মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫ ।। ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ ।। ৬ মহর্‌রম ১৪৪৭


চলে গেলেন হৃদয়রাজ্যের আরেক বাদশা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

জহির উদ্দিন বাবর।।

অনেক দিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তিও ছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে নিয়মিতই খরব পাওয়া যাচ্ছিল। অবশেষে চলেই গেলেন না ফেরার দেশে। গতকাল ৯ অক্টোবর দেশের শীর্ষ আলেমদের মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিলেন ‘বরুণার পীর সাহেব’ খ্যাত মাওলানা খলিলুর রহমান হামিদী রহ.। করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও হৃদয়ভেজা কান্না এবং শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দিয়ে লাখো মানুষ তাঁকে জানালো শেষ বিদায়। তাঁর এই চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে শূন্য হলো আরও একটি বিশাল জায়গা। প্রাকৃতিক নিয়মে সেখানে হয়ত অন্য কেউ বসবেন, কিন্তু সেই শূন্যতা কি কখনও পূরণ হওয়ার মতো? এভাবেই অভিভাবকতুল্য আলেমদের চলে যাওয়ার মিছিল দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। আর এতে বাড়ছে শূন্যতা ও হাহাকার। ঘনীভূত হচ্ছে সমস্যা ও সংকট।

শায়খ খলিলুর রহমান হামিদী রহ. বরুণার পীর সাহেব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মৌলভীবাজারসহ বৃহত্তর সিলেটে ছিল তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ও প্রভাব। জাতীয় পর্যায়েও পরিচিত ছিলেন। জাতীয় প্রতিষ্ঠান বেফাকে দায়িত্বে ছিলেন সহসভাপতির। আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের আমিরের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘকাল। বাবার প্রতিষ্ঠিত জামিয়া লুৎফিয়া আনওয়ারুল উলুম মাদরাসার মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেছেন পাঁচ দশকের বেশি সময়। মৌলভীবাজারের বিখ্যাত এই দীনি প্রতিষ্ঠানটির শায়খুল হাদিস পদও তাঁর দ্বারা অলঙ্কৃত হয়েছিল। একজন খাঁটি আল্লাহর ওলি ও পরিশুদ্ধ মানুষ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি ছিল।

বৃহত্তর সিলেটে বর্ণভী খান্দারের প্রভাবের কথা সবার জানা। পাশাপাশি ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসব এলাকায়ও রয়েছে এই পরিবারের ব্যাপক নামডাক ও প্রভাব। মাওলানা খলিলুর রহমান হামিদী রহ. এবং তাঁর ছোটভাই মাওলানা রশীদুর রহমান ফারুককে সবাই জন্মসূত্রে আল্লাহর ওলি হিসেবে জানে। তাদের নাম উচ্চারণেই সবার মধ্যে ভক্তি ও শ্রদ্ধার অনন্য এক অবস্থা বিরাজ করে। তাদের একটু দোয়া, একটু নির্দেশনা পেতে আকুল হয়ে থাকে হাজারও মানুষ। দল-মত নির্বিশেষে প্রভাবশালী-ক্ষমতাবানরাও ভিড় করেন এই দরবারে। এমন বিতর্কহীন, পরিশুদ্ধ ও স্বচ্ছ ইমেজের আধ্যাত্মিক রাহবার সচরাচর খুব একটা দেখা যায় না। তাদের প্রতি মানুষের এই মুগ্ধতা ও ভালোবাসা নিঃসন্দেহে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিশেষ দান।

শায়খ খলিলুর রহমান হামিদী রহ.কে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ হয়ে উঠেনি। বেশ কয়েক বছর আগে একবার ঢাকার মাদরাসা দারুর রাশাদে এসেছিলেন, তখন কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। কিছু মূল্যবান নসিহতও শোনার সুযোগ হয়েছিল। সেই সফরে তাঁর ছেলে লন্ডন প্রবাসী মাওলানা নুরে আলম হামিদী ভাইও সঙ্গে ছিলেন। তাঁকে দেখে আপাদমস্তক একজন খাঁটি ওলি মনে হয়েছে। দীনের পাশাপাশি দুনিয়া সম্পর্কেও যে তিনি যথেষ্ট সচেতন সেটাও মনে হয়েছে। সময়ের প্রয়োজনে আলেমদের কী কী খেদমত করা উচিত বা জরুরি সে সম্পর্কে অত্যন্ত মূল্যবান আলোকপাত করেন। মুগ্ধতা নিয়ে সেদিন তাঁর কথাগুলো শুনেছিলাম, যা আজও কানে বাজে। পরবর্তী সময়ে অনেকের কাছ থেকে তাঁর এবং ঐতিহ্যবাহী এই পরিবারের অনেকের গল্প শোনার সুযোগ হয়েছে। একদিকে দীনের সহিহ ধারা এবং অপরদিকে যুগচাহিদা বোঝা- এই দুটি গুণের অনন্য সমন্বয় দেখেছি শায়খে বরুণা রহ.-এর মধ্যে। প্রত্যান্ত অঞ্চলের বরুণা মাদরাসা সময়ের চাহিদাকে যতটা গুরুত্ব দিয়েছে বা দিচ্ছে সেটা খুব কম মাদরাসাতেই চোখে পড়ে। রুচি-বৈচিত্র্য ও উন্নত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ঐতিহ্যবাহী দীনি এই প্রতিষ্ঠানটি একটি জায়গায় অবস্থান করছে।

মাওলানা খলিলুর রহমান হামিদী রহ.-এর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। গোটা জীবনটাই কাটিয়েছেন তালিম, তরবিয়ত ও আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্যে। দীনের জন্যই ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন পুরোটা জীবন। জামিয়া লুৎফিয়া পরিচালনা করেছেন প্রায় পাঁচ দশক। এই সময়ে তিনি দীনি প্রতিষ্ঠানটিকে উন্নতি ও খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। পাশাপাশি আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মাধ্যমে বহু দীনি, দাওয়াতি ও সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডও আঞ্জাম দিয়েছেন। বিশেষ করে সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী দীনি খেদমতের নানা অঙ্গনে ভূমিকা রেখে তিনি সমসাময়িক বুজুর্গ আলেমদের মধ্যে অনন্য হয়ে আছেন।

মূলত শায়খ খলিলুর রহমান হামিদী রহ. যুগোপযোগী দীনি খেদমতের চেতনা লাভ করেন তাঁর বাবা খলিফায়ে মাদানী মাওলানা লুৎফুর রহমান শায়খে বর্ণভী রহ.-এর কাছ থেকে। শায়খে বর্ণভী রহ. বিগত শতাব্দীর সেই চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে দীনের গতিশীল যে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন সেটা পরবর্তী সময়েও খুব কম আলেমই দিতে সক্ষম হয়েছেন। ছদর সাহেব আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.-এর সমসামিয়ক ছিলেন বর্ণভী রহ.। এই দুজনই ছিলেন বাঙালি আলেমদের মধ্যে অগ্রসর চিন্তার অধিকারী। সেই চল্লিশের দশকে শায়খে বর্ণভী রহ.-এর মাথায় এসেছিল ইসলামি এনজিও টাইপের কিছু একটা করার বিষয়টি। সেই তাগিদ থেকেই তিনি গড়ে তুলেন আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম। ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামে সংস্কার ও সেবামূলক এই সংগঠনটি কাজ করে আসছে সাত দশকের বেশি সময় ধরে। কিন্তু ২০১০ সালে হাটহাজারী থেকে প্রতিষ্ঠা লাভ করা ব্যাপক আলোচিত সংগঠন ‘হেফাজতে ইসলাম’ এই সংগঠনটিকে অনেকটা ম্রিয়মান করে দেয়। যতদূর জানি, এই সংগঠনের পক্ষ থেকে তখন একটি প্রতিনিধি দল গিয়েছিল হাটহাজারীতে নামের ব্যাপারে বিবেচনার অনুরোধ নিয়ে। যদিও তাদের সেই অনুরোধ পাত্তা পায়নি এবং তারাও দীনের স্বার্থে বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করেননি। আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম নামে বরুণা মাদরাসাকেন্দ্রিক সংস্থাটির ব্যাপক কার্যক্রম এখনও চলমান।

মূলত শায়খে বর্ণভী রহ. ছিলেন একজন মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক। শাইখুল আরব ওয়াল আজম হজরত হোসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর বিশিষ্ট এই খলিফা গতানুগতিক আলেমদের চেয়ে ভিন্নভাবে চিন্তা করতেন। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন থেকে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও তিনি ভূমিকা রেখেছেন। যখন আলেম-উলামা বাংলা ভাষা চর্চাকে অনেকটা নাজায়েজ বা ঘৃণিত কাজ মনে করতেন তখন তিনি বাংলা চর্চা করেছেন। তাঁর রচিত মরমী কবিতা ‘মুনাজাতে মকবুল’ আজও বেশ সমাদৃত। এটি পড়লে যে কারও অন্তর বিগলিত হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে মোনাজাতকে আবেগঘন ও ভাবগাম্ভীর্যময় করতে শায়খে বর্ণভী রহ. রচিত পংক্তিগুলো পাঠ করা হয়। স্বাধীনতার পরপরই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মাসিক হেফাজতে ইসলাম পত্রিকা। সেই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে থেকেও অর্ধশতাব্দী বছর আগে এমন উন্নত ভাবনা ভাবার মতো আলেম বাংলাদেশের ইতিহাসে খুব কমই আছেন।

বাবার কাছ থেকে আধ্যাত্মিক গুণগুলো লাভের পাশাপাশি তাজদিদি গুণটিও অর্জন করেছিলেন শায়খ খলিলুর রহমান হামিদী রহ.। তাঁর বাবার সূচিত ব্যতিক্রমী ও সেবামূলক কাজগুলো তিনি অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যান। তাঁর সেই ধারা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও বিস্তৃত হয়েছে। শায়খে বর্ণভী রহ.-এর পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যরা আজ সময়ের প্রয়োজনে দেশে-বিদেশে ব্যাপক খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন। গতানুগতি দরস-তাদরিসের বাইরেও মিডিয়া ও মানবসেবায় তারা ভূমিকা রাখছেন। ব্রিটেনে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে তাদের ব্যাপক সুনাম ও খ্যাতি রয়েছে। অগ্রসর এই ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা এবং সময়ের প্রয়োজন বিবেচনা করে খেদমতের যে স্পৃহা সেটা অব্যাহত থাকলে ইনশাআল্লাহ এর দ্বারা দীন ও ইসলাম ব্যাপক উপকৃত হবে। আল্লাহ তাদেরকে সেই তাওফিক দিন।

ইসলামি ও কওমি অঙ্গনের জন্য ২০২০ সালটি শুধুই হারানোর বছর। দেশের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক আলেম চলতি বছর চলে গেছেন না ফেরার দেশে। এর আগে অল্প সময়ের ব্যবধানে এতোগুলো আলেম বিদায় নিয়েছেন এমনটা মনে পড়ে না। সত্যিই বিষয়টি আমাদের জন্য দুর্ভাবনা, উদ্বেগ ও শঙ্কার। কারণ আলেমের মৃত্যু সাধারণ কোনো মৃত্যু নয়। একজন হাক্কানি আলেমের চলে যাওয়া সাধারণ কোনো চলে যাওয়ার মতো নয়। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী আলেমের মৃত্যু আলমের (জগতের) মৃত্যু। তাহলে চলতি বছরে আমরা শীর্ষস্থানীয় এতো আলেমকে হারিয়েছি যে, আমাদের কতটি জগত ফাঁকা হয়ে গেছে সেটার হিসাব কষা কঠিন। চলে যাওয়া এই মহান মানুষেরা ছিলেন জনসাধারণের দীন ও ঈমানের সংরক্ষক। তাঁরা ছিলেন মানুষের হৃদয়রাজ্যের বাদশা। তাদের বিদায়ের মিছিল যত দীর্ঘ হচ্ছে আমাদের সামনে সংকট তত ঘনীভূত হচ্ছে। একমাত্র আল্লাহই পারেন আমাদেরকে সেই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম

-এএ


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ