মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪ ।। ৩১ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ৬ জিলকদ ১৪৪৫


প্রিয় নানাজান, যাঁর মহব্বতে সিক্ত আমি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা যিকরুল্লাহ খান।।

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে আমার বাড়ি। আমাদের বাড়ি থেকে দুই তিন মাইল দক্ষিণে, ফরিদগঞ্জ থানায় একটা প্রসিদ্ধ মাদরাসা আছে সেই আদিকালের। কারী ইবরাহীম সাহেব রহ.-এর এক শিষ্য ও খলিফা মাওলানা সফিউল্লাহ সাহেব শাসিয়ালি গ্রামে এসে প্রথমে বাড়ি করেন। পরে সেখানে তিনি একটা মাদরাসা করেন, যা শাসিয়ালি মাদরাসা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।

এই মাদরাসায় ‘আলিফ বা তা সা’ দিয়ে আমার পড়াশোনার সূচনা হয়। সেখানে নূরানী পদ্ধতিতে পড়ানো হতো। সেখানকার উস্তাদরা ছিলেন কারী বেলায়েত সাহেব রহ.-এর ছাত্র। আমি তখন বেলায়েত সাহেব রহ.কে চিনতাম না।

হজরতের জামাতা যিনি আমার শ^শুর, মাওলানা মুবারক উল্লাহ তিনি এই মাদরাসায় পড়াতেন। যেহেতু তারা বেলায়েত সাহেবের কাছে পড়েছেন, ট্রেনিং নিয়েছেন, তাই তাদের পড়ানোর পদ্ধতিই অন্যরকম ছিল। জীবনের প্রথম বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু করে যা যা পড়েছি এখনও মনে আছে। এখনও যেন কানে ভাসে। বসার আদব থেকে অনেক হাদিস, দোয়া-মাসায়িল।

আমার শ^শুর হলেন আমার দাদার আপন ভাগিনা। তিনিই আমাকে এই মাদরাসায় ভর্তি করালেন তার ভাগিনার মাধ্যমে। এই মাদরাসায় কারী বেলায়েত সাহেব রহ. আসতেন। এই গ্রামে তিনি এলে গ্রামজুড়ে মজমা বানিয়ে চলতো কুরআন শিক্ষার আসর। মাদরাসার মাঠে কুরআনের তালিম চলতো। মাঠ ছিল অনেক বড়। এই পুরো মাঠ ভরে যেতো সব বয়সী মানুষের দ্বারা।

আশপাশের গ্রামের মানুষ আসতো। নানা (কারী বেলায়েত রহ.) মাইক দিয়ে, কখনও খালি মুখে বা চুঙ্গা দিয়ে পড়াতেন। সেই দৃশ্য যেন এখনও চোখে ভাসে। দশ-বিশ দিন তিনি এখানে থাকতেন। সবার মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করতো। আমি এসব দেখে উৎসাহিত হতাম। তবে কারী বেলায়েত রহ.-এর অবস্থান ও মর্যাদা সম্পর্কে তেমন বুঝতাম না।

এরপর ফরিদাবাদ মাদরাসায় আসি আজ থেকে ৩৯ বছর আগে। কাফিয়া জামাতে ভর্তি হই। এখানে এসেও শুনতাম কারী বেলায়েত সাহেবের নাম। তিনি মাঝে মাঝে আসতেন। মক্তবের খোঁজখবর রাখতেন। এখানে দাওরা শেষ করে আমি দারুল উলুম দেওবন্দে এক বছর পড়ি। তারপর এখানে খেদমত শুরু হয়। খেদমতের বয়স এখন চলছে ৩২তম বছর। শিক্ষকতা জীবনের চতুর্থ বছরে এসে আমার বিয়ে হয় কারী বেলায়েত সাহেব হুজুরের নাতনির সঙ্গে। এখন তিনি হয়ে গেলেন আমার নানা শ^শুর। আমার দাদি, ফুফু ও মা এই সম্পর্ক স্থাপনের বিশেষ উদ্যোক্তা। আত্মীয় হিসেবে আগে থেকেই তো পরিচিত। আমার আহলিয়ার মাধ্যমে কারী বেলায়েত সাহেবের পরিবারের ব্যাপারে আরও জানাশোনা হতে থাকে।

হজরতের ছেলে মাওলানা কালীমুল্লাহ সাহেব একবার আমাদের ফরিদাবাদ মাদরাসায় এলেন। আমি যে তার ভাগনি জামাই এ ব্যাপারে তিনি জানতেন। আমাকে নামে চিনতেন। ফরিদাবাদ থাকি সেটাও জানতেন। তবে এর আগে সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি। তিনি যখন আমার সাক্ষাতে এলেন, আমি ছিলাম ক্লাসে। তিনি আমাকে বাসায় যাওয়ার জন্য দাওয়াত করলেন। একদিন মোহাম্মদপুরে উনাদের বাসাই যাই জামাই হিসেবে। সঙ্গে ছিল আমার আহলিয়া। তাদের আদর-যত্ন ও আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ হই। সেখানেই কারী বেলায়েত সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নানা শ^শুর হিসেবে। নানিও ছিলেন খুবই আন্তরিক। এরপর থেকে তাদের বাসায় নিয়মিত আসা-যাওয়া চলতে থাকে।

কারী বেলায়েত বেলায়েত সাহেব রহ.-এর দ্বিতীয় মেয়ের দিকের নাতনি হলো আমার আহলিয়া। প্রথম সাক্ষাতের পর নানা শ^শুর বাড়িতে যাতায়াত বাড়তে থাকে। বিশেষ করে খুব কম শুক্রবারই বাদ যেতো। আমার আহলিয়া ও বাচ্চাদেরসহ শুক্রবার তাদের বাসায় যাওয়া ছিল আমাদের নিয়মিত রুটিন। এ সুবাধে হজরতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। মাঝে মাঝে তিনি আমার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতেন। একটা কথা আমাকে অনেকবার বলেছেন- ‘আমি আপনাকে অনেক বেশি মহব্বত করি’। যেদিন প্রথম শুনলাম এই বাক্যটি, সেদিন আমি আবেগাপ্লুত হয়ে বললাম নানা! আমার তো একটা কথা মনে পড়ে গেল।

‘রিসালাতুল মুসতারসিদীন’ এর হাশিয়াতে শেখ আবদুুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. একটা কথা লিখেছেন, ‘হাসান বসরি রহ. এর শাগরিদ মুহাম্মদ ইবনে ওসেঈ আল বসরি বসা ছিলেন। কেউ এসে বললো ইন্নি উহিব্বুকা হুজুর আমি আপনাকে মহব্বত করি। সাথে সাথে মুহাম্মদ ইবনে ওসেঈ আল বসরি রহ. একটা কথা বললেন, সেটাই আমি নানা আপনাকে বলছিÑ ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা আন উহাব্বা ফিকা ওয়াআনতা লি মুবগিধ’ আল্লাহ!

তোমার কাছে এই অবস্থা থেকে ফানাহ চাই যে, মানুষ আমাকে মহব্বত করবে অথচ তোমার কাছে অপছন্দনীয়। মানুষ যে রকম মহব্বত করে তোমার কাছেও যেন আমি মাহবুব হয়ে যাই। তিনি আমার এই বক্তব্য শুনে খুবই খুশি প্রকাশ করে বললেনÑ মাশাআল্লাহ অনেক বড় মূল্যবান কথা শুনাইলেন তো!

এভাবে আসা-যাওয়া ও সাক্ষাৎ চলতে থাকে আর নূরানীর আবিষ্কারক মহান এই মানুষটি সম্পর্কে জানাশোনা আরও বাড়তে থাকে। তাঁর কষ্ট ও মুজাহাদার কথা শুনি নিজের জবান থেকে। তাঁকে যখনই জিজ্ঞেস করতাম নানা কেমন আছেন, তিনি উত্তরটা এমনভাবে বলতেন, যা সাধারণত অন্য কোনো আলেম বা কারও থেকে শুনতাম না।

তিনি খুব উচ্চ আওয়াজে বলতেনÑ ‘আলহামদুল্লিাহ! অনেক ভালো আছি।’ আওয়াজটা এমন উচ্চ হতো যে, বোঝাই যেত, তিনি মনের ভেতর থেকেই বলছেন। এগুলো অনেক বড় শিক্ষা। যে হালতেই থাকুক না কেন সর্বাবস্থায় ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলতে পারাটা অনেক বড় একটি গুণ। কারী বেলায়েত সাহেবের পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে আমার পরিবার ও বাচ্চারাও এসব গুণ শিখেছে।

এভাবে আসা-যাওয়ায় সাক্ষাৎ হতো অল্প সময়ের জন্য। এতে কি মন ভেজে? তাই আমি সুযোগের সন্ধানে থাকতাম কীভাবে নানাজানের সঙ্গে লম্বা সময় ধরে থাকা যায়, কথা বলা যায়, শেখা যায়। বিশেষ করে তাঁর সফরসঙ্গী হতে পারতাম যদি! আল্লাহর রহমতে সেই সুযোগ এসে গেল। তাঁর সঙ্গে উমরার সফরের সৌভাগ্য হলো।

এই উমরা ছিল তাঁর জীবনের শেষ দুই সফর। জীবনে যে তিনি কতবার হজে গেছেন, উমরায় গেছেন, এর হিসাব নেই। শেষ দুই উমরায় আমি ছিলাম প্রথমটায় আর শেষটায় আমার আহলিয়াসহ তাঁর পরিবারের অন্যরা।

তাঁর বয়স ছিল তখন ১১০ বছর। শেষ পর্যন্ত হায়াত পেয়েছিলেন (মূল বয়স) ১১৫ বছর। তাঁর জীবনের সর্বশেষ দুই উমরার প্রথমটিতে আমি সঙ্গী হই। টানা উনিশ ঘণ্টা সফর। রমজান মাস ছিল। বিমানে উঠলাম।

বিমান যাচ্ছিল পশ্চিম দিকে। আমাদের সময়ের সঙ্গে এক ঘণ্টার ব্যবধান হয়ে গেল। বিমান পশ্চিম দিকে যত যাচ্ছে সময় তত বাড়ছে। সূর্য ডুবছে না। ইফতারের সময় আসছে না। বিমান থেকে উলামায়ে কেরাম মাসায়ালা বললেনÑ আপনারা চাইলে রোজা ভাঙতে পারেন। পরে কাজা করে নিতে পারবেন।

সেই মাসয়ালা অনুযায়ী অনেকেই রোজা ভেঙে ফেললেন। আমিও ভেঙে ফেলি। নানাকে আমি যতই বলছি রোজা ভাঙার কথা ততবারই বলছেন দেখি দেখি কী করা যায়। আমাদের থেকে যার বয়স অনেক অনেক বেশি, আমরা রোজা ভেঙে ফেললেও তিনি রোজা ভাঙেননি শেষমেষ। পুরো আজমতের ওপর ছিলেন। পরে আমরা যখন মক্কা শরিফে গিয়ে জায়গামতো পৌঁছি, তখন তিনি ইফতার করেন। আমার দিলে এই ঘটনাটা খুবই ধাক্কা খেলোÑ আমরা পারলাম না, আর ১১০ বছর বয়সী এই বুড়ো বয়সে কীভাবে পারলেন!

উমরায় প্রায় ১৫/১৬ দিন ছিলাম আসা-যাওয়া বাদে। এই দিনগুলোতে তাঁর আমল, আখলাক যা দেখলাম তা আসলেই ভুলার মতো নয়। তাঁর তাওয়াফ দেখে আমি পুরোই বিস্মিত। আমি ভেবে কূল পাই না। স্বাভাবিক তো ছিল আমি তাঁকে টেনে নেব, সহযোগিতা করব। কিন্তু তিনি আমার আগে চলে যেতেন এবং আমার হাত ধরে টানতেন।

আমি বড় অবাক হতামÑ সুবহানাল্লাহ এতো মজবুত! এটা মূলত আল্লাহপ্রদত্ত শক্তি। এভাবে আজিব কাইফিয়াতে তাওয়াফ করে করে যখন তা শেষ করতেন আমি হয়ে যেতাম ক্লান্ত আর তিনি সঙ্গে সঙ্গে নামাজ শুরু করে দিতেন।

অন্যান্য আমল জারি রাখতেন। এরকম মানুষ আসলে হয় না। তারাবির সময় এলে আমি তো ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে শুয়েই পড়ি, অথচ তিনি দিব্যি আরামে তারাবির নামাজে দাঁড়িয়ে যান। পুরো তারাবি পড়েন। আমরা তো মাসয়ালা খুঁজিÑ মুসাফির, একটু ছাড় তো আছে, এসব অনেক দিক ভাবি, কিন্তু তিনি এসব কোনোকিছুই ভাবেন না। রমজানের সবগুলো তারাবিই পড়েছেন, একটুও ছাড়েননি। এই জীবনে তিনি আজিমতের উপরেই কেবল চলেছেন।

এক সঙ্গে ওজু করতে যেতাম। আগেরজনের ওজুর কারণে বসার স্থানটিতে পানি থাকত। তিনি বসার আগে হাত দিয়ে মুছতেন। আমি অবাক হতাম। নানা! এটা তো পরিষ্কারই, আপনি মুছছেন যে? আজিমাত এটাই। একজন বসেছিল এখানে, তারপর মুছে এতে বসা চাইÑ বললেন নানা।

মাঝেমাঝে দেখতাম কিছু হাজী সাহেব ওখানে উল্টাপাল্টা করতো। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, আলেম-গায়রে আলেম বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ থাকায় অনেক কাজ উল্টাপাল্টা হয়ে যায়। আমি কিছু বলতে চাইতাম। নানা আমাকে কানে কানে বলেন- ‘শোনেন! এই জায়গাটা এমন জায়গা এখানে যার যার আমল যার যার মতো করে। এখানে কাউকে কিছু বলার জায়গা না।

কারণ কে কোন হালে থাকে, কোন কাইফিয়্যাত নিয়ে থাকে, এটা বলা যায় না। খামাখা কাউকে কিছু বললে আবার বিপদ ঘটতে পারে। এজন্য কখনও কাউকে কিছু বলবেন না।’ এই একটা নসিহত আমার কী যে কাজ দিয়েছে! পরে চিন্তা করে দেখলাম, আসলে বাস্তবতাই এটা। এখানে একেক কাইফিয়্যাত নিয়ে মানুষ আল্লাহর ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে, বসে আছে, শুয়ে আছে, ডিস্টার্ব করা আসলেই ঝামেলা। ‘মাসয়ালা বলা দরকার আপনি হারামের বাইরে অন্য জায়গায় গিয়ে বলুন, এখানে কিছু বইলেন না’ তাঁর এই ছোট্ট কথাটি কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

এভাবে রমজানের রোজা, তারাবি কিছুই ছাড়েননি। আমার শাশুড়ি মানে তাঁর মেয়ে মক্কা শরিফে থাকতেন, তিনি বারবার তাগিদ দিতেনÑ আব্বা রোজা আজকে রাইখেন না। আপনি মুসাফির মানুষ, আপনার জন্য তো সুযোগ আছে। তিনি বলতেনÑ আচ্ছা, দেখা যাক। এটা বলে মূলত এড়িয়ে যেতেন।

আমি সারাক্ষণ তাঁর সঙ্গেই থাকার চেষ্টা করতাম। তাঁর হাতে-পায়ে তেল, মাথায় ঢলা দিতে গেলে তিনি তা করতে দিতেন না। কারও থেকে খেদমত নিতে চাইতেন না। এ এক আজীব মানুষ! এতো বৃদ্ধ, আমি জোর করে অনেক সময় হাতে-পায়ে তেল ঢলে দিতাম। তিনি বলতেন খেদমত নেওয়া এগুলো ভালো জিনিস না। আসলে অনেক শিক্ষার উপকরণ পাই তাঁর থেকে। একদিন তিনি জোহরের পর ঘুমিয়ে পড়েন। আমি ভাবলাম হয়তো ঘুমটা লম্বা হবে। তাই আমি একটু ঘোরাফেরা করার ফুরসত পাই। আমি তাঁকে রুমে রেখে কিতাব মার্কেটে যাই। মার্কেট খুঁেজ পেতে আমার সময় লাগে।

‘মুসনাদু আবি হানিফা লিল হাফিজ ইবনে খসরু’ আর ‘মুসনাদু আবি হানিফা লিল আবি মুহাম্মাদ হারেসি’ এর কিতাব কিনি। এই কিতাব দুটি ছিল আমার অনেক তামান্নার। কিতাব দুটি কিনে যখন বাসায় ফিরি তখন ইফতারের কাছাকাছি সময়। ইফতারের আয়োজন চলছিল। এই সময় নানা আমাকে ধরে বসলেনÑ কোথায় গেলেন আপনি!

আজকে আপনি আমাকে ফাঁকি দিলেন। আমি বললামÑ নানা! আমি তো সুযোগ পাই না, কিছু কিতাব কেনার দরকার ছিল, ভাবলাম আপনি অনেকক্ষণ ঘুমাবেন। আর এই ঘুমে থাকাবস্থাতেই আমি ফিরে আসব। তাই লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম। তিনি বললেনÑ মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ। ভালো কাজের জন্যই তো গেলেন। তো, কী কিতাব আনলেন? আমি নাম বললাম। তিনি বললেনÑ মাশাআল্লাহ খুব সুন্দর কিতাবই তো আনলেন। আচ্ছা, কিতাব থেকে পড়ে আমাদের কিছু শোনান। নানাসহ তাঁর পরিবারের অন্যান্য উলামায়ে কেরাম ছিলেন ইফতারের ওই মজলিসে। এই ভরা মজলিসে আমি মুসনাদু আবি হানিফা লিল হারেসি কিতাব থেকে কিছু পড়ে শোনালাম।

সেখানে হাম্মাদ ইবনে আবি সুলাইমানের মাসানিদ কী কী আছে, তার সূত্রে বর্ণিত হাদিসগুলোর পাতা উল্টিয়ে রফয়ে ইয়াদাইনের হাদিস পড়ে শোনাই। ইমাম আবু হানিফা ও আওজায়ি রহিমাহুমুল্লাহর একটি মুনাজারা ছিল এই হাদিসে। এই কিতাবে ‘রফয়ে ইয়াদাইন’ বিষয়ে আওজায়ির ওপর ইমাম আবু হানিফার প্রাধান্য লাভের বিষয়টি পড়ে শোনানোর পর নানা খুব খুশি হলেন এবং বললেন এই কিতাব তো খুব দরকারি! উপস্থিত কয়েকজন আলেম সেই সুরে বলে ওঠলেন হ্যাঁ, এই কিতাব খুবই দরকারি। আপনি জায়গামতো আমাদেরকে এমন হাদিস শোনালেন, অথচ বাঙালি হানাফিরা তো এখানে এসে রফয়ে ইয়াদাইন শুরু করে দেয়।

মনে করে যে, রফয়ে ইয়াদাইন না করলে কী জানি হয়। অথচ, মাসয়ালা তো এটা। আরেকজন আলেম বলে ওঠলেনÑ এসব কিতাব বাংলাদেশে নেওয়া দরকার। আমি বললাম হ্যাঁ, এজন্যই তো কিনলাম। সবাই তখন হেসে ওঠলেন। নানাও খুব হাসলেন। সেদিনের উৎফুল্লমুখর পরিবেশে নানাজানকে অন্যরকম লাগলো।

মক্কা থেকে কাফেলা এবার মদিনা অভিমুখে। অন্যরা যাচ্ছেন অন্যান্য গাড়িতে। আমি যাচ্ছি নানার সঙ্গে এক গাড়িতে। তাঁর বড় ছেলে মাওলানা মাসীহ উল্লাহ সাহেব নিজেই ড্রাইভ করছেন। আমি ও নানা পেছনের সিটে। নানা দুরুদ শরিফের আমল করছিলেন। আমিও ছিলাম চুপচাপ। হঠাৎ করে তিনি আমাকে প্রশ্ন করে বসলেন, আচ্ছা বলুন তো আমি এই মুখে কয়বার দুরুদ শরিফ পড়তে পারব?

মানুষের মুখ সীমিত, হায়াত সীমিত, সময় সীমিত, কয়বার আর পড়া যাবে। Ñআমি বললাম। দেখুন, আমি এ বিষয়ে চিন্তা করেছি নিজের জীবনে কয়বার আর দুরুদ পড়তে পারব। তো, আমি এমন একটা মিশন হাতে নিয়েছি, আমি আমার জীবনটা দিয়ে এই মিশনকে দাঁড় করিয়েছি। এখন দেখেন আমার এই মেহনতের বরকতে বাংলাদেশে নয় শুধু, সারা বিশে^ ছড়িয়ে পড়েছে নূরানী পদ্ধতি। লাখো লাখো ছোট ছোট বাচ্চাÑ বয়স্ক মুরব্বিরা তো আছেই। এই ছোট ছোট বাচ্চারা দুরুদ শরিফ পড়ে। প্রতিটা সবকের শুরুতে একবার দুরুদ শরিফ পড়ে, শেষে একবার পড়ে। তো, দুইবার করে তো হতেই আছে। এতো লাখ লাখ মানুষ যদি দুরুদ শরিফ পড়ে, আচ্ছা বলুন তো, এই সিস্টেমটা আমিই চালু করেছিলাম, এর সওয়াব কি আমি পাবো না?

বলেন কী নানা! এগুলো তো সব আপনার কামাই। তিনি কিছুটা চুপ থাকলেন। তারপর তিনি বললেন, আমি নিজে কতোটুকুই বা কুরআন শরিফ পড়ব, কিন্তু আমি যে লাখো লাখো মানুষকে কুরআন শিখিয়ে দিয়েছি, এরা যে পড়ছে, এর সওয়াব কি আমি পাবো না?

জি নানা, কী বলেন! এগুলো তো আপনার আসল কামাই। পরে তিনি বললেন, ছাত্রজীবন শেষ করার পর আমার নিয়ত ছিল উত্তরাধিকার সূত্রে যা পাবো তা সব বেচে একেবারে মক্কা শরিফে এসে যাবো। ক্রেতাও ঠিক করে রেখেছিলাম। বায়নাও হয়ে গিয়েছিল। এখন বাকি রেজিস্ট্রি। এটা করেই টাকা-পয়সা নিয়ে আমি মক্কা শরিফে ছুটব।

পরে গেলাম আমার উস্তাদে মুহতারাম হাফেজ্জী হুজুরের কাছে। এ বিষয়ে মশওয়ারা চাইলে তিনি চুপ থেকে অনেকক্ষণ পরে বললেনÑ ‘মৌলভী বেলায়েত! তোমার দিলটা কাবা ঘরে রাখো, আর কাজ এখানে করো। ইনশাআল্লাহ বরকত পাবে।’ আমাকে নানা গাড়িতে বসে এই কথাটি বলার পর বললেনÑ দেখেন, এ কথাটি মানতে আমার কষ্ট হয়েছিল।

কারণ আমি তো পুরাই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি, ভাবলাম হুজুর অনুমতি দিলেই সব চূড়ান্ত বেচে কাবা ঘরে এসে পড়ে থাকব, জমজমের পানি খাবো আর আল্লাহ-বিল্লাহ করব। এই কথা বলে তো আমার প্রোগ্রাম সব শেষ করে দিলেন। মানতে এতো কষ্ট হয়েছে, কিন্তু আকল তো আছে। হাফেজ্জী হুজুর যা বলেন, ‘কলন্দর হারছে গুয়াদ দিদাহ গুয়াদ’ হিসেবে তিনি যা বলেছেন তো বুঝেই বলেছেন। তারপর আমি দেশে থেকে গেলাম আর কাজ করতে থাকলাম। মেহনত-মুজাহাদা করলাম।

এবার নানাজান আমাকে বলেনÑ আচ্ছা বুলন তো, যদি মক্কায় চলে আসতাম, আমি হয়তো আল্লাহ-বিল্লাহ করে নিজে নিজে আমল করতে পারতাম, কিন্তু আমি কতটুকু করতে পরতাম একা একা! আর উস্তাদের কথা মেনে বাংলাদেশে কাজ করাতে এখন লাখো লাখো মানুষ আমার মেহনতের ফসল ভোগ করছেন। তাদের সবার সওয়াব কি আমি পাবো না?

জি¦, অবশ্যই নানা। আমি সম্মতিসূচক উত্তর দিই। একবার আমি তাঁর বাড়ি বেলায়েতনগর (শাহরাস্তি) বেড়াতে গিয়েছি, সঙ্গে আমার আহলিয়াও। আমি আর নানা এক দস্তরখানে খাচ্ছিলাম। আমি লুকমা মাখিয়ে ভাত মুখে তুলতে যাবো এমন সময় তিনি বাম হাতে আমার ডান হাত চেপে ধরে বললেন, আপনাকে একটা কথা বলব।

জি নানা অবশ্যই- আমি চমকে ওঠে বললাম। আপনি কোনোদিন তাবিজাতি করবেন না। যেহেতু (মাদরাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি) ইমামিত করেন, তাই কেউ যদি কোনো সময় ঝাড়ফুঁক, তাবিজের জন্য আসে, তাহলে তা দিয়ে দিবেন, কিন্তু কোনো বিনিময় নেবেন না। এটাকে পেশা বানাবেন না। আমি আমার জীবনে কোনো মানুষকে এমন দেখিনি যে, তাবিজাতি করেছে, এটাকে পেশা বানিয়ে এই লাইনে এগিয়েছে, আর তারা বরকত পেয়েছে। বরং সংসার জীবনে তারা ধ্বংস হয়েছে। এজন্য আমি আপানাকে এই নসিহত করলাম।

তিনি যে আমাকে বিশেষ মহব্বত করেন এটা তার প্রমাণ। আমি তো আল্লাহর রহমতে এমন ধরনের কাজে নেই। আমি বললাম- নানা! আপনার দোয়ায় আলহামদুলিল্লাহ আমার ছোট্টবেলা থেকেই এই পথটাকে অনেক বেশি খারাপ নজরে দেখে আসছি। পছন্দ করি না। জায়েজ যেভাবেই আছে, আমি ব্যক্তিগতভাবে এটাকে পছন্দ করতাম না।

আপনি যে নসিহত করলেন এটা অটোমেটিক আমার মধ্যে আমল আছে।
প্রিয় নানাজান অসুস্থ হওয়ার পর অনেকবার দেখতে যাই। আমার আশ্চর্য লাগে, দেখতাম শারীরিকভাবে তিনি কষ্ট পাচ্ছেন, তারপরও কেমন আছেন জানতে চাইলেই বলতেনÑ আলহামদুলিল্লাহ! এই বাক্যটি আমি তাঁর জবান যতদিন জারি ছিল, ততদিনই শুনেছি। কেউ কেমন আছেন জানতে চাইলে বলতেনÑ আলহামদুল্লিাহ! কোনোদিন উহ! আহ! কষ্ট পাচ্ছি এসব বলতেন না। এমনিতে দোয়া চাইতেন। আমি অসুস্থ এরকম কোনো অভিযোগও করতেন না।

নানাজানের ইন্তেকালের খবর যখন এলো তখন আমি মসজিদে ইতেকাফে ছিলাম। রমজান মাসের শেষ দশকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহর ইতেকাফ। এই সময়ে এই খবর শুনে যেন আসমানটা আমার উপর ভেঙে পড়লো। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। যাঁকে আমার আহলিয়াসহ এতো মহব্বত করি, তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে পারবো না!

শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলাম, ইতেকাফ ভেঙে ফেলব, পরে কাজা করব। আমার ছেলেকে পাঠিয়ে দিলাম কবরস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য। সে এখন মিসর আল-আজহার বিশ^বিদ্যালয়ে আছে। সে আমার এখানেই পড়েছে। সে সুন্নাত মোতাবেক ভালো করে কবর বানাতে জানে। নানার কাছেই সে সরাসরি নূরানী পড়েছে। আমরা সবাই যাই গ্রামের বাড়িতে। জানাজা-দাফন হয়। এখনও মাঝে মাঝে গেলে কবর জিয়ারত করি।

আমার মনে হয়Ñ নানাজানের হক আদায় করতে পারিনি। তাঁর একটা কথা মনে পড়লে কান্না চলে আসে। তিনি যে বলতেনÑ ‘আপনাকে খুব মহব্বত করি’ এ কথাটা মনে হলেই কান্না চলে আসে। জীবিত থাকতে তাঁরা আমাকে অনেক হাদিয়া দিতেন। এখন আমিও নানা ও নানির জন্য ইসালে সওয়াবের নিয়তে দান-সদকা করি। তাদের জন্য দোয়া করি। আল্লাহ আমার এই প্রিয় নানা ও নানিকে জান্নাতের আলা মাকাম দান করুক। আমিন।

লেখক: মুহাদ্দিস, জামেয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ, ঢাকা

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ