শুধু দেশ নয়, দুনিয়া কাঁপানো জুলাই আন্দোলনের সামনের সারির একজন যোদ্ধা ছিলেন ইব্রাহীম নীরব। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনের কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। গত জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে ছাত্রলীগের হামলায় তিনি মৃত্যু পথযাত্রী ছিলেন। ভাগ্যগুণে বেঁচে গিয়েছিলেন। তখন অবশ্য ছড়িয়ে পড়েছিল, তিনিই জুলাই আন্দোলনের প্রথম শহীদ। জুলাইয়ের সেই দিনগুলো নিয়ে আওয়ার ইসলামের মুখোমুখি হয়েছেন ইব্রাহীম নীরব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: শাব্বির আহমাদ খান।
আওয়ার ইসলাম: আপনার জুলাই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার উদ্দেশ্য কী ছিল?
ইব্রাহীম নীরব: প্রথমত এটা জুলাই আন্দোলন নয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থান—যা ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সম্মিলিত অংশগ্রহণে ঘটেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দীর্ঘ অর্ধযুগের ইতিহাস রয়েছে আমার। যখনই কোথাও অন্যায়, অনিয়ম, অবিচার, দুর্নীতি দেখেছি প্রতিবাদ করে গেছি। ২০২৪ এর জুন মাসে যখন তৎকালীন ফ্যাসিবাদী সরকার ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করে কোটাপ্রথা পুনর্বহাল করে, তার বিরুদ্ধেই মূলত আমাদের অংশগ্রহণ ছিল। আমরা মেধার ভিত্তিতে যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতে চেয়েছি যেন কোনো বৈষম্য না হয়।
আন্দোলনের সময় আমার স্টেটমেন্ট যা ছিল তা পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলে দিচ্ছি-
‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনীদের কেন কোটা দেওয়া হবে? এটার কোনো যৌক্তিক কারণ দেখান তাহলে আমি মেনে নিবো। আর না হয় আমি একে বেশ্যা কোটা ঘোষণা করলাম। লক্ষ লক্ষ ছেলে মেয়ে বেকার হয়ে ঘুরতেছে। প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুযায়ী ২২ লক্ষ+ শিক্ষার্থী বেকার। শিক্ষা শেষে সকলের নিশ্চিত চাকরি চাই, চাকরি চাই। বৈষম্য করে পাকিস্তান আমলের মতো বাংলাদেশ চাই না। সরকারি চাকরির সকল গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্য মূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য কোটাকে ন্যায্যতার ভিত্তিতে নূন্যতম পর্যায়ে এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতিকে সংস্কার করতে হবে।’
আওয়ার ইসলাম: আপনি কেন জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন?
ইব্রাহীম নীরব: চোখের সামনে অন্যায় ঘটবে আর আমি চুপ থাকবো, এটা আমি পারি না। নৈতিক ও আদর্শিক কারণেই আমি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলাম। তাছাড়াও ফ্যাসিস্ট হাসিনার রেজিমে বিভিন্ন সময়ে হামলা-মামলার শিকার হয়েছিলাম, ফলত তাদের প্রতি একপ্রকার কঠিন ঘৃণা জন্মেছিল।
যদিও আমি আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলাম, মূলত অংশ নিই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ও প্রথম সারির সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ ভাইয়ের অনুরোধে। তার অনুরোধেই সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একত্রিত করার দায়িত্ব হাতে নিই। আন্দোলন চলাকালীন ১৮ জুলাই আমাকে গুম করার আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমি আলাদা আলাদা ৫ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সমন্বিত করেছিলাম।
ঢাকায় যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাওয়ার উপক্রম, তখন সারা বাংলাদেশে আন্দোলনের দাবানল জ্বালিয়ে তুলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর দুর্বার শিক্ষার্থীরা।
আওয়ার ইসলাম: যে চাওয়া থেকে জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, সেই চাওয়া কি আজও পূর্ণ হয়েছে?
ইব্রাহীম নীরব: আমাদের যেসব দাবি ছিল তা বাস্তবায়ন করতে হলে দীর্ঘমেয়াদী প্রসেসিংর মধ্য দিয়ে যেতে হবে, কিন্তু অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে সময় খুবই স্বল্প। এরমধ্যেই উপদেষ্টাগণ চমৎকার কিছু দৃশ্যমান সংস্কার করেছেন যা অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে।
কিন্তু অদৃশ্যমান যেসব সংস্কারের দাবি আমরা তুলেছি তা বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। ফ্যাসিবাদী কাঠামো এখনো বিদ্যমান, পুলিশের নির্মমতার কোনো বিচার এখনো হয়নি, সচিবালয়ে এখনো ফ্যাসিস্টরা নির্বিঘ্নে কাজ করে যাচ্ছে, মিডিয়া এখনো ফ্যাসিস্টদের দোসরগিরি করে যাচ্ছে।
আরও একটি বিষয় যা সবাই এড়িয়ে যাচ্ছে—জুলাই পরবর্তী রাষ্ট্র বিনির্মাণে যেখানে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষার্থী গোষ্ঠী অর্থাৎ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক কিংবা নীতিনির্ধারণী স্তরে কোনো স্বীকৃতি নেই। এটি শুধু লজ্জাজনক নয়, বরং চূড়ান্ত বৈষম্যমূলক।
এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলীয় এজেন্ডার কারণে চমৎকৃতভাবে সৃষ্ট হওয়া একতায় ভাঙন ধরেছে, ফলে প্রত্যাশা যা ছিল তা পূরণ হচ্ছে না। ফলে আমাদের মাঝে না পাওয়ার হতাশা তৈরী হচ্ছে যা কখনোই কাম্য ছিল না।
আওয়ার ইসলাম: আপনি জুলাইয়ের প্রথম শহীদ, এই কথা যখন ছড়িয়ে পড়েছিল, আপনি জানার পর কেমন অনুভূতি ফিল করেছিলেন সে সময়?
ইব্রাহীম নীরব: ঘটনাটি ১৫ জুলাইয়ের। বর্তমানে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা প্রথমে ঢাবির হলপাড়ায় এবং পরবর্তী সময়ে ভিসি চত্বরে দফায় দফায় হামলা চালিয়ে হাজারো শিক্ষার্থীকে আহত করে, যারমধ্যে একজন আমিও ছিলাম।
সেদিন কয়েকজনের সহায়তায় আহতাবস্থাতেই ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যাই, অন্যান্যদের দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে। কিন্তু সেখানেই আমি কিছু সময় পর সেন্সলেস হই। দায়িত্বরত চিকিৎসকের সেবায় কিছুটা সুস্থতা বোধ করলে আবার ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা মেডিক্যালের ভেতরেই হামলা শুরু করে।
তখন আমি এক্স-রে রুম থেকে সারাদেশের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে একটি ভিডিওবার্তা দিই এবং একই সময়ে আমার ছোটভাই তড়িঘড়ি করে এমন একটি ছবি তুলে যেখানে আমাকে মৃত দেখা যাচ্ছিল। সেই ছবিকে পুঁজি করেই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে যে, ‘কোটা আন্দোলনের প্রথম শহীদ।’ আমি তখনও চিকিৎসাধীন এবং মোবাইল আমার ছোটভাইয়ের কাছে ছিল, তাই এটা সম্পর্কে অবগত ছিলাম না।
ততক্ষণে ছাত্রলীগের হাত থেকে বাঁচাতে আমাকে আবু-আম্মু সিএনজিতে উঠিয়ে বাসায় রওনা দেয়। বাসায় ফিরে রেস্ট নিচ্ছিলাম, তখনও ফোন আমার কাছে ছিল না। কিন্তু যখন ছোটভাই এলো, অনলাইনে ঢুকে দেখি তুলকালাম হয়ে গেছে—বিভিন্ন নিউজ মিডিয়া থেকে ফোন আসছে ফ্যামিলির লোকজনের কাছে।
অবস্থা এমন ছিল যে, উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না, আর ওদিকে একের পর এক কল, মেসেজ এসেই চলছে। আমি উপলব্ধি করি, এটাকে ব্যবহার করে সরকার আন্দোলনকে ভণ্ডুল করতে পারে। আন্দোলনের সিনিয়র নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ করে দেশবাসী যেন বিভ্রান্ত না হয়, সেজন্য দ্রুত আরেকটি ভিডিওবার্তা আপলোড করি যার টাইটেল ছিল—“আমি মারা যাইনি।”
এমএইচ/