সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫ ।। ২৯ আষাঢ় ১৪৩২ ।। ১৯ মহর্‌রম ১৪৪৭


এরদোয়ান কি ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ইনজামামুল হক 

২০০৩ সালে যখন রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান ক্ষমতায় আসেন, তখন সারা বিশ্বের ইসলামপন্থীরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। অনেকেই তার বিজয়কে 'খিলাফতের দ্বিতীয় আগমনী প্রতীক' হিসেবে দেখেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসে এরদোয়ান নিজের আসনকে পাকাপোক্ত করার দিকে মনোযোগ দেন এবং ধীরে ধীরে একজন কর্তৃত্ববাদী শাসকে রূপান্তরিত হন।

তিনি ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তুরস্কের ২৫তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তার সহ-প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (AKP)-এর হয়ে। এরপর তিনি সংবিধান পরিবর্তন করে তুরস্ককে একটি সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতিতে রূপান্তর করেন এবং ২০১৪ সাল থেকে দেশটির ১২তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ইস্তানবুলের মেয়র ছিলেন।

২০০২ সাল থেকে এরদোয়ান কার্যত তুরস্কের শীর্ষ নেতা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার শাসনকালকে চিহ্নিত করা হয়েছে কর্তৃত্ববাদ, গণতন্ত্রের অবক্ষয়, ব্যাপক দুর্নীতি, আগ্রাসী সম্প্রসারণবাদ এবং বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নের মাধ্যমে- যার মধ্যে রয়েছে সেন্সরশিপ, সমালোচকদের কারাবন্দি করা এবং বিরোধী দলগুলিকে নিষিদ্ধ করা।

গাজার বর্বরোচিত গণহত্যায় যেভাবে এরদোয়ান ইসরায়েলকে সাহায্য করছেন

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান গাজায় ইসরায়েলের বর্বরোচিত গণহত্যা কর্মকাণ্ডের কড়া সমালোচক হিসেবে পরিচিত। তিনি প্রায়শই ইসরায়েলকে গণহত্যাকারী বলে অভিযুক্ত করেন। কিন্তু তার এমন কঠোর বক্তব্য প্রদান সত্ত্বেও, প্রমাণ পাওয়া গেছে যে এরদোয়ানের নেতৃত্বে তুরস্ক পরোক্ষভাবে ইসরায়েলকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা করছে। এই দ্বৈত আচরণ একজন কথিত ‘ইসলামপন্থীর’ ভণ্ডামিকে প্রকাশ করে, যার কথা ও কাজের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।

ফিলিস্তিনিদের প্রতি এরদোয়ানের অবস্থান সবসময়ই দৃঢ় বলে মনে করা হতো। তিনি হামাসকে একটি ‘মুক্তি আন্দোলন’ হিসেবে প্রশংসা করেছেন, হামাস নেতাদের ইস্তাম্বুলে স্বাগত এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের আহ্বানও জানান। তিনি এমনটিও বলেছেন যে, তুরস্ক সামরিক হস্তক্ষেপ করতে পারে, যেমনটি তারা আগে লিবিয়া ও নাগোর্নো-কারাবাখে করেছিল। তার আগ্রাসী বক্তব্যে তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তখন তুর্কি জনতার কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো এই বক্তব্য। কিন্তু এসব বক্তৃতা অনেকটাই তার ইসলামপন্থী ভোটারদের সন্তুষ্ট করার জন্য এবং বাস্তবে তা কোনো কার্যকর পদক্ষেপে রূপ নেয়নি।

২০২৪ সালের মে মাসে গাজায় মানবিক সংকটের অজুহাতে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করেন। কিন্তু তদন্তে দেখা গেছে, তুরস্ক থেকে এখনও পণ্য ইসরায়েলে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে এসব পণ্য ফিলিস্তিনের নামে ইসরায়েলে পাঠানো হচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হয়। এই বাণিজ্য পরোক্ষভাবে ইসরায়েলি অর্থনীতিকে সমর্থন দিচ্ছে।

সামরিক দিক থেকেও তুরস্ক গাজা যুদ্ধে সরাসরি জড়িত না থাকলেও, তার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং ন্যাটোর সদস্যপদ ইসরায়েলের নিরাপত্তায় পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে। তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে ‘ডিকনফ্লিকশন মেকানিজম’ বা সংঘর্ষ এড়ানোর কৌশল সিরিয়ায় কার্যকর ছিল, যা গাজায় ইসরায়েলের অভিযানকে জটিল হওয়া থেকে বিরত রেখেছে। 

যেভাবে এরদোয়ানের দ্বিচারিতা উন্মোচিত হল

এরদোয়ানের সবচেয়ে বড় ভণ্ডামি হলো ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য। যদিও তিনি প্রকাশ্যে দাবি করেন যে, তুরস্ক ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করেছে। কিন্তু তদন্তকারী সাংবাদিক মেতিন চিহানসহ অনেক বিশ্লেষকই বলছেন, 'প্রকৃতপক্ষে বাণিজ্য থামেনি'। এমনকি অভিযোগ রয়েছে, এরদোয়ানের ছেলে ২০২৪ সালের অক্টোবরের পর ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন। তুর্কি পণ্য ফিলিস্তিনের নাম ব্যবহার করে ইসরায়েলে পৌঁছেছে। এই ঘটনা তুরস্কের রাজনৈতিক দ্বিচারিতার আরেকটি প্রমাণ।

ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে এরদোয়ানের সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা

ইরান বিশ বছর ধরে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করে একটি ‘রিং অফ ফায়ার’ তৈরি করেছে, যা সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন ও ইরাক দিয়ে ঘিরে রাখা হয় ইসরায়েলকে। কিন্তু ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, গাজা যুদ্ধের সময়, যখন ইসরায়েল চরম সংকটে ছিল, তখন এরদোয়ান আহমেদ হুসেইন আল-শারা কে ক্ষমতায় বসিয়ে সেই ' রিং অফ ফায়ার' ভেঙে দেন।

এর ফলে ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’-এর সরবরাহ লাইন ধ্বংস হয়ে যায় এবং হিজবুল্লাহ অস্তিত্ব সংকটে পড়ে।

আল-শারা ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আমেরিকার হাতে বন্দি ছিলেন। পরে তিনি ২০১২ সালে আল-কায়েদার সহায়তায় সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে অংশ নিতে আল-নুসরা ফ্রন্ট গঠন করেন।

হ্যাঁ, বাশার আল আসাদ একজন স্বৈরাচারী শাসক- কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের আরও অনেক শাসক আছেন যারা সমানভাবে দমনমূলক কাজ করেছে, কিন্তু তারা পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখায় তাদের কিছু বলা হয় না। আসাদ সেই সুযোগ পাননি কারণ তিনি ইসরায়েলবিরোধী ছিলেন।

এরদোয়ান মুখে যতই ইসরায়েলের বিরোধিতা করুন না কেন, বাস্তবে তার সরকার বাণিজ্য ও কৌশলগত সমন্বয়ের মাধ্যমে ইসরায়েলকে সাহায্য করছে। এটি এক প্রকার রাজনৈতিক চাল, যার মাধ্যমে তিনি নিজের দেশের ইসলামপন্থী জনগণকে খুশি করেন, অথচ পেছনে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন।

সূত্র: মুসলিম মিরর অবলম্বনে

এমএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ