বিশেষ প্রতিনিধি
এবারের নির্বাচনে ইসলামি ও সমমনা আটটি দল প্রতি আসনে ‘একটি বাক্স’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দলগুলো আসন সমঝোতার কাজ করছে। এ লক্ষে একটি লিয়াজোঁ কমিটি করা হয়েছে। সেই কমিটি দফায় দফায় বৈঠক করে অনেকদূর এগিয়েছে। তবে কিছু আসনের ব্যাপারে একাধিক দল অনড় অবস্থানে থাকায় দেখা দিয়েছে জটিলতা। আসন সমঝোতা নিয়ে সৃষ্ট জট কাটাতে এবার বসছেন দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। সেখান থেকে একটি সমাধান আসতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। সেটি চলতি সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মাস-দুয়েক একসঙ্গে আন্দোলন করার পর জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ ইসলামি ও সমমনা আটটি দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবারের নির্বাচনে ‘একবাক্স’ নীতি প্রয়োগ করবে। এতে বিএনপির বিপরীতে একটি শক্তিশালী বলয় গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলে মনে করছে দলগুলো। তবে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আসন সমঝোতা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে দলগুলো। ইতোমধ্যে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন সব আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। অন্য দলগুলোও বেশির ভাগ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। এই অবস্থায় কাকে রেখে কাকে বাদ দেবে-এটা নিয়ে রীতিমতো ঘাম ঝরছে দলগুলোর দায়িত্বশীল নেতাদের।
লিয়াজোঁ কমিটি আসন সমঝোতার বিষয়টি অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে এসেছে। তবে কিছু আসন নিয়ে জটিলতাও আছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে চাচ্ছে না। এই অবস্থায় বিষয়টি সুরাহা করার জন্য আট দলের শীর্ষ নেতারা বৈঠকে বসছেন। আজ মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) তাদের বৈঠক হতে পারে বলে সূত্রে জানা গেছে। শুধু আজই নয়, তারা এই ইস্যুতে একাধিক দিন বৈঠক করতে পারেন।
আসন সমঝোতা ও প্রার্থী চূড়ান্ত করা নিয়ে গত ৯ ডিসেম্বর থেকে দফায় দফায় রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছে আট দলের লিয়াজোঁ কমিটি। তারা ইতোমধ্যে প্রাথমিক প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ গুছিয়ে এনেছেন। যেসব আসনে একাধিক দল তাদের প্রার্থীকে সম্ভাবনাময় বলে মত দিয়েছে, সেসব আসনসহ চূড়ান্ত প্রার্থী বাছাইয়ের কাজটি করবেন আট দলের প্রধান নেতারা।
এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনূস জানান, ইতোমধ্যে দলগুলোর মহাসচিব পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। সেখানে প্রার্থী বাছাই করা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। যে আসনে যার সম্ভাবনা বেশি, তাকেই চূড়ান্ত সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে বাছাইয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এরপরেও এমন কিছু আসন রয়েছে, যেখানে একাধিক দলের প্রার্থীর সম্ভাবনা আছে। এমন কিছু আসন এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের বাইরে রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দিন আহমদ আওয়ার ইসলামকে বলেন, এখানো বলার মতো পর্যায় আসেনি। আমরা পরস্পর বসছি। কোন কোন জায়গায় একাধিক প্রার্থী আছেন জেতার মতো সেগুলো চিহ্নিত করেছি। আমাদের শীর্ষ নেতারা বসে বিষয়গুলো চূড়ান্ত করবেন। আমরা চেষ্টা করছি, যত দ্রুত সম্ভব কাজটি শেষ করার।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন পরিসংখ্যানের কথা নাকচ করে দিয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব বলেন, আসলে কোন দল কতটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে সেটা ওই দলের শীর্ষ দুই-চারজন নেতার বাইরে অন্য কেউ জানে না। এসব বিষয় আগেই ফাঁস হয়ে যাক সেটা আমরা চাই না। এতে ঐক্যে চিড় ধরবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদও আওয়ার ইসলামকে জানান, আলোচনা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এখনই কোনো বিষয় গণমাধ্যমে বলার মতো হয়নি। তিনি জানান, সর্বোচ্চ আসনে ছাড় পাওয়ার চেষ্টা থাকবে তাদের। কেননা বেশি আসনে নির্বাচন করতে পারলে প্রাপ্ত ভোটে উচ্চ কক্ষে পিআর পদ্ধতির কারণে এর সুফল মিলবে। তবে যেকোনো মূল্যে ঐক্য প্রক্রিয়া যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে তাদের দৃষ্টি থাকবে।
আট দলে থাকা দলগুলো হলো—বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি।
এসব দলের মধ্যে ঐক্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয় কয়েক মাস আগে। শুরুতে কয়েকটি দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে একমত হয় আট দল। সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে আলোচনার পাশাপাশি পাঁচ দফা দাবিতে মাঠে নামে তারা। এর ভেতর একসঙ্গে নির্বাচনের ব্যাপারে দলগুলো সম্মত হয়। তবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে অন্যান্য দলের আদর্শগত কিছু বিরোধ থাকায় তারা এটাকে জোট বলতে নারাজ। নির্বাচনি সমঝোতা বা মোর্চা বলে আখ্যায়িত করতে চান তারা। প্রতি আসনে যে দলের প্রার্থী জয়ী হয়ে আসার সম্ভাবনা বেশি তাকেই মনোনয়ন দেওয়ার ব্যাপারে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে দলগুলো।
সূত্রে জানা গেছে, আসন সমঝোতার প্রশ্নে দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী নিজেদের কাছে বেশির ভাগ আসন রাখতে চায়। ইসলামী আন্দোলনও নিজেদেরকে জামায়াতের কাছাকাছি আসনের ভাগিদার মনে করে। অন্যান্য দলগুলোও নিজেদের সক্ষমতার চেয়ে বেশি আসনের দাবি করে বসে। ফলে কোন দল কতটি আসনে লড়বে এটা ঠিক করতেই বড় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
আবার কিছু আসন নিয়ে বেঁধেছে বিপত্তি। সেসব আসনে একাধিক দলের হেভিওয়েট প্রার্থী রয়েছেন। সবাই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাপারে অনড়। এজন্য দলের শীর্ষ নেতারা বসে কোন দল কতটি আসনে লড়বে সেটা চূড়ান্ত করবেন। পাশাপাশি যেসব আসনে জটিলতা দেখা দিয়েছে সেগুলোর ব্যাপারেও সুরাহা করবেন।
এদিকে আট দলের নেতাকর্মীরা অধীর আগ্রহে বসে আসেন চূড়ান্ত ঘোষণা শোনার জন্য। অনেক প্রার্থী প্রচার-প্রচারণা সীমিত করে দিয়েছেন। কেননা আসন সমঝোতা হলে কয়েক শ প্রার্থীকে বৃহৎ স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ভোটের লড়াই থেকে বিরত থাকতে হবে। এজন্য চূড়ান্ত তালিকায় নাম আসার আগে কেউই পুরোদমে প্রচার-প্রচারণা চালাতে চাচ্ছেন না।
প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করতে দেরি হওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাসছে নানা গুজব। কেউ কেউ বিভিন্ন তালিকা করেও ছেড়ে দিচ্ছে। এতে বিভ্রান্তি দেখা দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ ভেতরের খবর পেয়ে অন্য দলকে ইঙ্গিত করে আক্রমণাত্মক পোস্টও করছেন। এজন্য দলগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আসন সমঝোতার বিষয়টি আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। এখনো এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এজন্য কোনো গুজবে কান না দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে।
আরএইচ/