গত মঙ্গলবার ২৮ জানুয়ারী বাদ ইশা জামেয়া দারুল মা'আরিফে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ‘সাপ্তাহিক সাহিত্য আসর’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এতে উপস্থিত ছিলেন জামেয়ার শীর্ষ-শিক্ষকবৃন্দ।
ছাত্রফোরাম ‘আন নাদী আস-সাক্বাফী’র মহাসচিব মাওলানা আফীফ ফুরকান মাদানির সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট দাঈ মাওলানা এনামুল হক মাদানি।
এছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন জামেয়ার প্রবীণ শিক্ষক, বহুগ্রন্থ প্রণেতা, মাওলানা মোহাম্মদ নূর আনোয়ারী ও তরুণ আলেম মাওলানা মিসবাহ উদ্দীন মাদানি। অনুষ্ঠানের শুরু-শেষ নিয়ে লিখেছেনㅡ আবদুল্লাহ মারুফ।
দারুল মা'আরিফে এসে শুরুর দিনই মুগ্ধ হয়েছি, ছাত্রদের মেধাবিকাশে কতো আয়োজন! 'আন নাদ্বী আস স্বাকাফী' যত্নের সঙ্গে সেগুলো বাস্তবায়ন করে থাকে, মেধার পরিচর্যা করে। আমি বেশ প্রলুব্ধ হচ্ছিলাম কর্মযজ্ঞ দেখে।
সবচে' ভালো লাগছিল দেয়ালপত্রিকাপ্রকাশ কর্মসূচিতে, বিভিন্ন উপলক্ষ্যে তিন ভাষায় দেয়ালপত্র প্রকাশㅡ আরবি ইংরেজি বাঙলা, ভিন্ন ভিন্ন নামে, একাধিক প্রকাশনা। কুরবানিতে বের হয়েছে, স্বাধীনতাদিবসে বের হয়েছে, এখন মাহফিলকে কেন্দ্র করেও জোরেশোরে প্রস্তুতি চলছে। এই কর্মসূচি আমাকে খুব মুগ্ধ করে। আমি আনন্দপ্রকাশ করি বন্ধুদের সঙ্গে।
কিন্তু, ভেতরে দগ্ধ হচ্ছিলাম, ছাত্রকেন্দ্রিক ননান আয়োজন হয়ে থাকে দেয়ালপত্রিকা পর্যন্ত প্রকাশ হচ্ছে, লিখছেও অনেকে; শুধু অনুপস্থিত হাতপাকানোর সঠিক আসরটি! যেখানে লেখা ভাঙা হবে, গড়বে, শব্দের বুনুন, বাক্যগাঁথুনি ইত্যাদি নিয়ে কথা হবে, আলোচনা সমালোচনা হবে, বই পড়া, পাঠ নিয়ে অভিজ্ঞতা, অনুভূতি অনুযোগ; সর্বোপরি একটি আড্ডা হবে।ㅡ এমন কোনওকিছু পাচ্ছিলাম না!
অথচ এখানে, আমি নথিপত্র ঘেঁটে দেখেছি, খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি 'রাবাতায়ে আদবী আল ইসলামি', অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক ইসলামি সাহিত্য সংস্থা'র বাংলাদেশ ব্যুরোর উদযোগে সাহিত্য আসর হতো নিয়মিত। বিখ্যাত কবিসাহিত্যিকগণ আমন্ত্রিত হতেন, অবাক হয়ে দেখিㅡ কবি আল মাহমুদ পর্যন্ত এসেছেন!
যখন মাদরাসাগুলোতে বাঙলাভাষাচর্চা তো দূরে থাক, হাতে কোনো বাঙলাকাগজ থাকলেও ছুঁ মেরে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই তখন, বাংলার উর্দূর উর্বরভূমি এই চট্টলায় দিব্যি বাঙলাসাহিত্যের আসর করেছে জামেয়া দারুল মা'আরিফ! এমনকি, বাঙলাভাষার অন্যতম প্রধানকবিকে আমন্ত্রণ করে অতিথি করেছে, এ কাজটা আর কয়টা মাদরাসায় হয়েছে, আমার জানা নেই।
তো, সেই 'সোনালি অতীত' মুঠোবদ্ধ করে, একবুকে সাহস নিয়ে, হৃদয়ের আবেশ মিশিয়ে একান্ত কাছের লোকদের বলতে লাগলামㅡ 'আবার কি ফিরিয়ে আনা যায় না অতীত, অমন একটি আসর?'
মুবাসশির ভাই এগিয়ে এলেন। আমাকে সাহস যুগিয়ে বললেন, 'উদ্যোগ নেন, আমরা আছি', বলা চলে, মুবাসশির ভাই-ই আমাকে একপ্রকার সঞ্চালন করলেনㅡ এখানে-ওখানে যাওয়া, এই কাজ সেই কাজ, নানান কিছু। মুবাসশির ভাইকে পেয়ে আমার উৎসাহ দ্বিগুণ হলো।
তারপর একদিন বলেই ফেললাম হৃদয়ে পুঞ্জিভূত কথাটাㅡ উস্তাযে মুহতারাম, মাওলানা আফীফ ফুরকান মাদানি সাহেবের কাছে। হুজুরকে তো শুরু থেকেই দেখে আসছি ছাত্রদের প্রতি আন্তরিক, মেধার পরিচর্যায় কতোটা যত্নবান, আজকে পুনরায় জীবন্ত সাক্ষী হলাম। তিনি 'আন নাদ্বী'র পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতাসহ, নিজ থেকেও উৎসাহ যোগালেন।
হুজুরের অনুমতি পেয়ে আমি মুবাসশির ভাইকে সঙ্গে করে এগোতে লাগলাম। তখন, আবদুল্লাহ আল নোমান ভাইকে কাছে পেলাম। তিনি জামেয়ার যাবতীয় অনুষ্ঠানের সঞ্চালক, ছাত্রফোরামের দায়িত্বশীল। তার আন্তরিকতার কথা ভোলা যাবে না।
আমরা দিনক্ষণ নির্ধারণ করলাম, ছাব্বিশ-এক-দু'হাজার বিশ, রবিবার। বাদ ইশা জামেয়ার লাইব্রেরী হলরুমে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে, সকলকে আমন্ত্রণㅡ এরকম একটি ঘোষণাপত্র লিখে মসজিদের বারান্দায় সাঁটিয়ে দিলেন নূরুল আমিন ভাই।
আমরা বেশ কয়েকজন উস্তাযকে দাওয়াত করেছিলাম, সবাই উচ্ছ্বাসিত হয়ে দাওয়াত কবুল করেছিলেন, আসবেন। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, হঠাৎ, হুজুরদের একস্থানে যাওয়ার জরুর তলব আসে। যেহেতু দস্তারবন্দী মাহফিল সামনে, প্রচুর কাজ, অনেকের কাছে যেতে হচ্ছে। আজকে যার কাছে যাচ্ছেন তাকে অনেক দিনতারিখ পরিবর্তনের পর পাওয়া যাচ্ছে।
আমরা এখন কি করবো, উস্তায আফীফ ফুরকান সাহেবের কাছে গেলে তিনি মনখারাপ করে পরিস্থিতিটা বললেন, যেহেতু উদ্বোধনী আসর, আমরা হুজুরদের অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠানটি করতে চাইলাম না। তাই অনুষ্ঠান স্থগিত করে নতুন করে তারিখ নির্ধারণ হলো মঙ্গলবার। তারপর পূর্বের বিজ্ঞপ্তিটি খুলে, রুমে নিয়ে গেলেন মুবাসশির ভাই।
আজকে আছরের পর নতুন আরেকটি বিজ্ঞপ্তি লিখেছে মিজান ভাই, সুন্দর হস্তাক্ষরসহ চমৎকার একটি বই, একটি কলমের নিব এঁকে ফুটিয়ে তুলেছে ঘোষণাপত্রটি। এটি রবিউল ইসলাম ভাই ইশার আগে মসজিদে লাগিয়ে এসেছেন। এখন শুধু প্রতীক্ষা, সেই মধুরক্ষণটির।
দুই.
মঙ্গলবার দিন ইশার নামাজের পর লাইব্রেরী হলরুমে যাই, মুবাসশির ভাই ইতোমধ্যে হলরুম খুলে ব্যানার টানিয়ে মোটামুটি একটা প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে। আবদুল্লাহ আল নোমান ভাই অতিদ্রুত এই ব্যানারটি করিয়ে এনেছে, তিনি এই অনুষ্ঠান সফল করতে আন্তরিকভাবে খেটেছেন, আমাদেরকে সহযোগিতা করেছেন। এইগুলো তো হৃদয়ে দাগ ফেলে, এই হৃদ্যতাগুলো মুছে ফেলা যায় না।
যাহোক, আমি এখানে আরও কিছু নাম তুলতে চাই, কাজী ওলি, মাসুম, নাঈম, আনিস, আবরার, নোমান, আবদুর রহমান, মুজীবভাইসহ ছোটোবড়ো সাহিত্যসারথি অনেক বন্ধু আমাদেরকে হেল্প করেছে নানাভাবে, তাদেরকে কৃতজ্ঞতা।
আমি হলরুমে প্রবেশ করে মুগ্ধ হই, সবগুলো চেয়ার পূর্ণ। এমনকি নির্ধারিত চেয়ার ছাড়াও অনেকদূর পর্যন্ত খোলা চেয়ার নিয়ে বসেছে বন্ধুরা, দেখে ভালো লাগে।
কিছুক্ষণ পর মাহফুজ ভাই অনুষ্ঠান শুরু করেন। কুরআনুল কারীম তিলাওয়াত হয়, হামদনাত হয়, এবং কবিতা আবৃত্তিও হয়ে যায় একটা। ইতোমধ্যে আসনগ্রহণ করেছেন জামেয়ার প্রবীণ উস্তায, বিশিষ্ট লেখক, মাওলানা মোহাম্মদ নূর আনোয়ারী সাহেব। চেয়ে দেখি দরজা দিয়ে প্রবেশ করছেন মাওলানা মিসবাহ উদ্দীন মাদানি সাহেব হুজুরও। এরপর তো এসেছেন আজকের প্রধানঅতিথি, সভাপতি সাহেব।
অনুষ্ঠান চলতে থাকে, আবৃত্তির পর প্রবন্ধপাঠ হয়। মুক্তো আলোচনা হয়। এবং ফাঁকেফাঁকে সমালোচনা বা অনুভব অনুভূতির সুযোগও থাকে, উপস্থিত যেকেউ আসতে পারে। এভাবে ছাত্রদের পর্ব শেষ হয়।
অতিথিদের পর্বে মাওলানা মোহাম্মদ নূর আনোয়ারী সাহেব আনন্দপ্রকাশ করেন আজকের এই আয়োজনে। তিনি বলেন, 'আরো আগেই এরকম অনুষ্ঠান করার দরকার ছিলো। দেরিতে হলেও 'আন নাদ্বী আস স্বাকাফী' এরকম একটা উদ্যোগ নেয়ায় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই।'
প্রধানঅতিথির বক্তব্যে মাওলানা এনামুল হক মাদানি সাহিত্যচর্চার গুরুত্ব তুলে ধরে আমাদের সাহিত্যচর্চা কেমন হবে তার একটি ফর্মুলা দেন, রোডম্যাপ দেখান। আর সাহিত্য আসর সম্পর্কে বলেন, 'নব্বইয়ের দশকে মাওলানা উবায়দুর রাহমান খান নদভী সাহেব থাকা কালে আমরা এরকম সাহিত্য আসর করতাম। মাঝখানে অনেক বৎসর হয় নি, আবার শুরু হচ্ছে দেখে খুশি লাগছে।'
মাওলানা মিসবাহ মাদানি সাহেব তার বক্তব্যে সাহিত্যের প্রাথমিক ছাত্রদের জন্য ভাষা শেখার প্রাথমিক দিকগুলো আলোচনা করে, সুখপাঠ্য লেখার কৌশলগুলো উপস্থাপন করেন।
তিনি বলেন, 'সাহিত্যচর্চার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারণ শেখাও জরুরি, শ্রোতাদেন কান উৎকর্ণ করার যোগ্যতাও একজন লেখককে অর্জন করতে হবে।'
তিনি পরামর্শ দেন, 'মক্তবের শিশুরা যেভাবে বর্ণ শিখে, আমাদেরকেও সেভাবে বাঙলাভাষার বর্ণগুলো ধরে ধরে উচ্চারণ শিখতে হবে। তার মতে, 'যারা প্রাথমিক সাহিতের ছাত্র, তারা স্কুলের বাঙলা বইগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়বে, সেখানে বিশিষ্ট কবিসাহিত্যিকদের নির্বাচিত রচনা থাকে, কী পড়ব এসব ভেবে সময় নষ্ট না করে কেউ যদি সেগুলো যত্ন নিয়ে পড়ে, তাহলেও তার অনেক উপকার হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'অভিধান থেকে শব্দ মুখস্থ না করে, পাঠের পরিধি বাড়িয়ে বই থেকে শব্দ শিখতে হবে। লেখায় শব্দগাঁথুনি, ভাষার প্রতিস্থাপন শিখতে হলে ভালো লেখকদের প্রচুর বই পড়তে হবে।'
পাঠের বিকল্প নেই, পড়তে হবেই, কিন্তু সেই পড়া যেনো একাডেমিক পাঠের কোনও ক্ষতি না করে; সেজন্য সমাপ্তিবক্তব্যে অনুষ্ঠানের মূলস্পন্দন মাওলানা আফীফ ফুরকান মাদানি বলেনㅡ 'জামেয়া দারুল মাআরিফের মূল ভিশন ভালো আলেম তৈরি করা, আরবিতে দক্ষ করা।
এখান থেকে যদি একজন লেখকও না বেরোয় আমাদের প্রতি কেউ ভ্রুকুঞ্চন করবে না; কিন্তু ভালো আলেম যদি না হয়, তাহলে আমাদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাই, তোমরা সাহিত্যচর্চা করো মৌলিক পড়াশোনাগুলো ঠিক রেখে।'
এরপর অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা হয়, শেষ হবার আগে মুবাসশির ভাই সাহিত্য আসরের নির্ধারিত দিনক্ষণ বর্ণনা করেন। তারপর আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়।
এই অনুষ্ঠান করতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে, অনেককে পাশে পেয়েছি। আমার খুব ভালো লেগেছে ! দুআ করি, এর ধারাবাহিতা টিকে থাকুক!
লেখক: শিক্ষার্থী, জামেয়া দারুল মা'আরিফ, চট্টগ্রাম।
আরএম/