শনিবার, ১৮ মে ২০২৪ ।। ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ১০ জিলকদ ১৪৪৫


অ্যা ম্যাসেজ টু দ্যা সিকার'স অব নলেজ: আলী মিয়া নদভীর ঐতিহাসিক ভাষণ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

অনুবাদ: মহিউদ্দীন খান তানজীম।।
২৯ আগস্ট ১৯৮৭ সালে St.Cross College Oxford এ প্রদত্ত সাইয়েদ আবুল হাসান নদভীর ঐতিহাসিক ভাষণ।

আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী সে ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন, তিনিই একক ব্যক্তি, যাকে প্রকৃত অর্থেই মানবেতিহাসে ক্রমোন্নতির রূপকার আখ্যা দেওয়া যায়। যিনি অজ্ঞতার স্থলে মানবজাতিকে দিয়েছেন জ্ঞান-প্রজ্ঞা,আচার-অনুষ্ঠান ও প্রথার স্থলে দিয়েছেন বুদ্ধিদীপ্ততা, পূর্বপুরুষের অন্ধ-অনুকরণের (Blind Following) স্থলে দিয়েছেন চিন্তার স্বাধীনতা (Freedom of Thought)।

তিনি আর কেউ নয়, হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতিহাসের এমন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন, যেটি ছিল বুদ্ধি-বিচক্ষণতার যুগ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক অজ্ঞতা-অযৌক্তিকতার একটি যুগ।

তার শিক্ষা মানবজাতিকে নিয়ে এসেছে একটি যুক্তি-বুদ্ধির পৃথিবীতে (World of Reason) আর তার দোষগ্রাহী জনগোষ্ঠীকে করেছে সত্যের পথে অনুপ্রাণিত।

তার যুগটি ছিল সর্ব-বিবেচনায় পশ্চাদগামী। যিনি এমন এক জাতির নিকটে প্রেরিত হয়েছিলেন,যারা তাদের ‘অজ্ঞতা’ নিয়ে বড়াই করতো। পরিচিত ছিল ‘উম্মীইইন’ বা ‘অক্ষরজ্ঞানহীন’ (Illiterates) হিসেবে। কুরআন সে সময়কার আরবের চিত্রটি ফুটিয়ে তোলেছে এভাবে- ‘তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতসমূহ, তাদের পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত। (সূরা জুমুআহ-২)

একটি অভাবনীয় বিষয়- দেখুন, কুরআনের বিপ্লবের শুরুটাই ছিল একটি অসাধারণ বিষয় দিয়ে। কুরআন প্রথম এসেই বলেনি, আল্লাহর কর্তৃত্ব স্বীকার করো, তার নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করো,তার গুন-কীর্তন করো,প্রতিমাপূজা, মূর্তিপূজা বর্জন করো; বরং পরবর্তীতে এগুলো ধাপে ধাপে বলেছে। আর প্রথমেই যেটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হয়েছিল সেটি হচ্ছে, পড়(Read) তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাটরক্ত থেকে। (সূরা আলাকঃ১-২)

এটি ছিল মানবেতিহাসে অপরিসীম তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা। পরবর্তীতে যা সমন্বিত প্রচেষ্টায় অভূতপূর্ব একটি পান্ডিত্যের যুগের সূচনা করেছে। সৃষ্টি করেছে জ্ঞান ও বিশ্বাসের মিশেলে একটি নতুন সভ্যতার।(Civilization) এরপর অপর একটি আয়াতে বলা হয়েছে,তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানতো না। (সূরা রাহমান)

এখানে মানুষের অনাবিষ্কৃত সবধরণের জ্ঞান-বিজ্ঞান যেটি সে অর্জন করতে সক্ষম,তার চূড়ান্ত উৎসমূল সম্বন্ধিত হয়েছে আল্লাহর দিকে। আর এটি ছিল নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিপ্লবের অপর একটি প্রারম্ভিক ধারা। পরবর্তীতে জ্ঞানার্জন,ধর্মীয়বাণীর প্রচার, ও চিন্তার ধরণ পরিবর্তনে এটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।

জ্ঞান-বিজ্ঞানকে তৈরী করে এমন এক সহকর্মী এবং ধর্মীয়মিত্র হিসেবে, যেটি সর্বপ্রকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমস্যার সমাধানে মানবজাতির সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে।জ্ঞানের মঞ্চে ধর্মের ভীতিকে করেছে চিরতরে বিতাড়িত।

কুরআনী ভাবনা- পবিত্র কুরআন তথ্য-উপাত্তের বিভিন্ন উৎস সম্পর্কে আলোচনা করেছে। বিশেষভাবে জ্ঞানার্জনের জন্য যার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, তার সম্পর্কে। কুরআনুল কারীম বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলী নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে উৎসাহ দিয়েছে। আমাদের নিকট যেটি ইতিহাস(History) হিসেবে পরিচিত,কুরআনুল কারীমে সেটি উল্লেখিত হয়েছে "আইয়্যামুল্লাহ" বা(আল্লাহর দিবস) সুন্নাতুল্লাহ(আল্লাহর নীতি) বলে।

প্রাচ্যের কবি ড. ইকবাল মানবীয় বুদ্ধি এবং জ্ঞানের উৎসমূল নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘অভিজ্ঞতা’ মানবজ্ঞানের উৎস ঠিক, কিন্ত কুরআন আরো দু'টি উৎসের কথা বলে। সেটি হলো, প্রকৃতি এবং ইতিহাস। কুরআন প্রমাণ করেছে সূর্যের ঘূর্ণন, দিন-রাত্রির পরিক্রমণ,ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতায় রয়েছে চরম বাস্তবতার নিদর্শন।

জ্ঞানের একিভূতকরণ

শিক্ষার বিভিন্ন শাখাকে একিভূত করে মানবসেবায় ইতিবাচক এবং গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে ইসলামের অবদান ছিল অসামান্য। ইসলামপূর্ব যুগে জ্ঞানের শৃঙ্খল(Chain of knowledge ) ছিল বিক্ষিপ্ত, টুকরো টুকরো।এর শাখা ছিল পরস্পর বিরোধী,সাংঘর্ষিক। দর্শন এবং পদার্থবিজ্ঞান এর সাথে ধর্মের ছিল কঠিন বিরোধ।এমনকি বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান তথা চিকিৎসাবিজ্ঞান, গণিত, ইত্যাদিও শিক্ষাও ছিল নেতিবাচক। অতচ, ইসলাম একটিমাত্র বাক্য-পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন-দিয়ে উম্মুক্ত করেছে জ্ঞানের সবকটি কপাট।

আমি ব্যাপক অধ্যয়ন শেষে এই উপসংহারে এসে পৌছেছি যে, তৎকালে মুসলমানরা কেবল ভূখন্ডের পর ভূখন্ড রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিজয়ই অর্জন করেনি,বরং তারা ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় সকলের শীর্ষে। মুসলিমপন্ডিতরা তাফসীর(Exegesis),হাদিস(Traditions), ফিকহ(Jurisprudence),তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব(Comparative Religion), এর বাইরে অধ্যয়ন করেছেন;পদার্থ,রসায়ন,গণিত,উদ্ভিদবিজ্ঞান, ভূগোল,সংস্কৃতি,দর্শন ইত্যাদি। তাদের কতেক তো মানবিক এবং বিজ্ঞান শাখায় দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত বিশ্বকে পথ-নির্দেশ করেছেন।

তাদের মধ্যে খাওয়ারেজমি,যিনি প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাপ তৈরী করেন। পরবর্তীতে আবুল কাসিম এসে যার পূর্ণাঙ্গতা দান করেন এবং মুসলিমবিশ্বের প্রধান বানিজ্যপথ (Trade Road )এর সন্ধান দেন তার 'আল-মাসা'লিক ওয়াল মামা'লিক' গ্রন্থে। ইবনে আল-হাইসামের ২শত গ্রন্থের মধ্যে ৪৭টি ছিল গণিত আর ৫৮ টি প্রকৌশলবিদ্যার।তার বিখ্যাত গ্রন্থ'আল-মানা'যির'(The Visual World ) বিশ্বব্যাপী পরিচিত। এ

ছাড়া জিরো এর প্রবর্তক মুহাম্মদ ইবনে মুসা খাওয়ারিজমি। দার্শনিক আল-রাজী,চিকিৎসক ইবনে সিনা,আল-বেরুনী,আল-বাত্তানী, বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

পরিশেষে আমি আপনাদের ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে এ কথাটুকু রাখতে চাই যে, মানুষ হলো আল্লাহর প্রতিনিধি। অতএব, স্বাভাবিকভাবেই তার কাধে এই দায়িত্ব এসে বর্তায় ,সে পৃথিবীতে রবের ইচ্ছার(Will of God) প্রতিফলন ঘটাবে।মানবেতিহাস হোক কিংবা জ্ঞান-বিজ্ঞান এর ইতিহাস হোক, বিপর্যয় তখনই নেমে এসেছে, যখন মানুষ ভুলে গেছে; সে বিশ্ব-অধিপতির একজন প্রতিনিধি।

অথচ, আজকের অবস্থা তো ঠিক এমনি। মানুষ দেদারসে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিখছে কিন্তু তার হৃদয় থেকে বের করে দিচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রকৃত স্রষ্টাকে। আমি ইউরোপ-আমেরিকার সমস্ত রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিদীপ্ত মানুষদের পুনঃস্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, পৃথিবীতে মানুষ নিজেকে পূর্ণস্বাধীন ও নিয়ন্ত্রক বিবেচনা করে সবচে প্রাণনাশক ভুলটি করেছে। সে ভুলে গেছে তার সূচনা এবং সমাপ্তির কথা। হারিয়ে ফেলেছে জীবনের লক্ষ।

আমি দায়িত্ববান মানুষদেরকে অত্যান্ত দৃঢ়তার সাথে একথাটুকু বলতে চাই, মানুষ রবের প্রেরিত একটি সাধারণ সৃষ্টি এবং তার প্রত্যাবর্তন অবশ্যম্ভাবী -এ মহাসত্যটুকু মেনে না নেওয়া পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুধু ব্যাহতই হবে। মানুষের জন্য মেনে নেওয়া অপরিহার্য যে, তার এ জ্ঞান-বিজ্ঞানের দম্ভকে ধূলিস্যাৎ করে দেওয়া তার রব, প্রকৃত জ্ঞানস্রষ্টার কাছে কোন ব্যাপারই না।যখন রবের সাথে তার এ বিশ্বাসে ফাটল ধরবে,তখনই সে হারিয়ে ফেলবে চলার পথ, সৃষ্টির উদ্দেশ্য। পরিণামে আমাদের পৃথিবী হয়ে পড়বে মানবতাবিনাশী রণক্ষেত্রে। জন্ম নেবে অন্যায়-অবিচার,পরাধীনতা, অবমূল্যায়ন ও ত্রাসের রাজত্ব।

-ইংরেজী থেকে অনুবাদ করেছেন, মহিউদ্দীন খান তানজীম। শিক্ষার্থী, দাওরায়ে হাদীস, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বৃন্দাবন সরকারী কলেজ হবিগঞ্জ।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ