শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ।। ১০ পৌষ ১৪৩২ ।। ৬ রজব ১৪৪৭

শিরোনাম :
ইসলামপন্থীদের ‘একবাক্স নীতি’ কি মুখ থুবড়ে পড়ছে? শহীদ হাদির আদর্শ সামনে রেখে মিশরে 'আজহার আফকার'র যাত্রা আবারও বাংলাদেশি সন্দেহে ভারতে মুসলিম যুবককে পিটিয়ে হত্যা তারেক রহমানের দেশে ফেরা গণতান্ত্রিক সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন: হাসনাত ঢাকায় মহাসমাবেশের ঘোষণা ইসলামী আন্দোলনের এভারকেয়ার থেকে গুলশানের বাসার উদ্দেশে তারেক রহমান সাহিত্য সভায় বিশেষ সম্মাননা পেলেন কবি ও লেখক মোহাম্মদ কুতুবউদ্দিন মহানবী (সা.)-এর ন্যায়পরায়ণতার আলোকে দেশ পরিচালনা করবো: তারেক রহমান ১ জানুয়ারি শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে যা বললেন পীর সাহেব চরমোনাই

শিক্ষক মানবতার নির্মাতা ও সমাজগঠনের দিশারী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

||তৌফিক সুলতান||

শিক্ষক—একটি ছোট শব্দ হলেও এর গভীরে নিহিত রয়েছে সভ্যতার ভিত্তি, মানবতার আলো এবং জাতির আত্মা। শিক্ষক কেবল পাঠদাতা নন; তিনি মানুষ গড়ার শিল্পী, সমাজের নৈতিক দিকনির্দেশক ও জাতির নির্মাতা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—প্রতিটি উন্নত জাতির উত্থানের পেছনে ছিলেন একদল আলোকিত শিক্ষক, যারা জ্ঞান, চিন্তা ও নৈতিকতার আলো ছড়িয়ে প্রজন্মকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন।

একজন প্রকৃত শিক্ষক জ্ঞানের চেয়ে অনেক বড় কিছু দান করেন। তিনি শেখান কীভাবে চিন্তা করতে হয়, কীভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং কীভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়। প্রাচীন দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, “শিক্ষক কখনো জ্ঞান ঢেলে দেন না; বরং শিক্ষার্থীর অন্তরে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে দেন।” ইসলামও শিক্ষককে দিয়েছে সর্বোচ্চ মর্যাদা। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন, “আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে ও জ্ঞান অর্জন করেছে, তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।” (সূরা আল-মুজাদিলা: ১১)। নবী করিম (সা.) বলেছেন, “আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।” অর্থাৎ শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়, এটি এক নবুওয়াতের দায়িত্ব—মানুষকে আলোর পথে আহ্বান করার মহৎ দায়িত্ব।

ইসলামের ইতিহাসে শিক্ষকের মর্যাদা অনন্য উচ্চতায়। হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, “যে আমাকে এক অক্ষর শিখিয়েছে, সে আমার শিক্ষক, আর আমি তার দাস।” নবী করিম (সা.) বলেছেন, “যে জ্ঞান বিতরণ করে, তার প্রতিদান চলবে মৃত্যুর পরও।” অর্থাৎ একজন শিক্ষক মৃত্যুর পরও তাঁর শিক্ষার আলোয় জীবন্ত থাকেন। তাঁর প্রতিটি শিক্ষা ও আদর্শ পরবর্তী প্রজন্মের চিন্তা ও চরিত্রে প্রতিধ্বনিত হয়। তাই বলা যায়, একজন প্রকৃত শিক্ষক কখনো মরে না; তিনি তাঁর জ্ঞানের আলোয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বেঁচে থাকেন।

বাংলাদেশে শিক্ষকতার ঐতিহ্য সুদীর্ঘ ও গৌরবময়। প্রাচীন গুরুকুল পদ্ধতি থেকে শুরু করে মাদ্রাসা, পাঠশালা ও আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক ছিলেন সমাজের জ্ঞান ও নৈতিকতার মিশ্রণ ঘটানো এক আলোকিত পথপ্রদর্শক। একসময় শিক্ষক ছিলেন সমাজের শ্রদ্ধার আসনে, ছিলেন গ্রামের বিচারক, উপদেষ্টা ও নৈতিক অভিভাবক। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে শিক্ষাব্যবস্থা বাণিজ্যিক হয়ে ওঠায় শিক্ষকের সেই সামাজিক মর্যাদা কিছুটা ক্ষীণ হয়েছে। কোচিং সংস্কৃতি, পরীক্ষানির্ভর প্রতিযোগিতা ও পেশাগত অনিশ্চয়তা শিক্ষকদের এক কঠিন বাস্তবতার মুখে ফেলেছে। তবুও শিক্ষকরা নীরবে, আত্মনিবেদন ও ত্যাগের মনোভাব নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তুলছেন।

বিশ্ব ইতিহাসে মহান শিক্ষকদের অবদান চিরস্মরণীয়। সক্রেটিস সত্যের জন্য জীবন দিয়েছেন, কনফুসিয়াস মানবতার শিক্ষা দিয়েছেন, ইমাম গাজালী জ্ঞানের সঙ্গে আত্মশুদ্ধির সমন্বয় ঘটিয়েছেন, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষাকে যুক্ত করেছেন স্বাধীন চিন্তা ও মানবিকতার সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, “শিক্ষক জাতির মেরুদণ্ড।” এই উক্তি কেবল প্রশংসা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য—কারণ শিক্ষক ছাড়া জাতি দাঁড়াতে পারে না।

একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীর জীবনে যে পরিবর্তন আনতে পারেন, তা কোনো বই বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়। একটি উৎসাহব্যঞ্জক বাক্য, একটি ন্যায্য সিদ্ধান্ত কিংবা একটি সৎ আচরণ—এসব একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে। গবেষণা বলছে, শিক্ষকের মনোভাব ও চরিত্র শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস, ন্যায়বোধ ও নেতৃত্বগুণ বিকাশে নির্ধারক ভূমিকা রাখে। তাই বলা হয়, “একজন শিক্ষক শত রাজনীতিবিদের চেয়ে বেশি জাতি গঠন করতে পারেন।”

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় তেরো লক্ষাধিক শিক্ষক প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার আলোকবর্তিকা হয়ে কাজ করছেন। কিন্তু তাদের অনেকেই ন্যায্য বেতন, পেশাগত নিরাপত্তা ও সম্মান থেকে বঞ্চিত। সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যেও তারা নিবেদিত প্রাণ হয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গঠনে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তাদের আত্মত্যাগই আজ শিক্ষাক্ষেত্রকে টিকিয়ে রেখেছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের মর্যাদা পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ। প্রথমত, সকল স্তরের শিক্ষকদের আধুনিক প্রশিক্ষণ ও নৈতিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ন্যায্য বেতন, আর্থিক নিরাপত্তা ও চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। তৃতীয়ত, সমাজে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনতে গণমাধ্যম, পরিবার ও রাষ্ট্রের যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মধ্যেও শিক্ষককে সম্মান করার মানসিকতা গড়ে তোলা জরুরি।

শিক্ষক কেবল পাঠদান করেন না—তিনি শেখান কীভাবে মানুষ হতে হয়, কীভাবে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকতে হয়, এবং কীভাবে মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করতে হয়। শিক্ষক সমাজের বিবেক, জাতির আলোকবর্তিকা। তাই শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা মানে নিজের ভবিষ্যৎকে সম্মান করা। কারণ সৈনিক দেশ রক্ষা করে, কিন্তু শিক্ষক সেই দেশকে গড়ে তোলেন।

আজকের বিশ্বে যখন নৈতিকতা, মানবতা ও আদর্শের সংকট বাড়ছে, তখন প্রকৃত শিক্ষকই হতে পারেন সমাজ পরিবর্তনের অনুপ্রেরণা। শিক্ষক হলেন মানবতার নির্মাতা, সমাজগঠনের দিশারী এবং জাতির আত্মা। তাই বলা যায়, “যেখানে শিক্ষককে সম্মান করা হয়, সেখানেই সভ্যতা টিকে থাকে।”

এনএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ