মুহাম্মাদ শোয়াইব
ভারতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক মসজিদ ভাঙার ঘটনা শুধু স্থানীয় পর্যায়ে আলোচনার জন্ম দেয়নি, বরং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে মুসলিম সম্প্রদায়ের উদ্বেগকে আরও গভীর করেছে। শুধু গত এক মাসের মধ্যে তিনটি মসজিদ ভাঙ্গা হয়েছে। তিনটি ভিন্ন রাজ্যের ঘটনাকে সামনে রাখলে একটি বড় ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রশাসনিক পদক্ষেপ, উন্নয়ন প্রকল্প, কিংবা “অবৈধ দখল” অভিযোগ—এসবকে হাতিয়ার করে ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোকে ধ্বংস বা আংশিক ভাঙার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে ভারতে।
আহমেদাবাদের ৪০০ বছরের পুরনো মাঞ্চা মসজিদ
গুজরাটের আহমেদাবাদে অবস্থিত মাঞ্চা মসজিদ, যার বয়স প্রায় ৪০০ বছর, আজ (৪ অক্টোবর ২০২৫) আংশিক ভাঙার নির্দেশ দিয়েছে গুজরাট হাইকোর্ট। প্রশাসনের যুক্তি, কালপুর রেলস্টেশন ও আহমেদাবাদ মেট্রো জংশনের যানজট কমাতে রাস্তা প্রশস্ত করা প্রয়োজন। মসজিদের একটি অংশ রাস্তা প্রকল্পের আওতায় পড়ে যাওয়ায় এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
তবে মসজিদ পরিচালনাকারী ট্রাস্টের দাবি, এটি একটি ওয়াকফ সম্পত্তি এবং এর ধ্বংস শুধু GPMC আইন নয়, বরং ভারতের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারেরও লঙ্ঘন। ট্রাস্ট আদালতে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছে, রায়ের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় তাৎপর্য উপেক্ষা করা হয়েছে। আদালত যদিও বলেছে মসজিদের মূল কাঠামো অক্ষত থাকবে, তবে মুসলিম সম্প্রদায়ের আশঙ্কা—এটি ধীরে ধীরে পুরো মসজিদ ধ্বংসের সূচনা হতে পারে।
“আই লাভ মুহাম্মদ” আন্দোলন ও উত্তর প্রদেশে ৮টি সম্পত্তি চিহ্নিত
উত্তর প্রদেশের বেয়ারলিতে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে (৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫) “I Love Muhammad” লেখা পোস্টার নিয়ে মিছিলকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। মিছিল বাতিল হলে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ও পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটে।
এর পরপরই স্থানীয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (BDA) ও প্রশাসন খলিফা তওকীর রেজা খানের সহযোগীদের সঙ্গে যুক্ত ৮টি সম্পত্তিকে অবৈধ বলে চিহ্নিত করে। অভিযোগ, এগুলো সরকারি জমি দখল করে তৈরি হয়েছে, এবং যথাযথ অনুমোদন ছাড়াই নির্মিত। “Skylark”, “Fahm Lawn” ও “Flora Garden” নামের কয়েকটি প্রকল্পও সিল করা হয়েছে। প্রশাসন জানিয়েছে, জনস্বার্থে এসব অবৈধ স্থাপনা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তবে মুসলিম সম্প্রদায়ের অভিযোগ, প্রশাসন মূলত রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে একতরফাভাবে মুসলিমদের লক্ষ্য করছে। ঘটনায় জেলায় ইন্টারনেট পরিষেবা সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১০টি মামলা দায়ের ও হাজারো মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়।
সাম্ভাল জেলার গ্রামীণ মসজিদ ধ্বংস
উত্তর প্রদেশের সাম্ভাল জেলার রায়া বুঝর গ্রামে প্রশাসন ধ্বংস করেছে একটি মসজিদ ও প্রায় ৩০,০০০ বর্গফুট আয়তনের একটি বিবাহ-হল। সরকারি জরিপে বলা হয়, এগুলো গ্রাম সভা ও পুকুরের জমি দখল করে নির্মিত হয়েছে।
২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ইং নোটিস জারি করে মালিকদের ৩০ দিন সময় দেওয়া হলেও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যেই বুলডোজার ব্যবহার করে ধ্বংসকাজ চালানো হয়। ড্রোন দিয়ে এলাকা পর্যবেক্ষণ করা হয়, স্থানীয়দের ঘরে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
গ্রামবাসীরা দাবি করেছেন, বিবাহ-হলটি সমাজের মানুষের দান-পণ্যের অর্থে নির্মিত হয়েছিল। অথচ প্রশাসন বিকল্প জমি দেয়নি। স্থানীয় মুসলিম নেতৃত্বের অভিযোগ, ধ্বংসকাজের জন্য আরও কয়েকদিন সময় চাওয়া হলেও কর্তৃপক্ষ সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, গত চার মাসে সাম্ভাল জেলায় এটিই দ্বিতীয় মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা।
বৃহত্তর প্রেক্ষাপট
এই তিনটি ঘটনাই একটি প্রবণতা নির্দেশ করছে—ঐতিহাসিক বা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত মুসলিম ধর্মীয় স্থাপনাকে “অবৈধ” ঘোষণা করে ভেঙে ফেলা হচ্ছে, আবার কোথাও উন্নয়ন প্রকল্পের অজুহাতে আংশিক ধ্বংসের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের অভিযোগ, এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে পরিকল্পিতভাবে আঘাত করা হচ্ছে।
ভারতের সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। আদালতের ব্যাখ্যা ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ফলে বারবার মসজিদগুলো ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
মাঞ্চা মসজিদের মতো ঐতিহাসিক স্থাপনা থেকে শুরু করে গ্রামীণ এলাকার ছোট্ট মসজিদ পর্যন্ত—ভারতে মুসলিম ধর্মীয় স্থাপনা ধ্বংসের ঘটনাগুলো এখন এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এগুলো শুধু ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করছে না, বরং ঐতিহ্য ও ইতিহাস সংরক্ষণেও বড় ধরণের প্রশ্ন তুলছে। এ প্রবণতা চলতে থাকলে তা ভারতের সামাজিক সম্প্রীতি ও সাংবিধানিক অঙ্গীকারের জন্য এক গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আরএইচ/