে বন্দিত্বের অনুভূতি থাকবে না। ফলে মালিকের প্রতি তার ওই ক্রোধ জন্মাবে না যেটি বন্দিশালায় থাকলে জন্মাতো।
আর যদি মালিক ভালো হয় এবং গোলামের প্রতি দয়া পরবশ হয় তাহলে তো সে অল্পদিনের মধ্যেই গোলামের হৃদয়ের মনিকোঠায় জায়গা করে নিবে। ফলশ্রুতিতে গোলাম মনিবের জন্য তার জীবনকে উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করবে না। ইতিহাসে এর ভুরি ভুরি নজির রয়েছে।
তৃতীয়ত: ইসলামের এই বিধানে গোলামের ব্যক্তিগত সামাজিক জ্ঞানগত উৎকর্ষ অর্জনের সুযোগ রয়েছে। সে চাইলে গোলাম অবস্থায়ও উচ্চতর পড়ালেখা করার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে যদি মালিকের সাথে তার বোঝাপড়া ভালো হয়।
ইসলামের ইতিহাসে এমন হাজার হাজার ফকীহ, মুহাদ্দিস, কাজী, সেনাপতি এমনকি রাষ্ট্রপ্রধানও পাওয়া যায়, যারা মূলত দাস-বংশীয় ছিল। (আশরাফুল জওয়াব,১/৩২-৩৪)
মিসরের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মামলুকরা (দাস বংশীয়) সেখানে আড়াইশো বছর রাজত্ব করেছে। আমাদের উপমহাদেশেও কুতুবুদ্দিন আইবেক, সুলতান ইলতুতমিশসহ দাসবংশীয় শাসকেরা রাজত্ব করেছেন।ইসলাম মানুষের যোগ্যতাকে অবমূল্যায়ন করতে বলেনি।
দাস-দাসীর ব্যাপারে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশনা: সর্বোপরি ইসলাম দাস-দাসীদের প্রতি সর্বোচ্চ যত্ন রাখার নির্দেশনা দিয়েছে। সব ধরনের জুলুম থেকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছে ও নানাভাবে গোলাম আযাদ (মুক্ত) করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে। গোলাম আযাদ করাকে কাফফারা হিসেবে সাব্যস্ত করেছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জেনে রেখো, তোমাদের দাস-দাসী তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তা‘আলা তাদের তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। তাই যার ভাই তার অধীনে থাকবে, সে যেন নিজে যা খায় তাকে তা-ই খাওয়ায় এবং নিজে যা পরিধান করে, তাকেও তা-ই পরায়। তাদের উপর এমন কাজ চাপিয়ে দিও না, যা তাদের জন্য অধিক কষ্টদায়ক। যদি এমন কষ্টকর কাজ করতে দাও, তাহলে তোমরাও তাদের সে কাজে সহযোগিতা করবে।(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩০)
তিনি আরো বলেছেন, কারো যদি একটি বাঁদী থাকে আর সে তাকে প্রতিপালন করে, তার সাথে ভাল আচরণ করে এবং তাকে মুক্তি দিয়ে বিয়ে করে, তাহলে সে দ্বিগুন সাওয়াব লাভ করবে। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২৫৪৪)
অন্য হাদীসে আছে, কেউ কোন মুসলিম ক্রীতদাস মুক্ত করলে আল্লাহ্ সেই ক্রীতদাসের প্রত্যেক অঙ্গের বিনিময়ে তার এক একটি অঙ্গ (জাহান্নামের) আগুন হতে মুক্ত করবেন।(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২৫১৭)
মৃত্যুর কঠিন মূহুর্তেও নবীজী দাস-দাসীদের কথা ভুলে যাননি। মৃত্যু ব্যাধিগ্রস্ত অবস্থায় তিনি বলেছিলেন, সালাত (নামাজ) এবং তোমাদের অধীনস্থ দাস-দাসী! বারবার একথা বলতে বলতে শেষে তাঁর জবান মুবারক জড়িয়ে যায়।(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৬২৫)
সুতরাং সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে দাস-দাসীদের প্রতি ইসলামের বিধান যৌক্তিক ও বাস্তব সম্মত, যেখানে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কল্যাণের অপূর্ব সমন্বয় সাধন করা হয়েছে।
-এটি