মঙ্গলবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ।। ১৮ ভাদ্র ১৪৩২ ।। ১০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

শিরোনাম :
বায়তুশ শরফ স্বর্ণপদক পাচ্ছেন দুই সম্পাদকসহ চার গুণীজন নুরের ওপর সেনা-পুলিশ হামলা ন্যাক্কারজনক, নিঃশর্ত দুঃখপ্রকাশ করতে হবে: নাহিদ  পিআর ও জুলাই সনদ নিয়ে বাড়ছে বিরোধ, কোন পথে ইসলামি দলগুলো কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা ও আন্তর্জাতিক মহাসমাবেশ বাস্তবায়নে পরামর্শ সভা  আফগানিস্তানে ভয়াবহ ভূমিকম্পে প্রাণহানির ঘটনায় খেলাফত মজলিসের শোক আলেমে রাব্বানী ক্বারী তৈয়ব (রহ.)-এর স্মরণে আলোচনা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত  বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে মির্জা ফখরুলের হাতে ফুল তুলে দিলেন সারজিস ‘কোরবানির চামড়া লবণজাত করে ক্ষতিগ্রস্ত মাদরাসার পাশে দাঁড়ায়নি সরকার’  আওয়ামী ‘দোসরদের’ রাজনীতি নিষিদ্ধে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকসুতে ইসলামী ছাত্র আন্দোলন সমর্থিত প্যানেলের ইশতেহার ঘোষণা

করোনার ভেতরের অন্য বিপর্যয়!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুসা আল হাফিজ।।

মহামারি আর দুর্ভিক্ষ। একটি আরেকটির হাত ধরে চলে। উভয়ের সম্পর্ক অনেক পুরনো। এই যে কোভিড ১৯ এর হানা, সে সাথে করে নিয়ে এসেছে মন্দা। দুনিয়াজোড়া মন্দা বলতে গেলে শুরু হয়ে গেছে। এ মন্দা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে ভয়ানক হবার আশঙ্কা অকারণ নয়।

আধুনিক দুনিয়ায় ভয়াবহ যে মন্দা ' গ্রেট ডিপ্রেশন ' নামে বিখ্যাত, তার শুরুটা হয়েছিলো ১৯২৯ সালে, সমাপ্তি আসে ১৯৩৯ সালে। কেউ কেউ অবশ্য এর সমাপ্তি টেনেছেন ১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে। তাহলে কম হলেও এই মন্দার স্থায়িত্ব ছিলো ৩৩ মাস। এই ৩৩ মাসে ইউরোপ-আমেরিকা চরম বিপর্যয়ে কাতরাতে থাকে। চারভাগের এক ভাগ মানুষ হয়ে যান বেকার। বৈশ্বিক জিডিপি কমে যায় শতকরা ২৭ ভাগ। উৎপাদনে নেমে আসে স্থবিরতা। কলকারখানা হয়ে যায় বন্ধ। আয়ের পথ হয়ে যায় রুদ্ধ। অনাহার যায় বেড়ে। ক্ষুধা ও অভাবে মারা যেতে থাকে লোকেরা। শুধু আলু খেয়ে জীবন কাটাতে থাকে অধিকাংশ মানুষ।

আমেরিকা সেই মন্দা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলো প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের নেতৃত্বে। নিউ ডিল কর্মসূচীর মাধ্যমে আমেরিকা ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো। সঙ্কট থেকে বেরিয়ে এসেছিলো ইউরোপ।

এই যে মহামন্দা, সেটা কিন্তু এতো ব্যাপক ছিলো না। তার চরিত্র ছিলো না সর্বগ্রাসী। এখন যে মন্দার পদধ্বনি শুনা যাচ্ছে, সে হবে স্বভাবতই আরো ভয়াবহ।

মন্দাটা আসছে বা আসবে, ব্যাপারটা এমন নয়; মন্দা এসে গেছে। আমরা করোনার হুমকিতে আছি, এটা যতোটা সত্য, দুনিয়া এখন মন্দায় আছে, এটাও সমান সত্য। যদি বিশ্বাস করতে না চান, জেনে নিন মন্দা কী?

- মন্দা হলো অর্থনৈতিক কাজকর্ম অনেক বেশি পরিমাণে কমে যাওয়া এবং সেটা কয়েকমাস ধরে স্থায়ী হওয়া!

তার মানে মন্দা ও দুর্ভিক্ষ নিছক কোনো আশঙ্কা নয়, বাস্তব ব্যাপার হয়ে উঠেছে। এটা মাথার উপর তখনই হাজির হয়েছে, যখন করোনা মহামারি হাজির হয়েছিলো।

আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, মহামারির পীঠে ছোট-বড় মন্দা-দুর্ভিক্ষ সওয়ার হয়ে থাকেই। ইউরোপের ইতিহাস এর জ্বলন্ত দলীল। কারণ মহামারির অভিজ্ঞতা সবচে' বেশি সঞ্চিত আছে এ মহাদেশের অতীতে। সেই ৪৩০ খ্রিষ্টপূর্বে আমরা দেখি, গ্রিসে দ্য প্লেগ অব এথেন্স। যাকে বলা হয় প্লেগের পয়লা মহামারি। এ মহামারি হাজার হাজার গ্রিক সৈন্যের মরণ এনেছিলো! শুধু তাই নয়, এনেছিলো গণমৃত্যু। গণঅভাব, অনাহারও।

ঐতিহাসিক থুসিডাইডসের রচনাংশ ‘হিস্ট্রি অব দ্য পেলোপনেসিয়ান ওয়্যার’ এ মিলে সেই মহামারির ইতিবৃত্ত। এটি নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও থুসিডাইডসের তথ্য নিয়ে তেমন সন্দেহ প্রকাশ করেননি ইতিহাসকারগণ। কারণ থুসিডাইডস এ প্লেগ দেখেছেন নিজের চোখেই। তিনি দেখেছেন, কীভাবে গ্রামের পর গ্রাম জনমানবহীন হয়ে গেছে!

অনেকের মতে প্লেগ নয়, এ সর্বনাশের জন্য দায়ী ছিলো গুটিবসন্ত, জ্বর ও টাইফয়েড! এটি ছড়িয়ে দেয় যে ভাইরাস, তার নাম ভেরিওলা। যা হত্যা করে শহরের শতকরা বিশ ভাগ জীবন। এর পরে এথেন্স অভাবে, বিপন্নতায় ভোগে বহুদিন। মাথা তুলতে লেগে যায় অনেক সময়।

রোমান আমলে ইউরোপ দেখেছে বড় বড় মহামারি। এগুলোর অন্যতম ছিলো দ্য প্লেগ অব জাস্টিনিয়ান। ৫৪১ সালে এ প্লেগ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে প্রবলভাবে কাঁপিয়ে দেয়। সাথে করে নিয়ে আসে অভাব,গণমৃত্যু, অনাহার। একই সময়ে মিশরে চলছিলো মৃত্যুর মিছিল। প্লেগ অব ইজিপ্ট। দুনিয়ার ইতিহাস বদলে দেয় এ বিপর্যয়। ৫৪০-৫৪১ সালে এ মহামারি ছড়িয়ে পড়ে ইঁদুরের মাধ্যমে। মিশর থেকে খাদ্য শস্য যেতো ইউরোপে। কনস্টান্টিনোপলে প্লেগের কালো হাত বিস্তৃত হয় ভয়ালভাবে। ক্রমেই বেড়ে চলছিলো তার বিস্তার। এক পর্যায়ে প্রতিদিন প্লেগে মারা যেতো গড়ে ৫০০০ মানুষ।

কোনোভাবেই থামছিলো না এ মহামারি। প্রায় পঞ্চাশটি বছর সে ইউরোপকে মৃত্যুপূরী বানিয়ে রাখে। কেড়ে নেয় কমপক্ষে আড়াই কোটি মানুষের প্রাণ। নিহতের সংখ্যাটা অনেক ঐতিহাসিকের কাছে অনেক বেশি- প্রায় দশ কোটি। প্লেগ শেষ হলে ইউরোপে শুরু হয় অন্ধকারের ভয়াল কাল- এজ অব ডার্কনেস! এ প্লেগ যে অভাব ও দারিদ্র বয়ে আনে, তা থেকে ইউরোপের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে মুক্তি পেতে যুগ যুগ ধরে লড়ে যেতে হয়েছে।

তারপর প্লেগ কিছু দিন পর পরই হানা দিতো ইউরোপে। চীন থেকে সেটা ইউরোপে হানা দেয় ১৩৩৪ সালে। দ্য গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন নামে বিখ্যাত সেই প্লেগ ইতালিকে মরণের উপত্যকা বানিয়ে দেয়। এক ফ্লোরেন্স শহরে ছয় মাসেই মারা যায় নব্বই হাজার মানুষ। লন্ডন শহরে লাশ গণনার সুযোগ ছিলো না। জনপদের পর জনপদ হয় উজাড়। দুর্ভিক্ষ লাভ করে ভয়াল আকার। প্রায় আড়াই কোটি মানুষ মারা যায় ইউরোপে।

কিন্তু এর চেয়েও ভয়াবহ মহামারি অপেক্ষমাণ ছিলো সামনেই। সেটা এলো ১৩৪৬ সালে। দ্য ব্লাক ডেথ! ব্লাক সি বা কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী এলাকা থেকে ছড়ায় এ মহামারি। খাদ্যদ্রব্যবাহী জাহাজের ইঁদুরগুলো বহন করে প্লেগের ভাইরাস।ভাইরাসটির নাম ছিলো অনেকের মতে ইবোলা।

কী প্রলয় লুকিয়ে ছিলো এ ভাইরাসে, সেটা বুঝেছিলো ইউরোপ। মহাদেশটির প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মানুষ নিহত হয় প্লেগে। ১৩৪৭ থেকে ১৩৫১ সালে মানুষ কেবলই লাশ দেখেছে, দাফনের ফুরসৎ ছিলো না কারোরই। ২০০ বছর ধরে জারি থেকেছে এর প্রভাব। যাতে নিহত হয়েছে প্রায় দশ কোটি মানুষ। ব্লাক ডেথের ভেতর লুকিয়ে ছিলো অনেকগুলো দুর্ভিক্ষ ও মন্দা।

এর দাপটে যখন চারদিক তটস্থ, তখনই স্মলপক্স হানা দেয় মেক্সিকোতে। ১৫১৯ এ সেটা মহামারির রূপ নেয়, জারি থাকে দুই বছর। নিহত হয় প্রায় আশি লাখ মানুষ। ইউরোপের ফরাসি, ব্রিটিশ ও ডাচরা স্মলপক্সকে বহন করে নিয়ে যায় আমেরিকায়। ছড়িয়ে পড়ে ম্যাসাচুসেটসে। ধীরে ধীরে অন্যত্র। মারা যায় প্রায় দুই কোটি মানুষ!

এই যে মৃত্যুধারা, সেটা থামেনি ইতিহাসের কোনো পর্বেই। মাত্রা হয়তো কমেছে। কিন্তু মহামারির সাথে দুর্ভিক্ষের সহাবস্থান বরাবরই জারি থেকেছে। ইউরোপ-আমেরিকায় নোবেল করোনা ভাইরাসের প্রলয়তাণ্ডব পুরনো সেই ইতিহাসকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাস শুধু ইউরোপ বা আমেরিকাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে না, সারা বিশ্বকে অচল ও গতিহীন করে দিয়েছে। উৎপাদন নেই, চারদিকে মরণের অভিশাপ। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা একই সাথে আক্রান্ত। যার পূর্বনজির বিশ্বের ইতিহাসে নেই। আগেকার মহামারি ও দুর্ভিক্ষগুলো বৈশ্বিক ছিলো না, ছিলো আঞ্চলিক। কিন্তু এবারকার মহামারি সারা দুনিয়াকে অচল করে দিয়ে আসন্ন যে মহাদুর্ভিক্ষ ও মন্দার ভেরি বাজাচ্ছে, সেটা সারা পৃথিবীকেই ভাবিয়ে তুলছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু যেন মাথার উপরে ঘুরছে!

প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট তার নিউ ডিল কর্মসূচির মাধ্যমে অভাবকালে শুধু দান ও সাহায্য নির্ভর প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আমেরিকার অর্থনীতি ও জনশক্তিকে নতুন এক প্রাণশক্তিতে বলীয়ান করে গ্রেট ডিপ্রেশন মোকাবেলা করেছিলেন। করোনাকালে বিশ্বময় যে অভাব ধেয়ে আসছে, তার বিপরীতে দেশে দেশে এবং গোটা বিশ্বে নতুন অর্থনৈতিক নীতি ও কর্মসূচী অবলম্বনের বিকল্প কোথায়? শুধু রাষ্ট্রীয় কর্মসূচীতেই আসন্ন মন্দার মোকাবেলা সম্ভব নয়।

এ জন্য সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিক উদ্যোগগুলোও অপরিহার্য। প্রথমত বিলাসী ও অপচয়ী জীবনধারাকে পরিহার করতেই হবে। ভোগবাদের কোনো জায়গা থাকতে পারে না জীবনে ও সমাজে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে এবং সবাইকে বাঁচতে হবে সবার জন্য। জীবন যাপনের ব্যয় সর্বোচ্চ মাত্রায় কমিয়ে আনতে হবে। মোটামুটি ছয় মাসের, কমপক্ষে তিন মাসের একটি প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। নিত্যদিনের খাদ্যসংস্থান যাতে থেমে না যায়। কৃষিজমি, বাড়ীর অতিরিক্ত জমি, এমনকি ছাদ ইত্যাদিকেও কাজে লাগাতে হবে। জমিতে শস্য-সবজি, পুকুরে মাছ চাষে মনোযোগী হতে হবে। হাস, মোরগ বা গবাদিপশু পালনও গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদনমুখী গার্হস্থ্য শিল্পে মনোযোগ দেয়া যায়, সাময়িক ক্ষুদ্র ব্যবসায় এর পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তিতে লাভজনক আত্মনিয়োগও একটি ভালো উপায় হতে পারে।

যে সব উপকরণ ও চাহিদাপূরণ ছাড়া জীবন অচল, সেগুলোতেই যথাসাধ্য সন্তুষ্ট হওয়া শিখতে হবে। যুবশক্তিকে এই কর্মহীনতার মধ্যে ফেলে রাখা হবে আত্মঘাতী। তাদের জন্য আপৎকালীন বিকল্প ও উচিত কর্মসংস্থান খোঁজে নিতে হবে। তা যেমন রাষ্ট্র ও সমাজকে করতে হবে, তেমনি ব্যক্তি ও পরিবারকে উদ্যোগী হতে হবে। ঘরে অবস্থান করে উৎপাদনে নারী ও পুরুষকে এখন আপন সৃজনশীলতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। কিন্তু নিজেদের এই কঠোর সংগ্রামে ভুলে যাওয়া যাবে না সমাজের অক্ষম ও অধিক বিপন্ন অংশটিকে। তাদের পাশে থাকা যেন দু' একদিনের প্রদর্শনীতে আবদ্ধ না থাকে। সেটা যেন হয় নিয়মিত ও দায়িত্বশীল কর্মধারা। দুর্ভিক্ষ না আসুক। কিন্তু সে আসছে। কঠিন এক সময়ের মুখোমুখি দুনিয়ার মানুষ।

-এএ


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ