বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫ ।। ১৬ আশ্বিন ১৪৩২ ।। ১০ রবিউস সানি ১৪৪৭

শিরোনাম :
ভারতে ড. ইউনূসকে অসুররূপে উপস্থাপন অশোভন: ধর্ম উপদেষ্টা . বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মিডিয়া সেলের বৈঠক  ড. ইউনুসের নেতৃত্বেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান  খুলনা-৩ আসনে হাতপাখার প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির বৈঠক ইসলামি রাষ্ট্র দর্শনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী নেজামে ইসলাম পার্টির দাওয়াতি মাসের উদ্বোধন সিলেটে কওমি কনফারেন্স আগামীকাল আস-সুন্নাহর পুঁজিতে সেলুন ব্যবসায় সাবলম্বী হওয়া নওমুসলিম মুজাহিদের গল্প ইসলামী যুব আন্দোলনের দাওয়াতি মাস উদ্বোধন ফরিদাবাদ মাদরাসায় ২০১৯ ব্যাচের ছাত্রদের মিলনমেলা ৪ অক্টোবর

মাওলানা নাদিম আল ওয়াজিদির সাথে আমার স্মৃতি ও তাঁর কর্মময় জীবন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| আবুল ফাতাহ কাসেমী ||

মাওলানা নাদিম আল ওয়াজিদি। উর্দু সাহিত্যের বিদগ্ধ লেখক, সীরাত গবেষক ও ধীমান আলেম। দুই হাজার চৌদ্দের কোন এক বিকালে লম্বা আলোচনা হয় ধীমান এ লেখকের সাথে। দেওবন্দে পড়াকালীন বিভিন্ন সময়ে তার অফিসে হাজিরা দেয়া হত। বিনয় ও সারল্যের তাজমহল ছিলেন ক্ষণজন্মা এ মনীষী। একাধিকবার কাছে ডেকেছেন। স্বপ্ন ও জয়ের কথা বলেছেন। শুনিয়েছেন দেওবন্দের অলি গলির অনেক স্মৃতি। 

ইখলাসের মিনারখ্যাত ঐতিহাসিক দেওবন্দের ছোট্ট একটি কুঠিরে ১৯৫৪ সালের ২৩ জুলাই জন্ম গ্রহণ করেছেন এ মনীষী আলেম। বংশীয়ভাবে সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের অগ্রসেনানী শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী জন্মের পর তার নাম রাখেন ওয়াসিফ হুসাইন। কিন্তু পরবর্তীতে নাদিম নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তার বাবা মাওলানা ওয়াজিদ হুসাইন ও দাদা আহমদ হাসান দেওবন্দি ছিলেন মিফতাহুল উলুম জালালাবাদ মাদরাসার শিক্ষক ও শাইখুল হাদীস। তার বাবা তালিমুদ্দিন ডাভেল মাদরাসার শাইখুল হাদীসও ছিলেন। আর মামা মাওলানা শরীফ হুসাইন দেওবন্দি ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের প্রভাবশালী শাইখুল হাদীস। তার বাবা ও দাদা উভয়েই শাইখুল আরব ওয়াল আজম শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানির শাগরেদ ছিলেন। যিনি বাংলাদেশের অসংখ্য আলেমের উস্তাদ। মাওলানা নাদিম আল ওয়াজদির মূল বাড়ি ছিল বিজনুরের সিরকুটে। দেওবন্দের মাটি ও রুহের টানে তার পরিবার দেওবন্দে এসে স্থায়ী আবাস তৈরি করেন। 

মাওলানা নাদিম আল ওয়াজদি একাধারে বিদগ্ধ আলেম লেখক, কলামিস্ট ও সীরাত গবেষক। ভারতের উর্দু সাহিত্যের শক্তিমান লেখক। দাঈ ও ইসলামিক স্কলার। তিনি প্রাথমিক পড়াশুনা মিফতাহুল উলুম জালালাবাদ মাদরাসায় সম্পন্ন করেন। তারপর দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ১৯৭৪ সালে দাওরা হাদীস শেষ করেন। এরপর দেওবন্দে তিনি তাকমিলে আদব ও আরবী সাহিত্য নিয়ে পড়েন। বিখ্যাত আরবী সাহিত্যিক মাওলানা ওয়হিদুজ্জামান কিরানভির তিনি খাস শিষ্যদের অন্তর্ভূক্ত। তার সমসাময়ীক ও ক্লাসমেটদের মধ্যে রয়েছেন ভারতের প্রখ্যাত ফকিহ ও আধুনিক মাসয়ালা মাসায়েলের প্রবাদপ্রতীম গবেষক মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ রাহমানী। মাওলানা রাহমানী তার এক বছরের জনিয়র। বাংলাদেশের বরেণ্য লেখক ও মনীষী মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ হাফি.ও তার ক্লাসমেট। এছাড়াও দারুল উলুম দেওবন্দের শুরা মেম্বার  মাওলানা আতিক আহমদ বাস্তাবি ও প্রভাবশালী রাজনীতিজ্ঞ মাওলানা বদরুদ্দিন আজমল তার সতীর্থ।

তার পুরো জীবন লেখালেখি ও দীনের বিভিন্ন সেবায় কেটেছে। তিনি নারী শিক্ষার উন্নয়নকল্পে ২০০১ সালে দেওবন্দে প্রথম আবাসিক জামেয়া আয়েশা সিদ্দিকা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘ দিন তিনি ঐতিহাসিক দারুল উলুম দেওবন্দের রচনা লেখালেখি ও গবেষণা বিভাগের তত্ত¡াবধায়ক ছিলেন। ১৯৮০ সালের দিকে দেওবন্দে দারুল কিতাব নামে একটি মানসম্পন্ন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। হাজারো ঘটনার জীবন্ত সাক্ষ্যি, তাকওয়া ও ইখলাসের জীবন্ত ভূমি, জ্ঞান ও শিল্পের লালনভূমি, ইতিহাসের দীপিত রাজখÐ দারুল উলুম দেওবন্দের স্মৃতি জাগুরুক রাখতে তিনি ২০০১ সালে তরজুমানে দেওবন্দ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নিজে সম্পাদক থেকে দেওবন্দের মুখপাত্র এ মাসিকটিকে একটি সমৃদ্ধশালী মাসিকে রুপান্তরিত করেন। এ ছাড়াও তিনি ভারতের মুসলিমদের প্রভাবশালী সংগঠন মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সদস্য ছিলেন। 

তিনি ভারতের দৈনিক ও মাসিক পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত লেখতেন। দৈনিক ইনকিলাব ও বোম্বায় উর্দু নিউজের তিনি নিয়মিত কলাম লেখক ছিলেন। ভারতের দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকা পরিবারের অনুরোধে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় তিনি কুরআনি ওয়াকেআত ও নিয়মিত সীরাতের পাঠশালা নামে সিরিজ লেখা লেখতেন। সীরাত নিয়েও তার পড়াশুনা খুবই সমৃদ্ধ।

দীর্ঘ জীবনে তিনি প্রায় চল্লিশটি গ্রন্থ রচনা করেন। তার কিছু গ্রন্থ ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেলেবাসভুক্ত। ইমাম গাজালির বিখ্যাত ইহয়ায়ু উলুমিদ্দিন গ্রন্থের উর্দু অনুবাদের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে তিনি লেখালেখিতে নিজের আসন গেড়ে বসেন। বিখ্যাত এ গ্রন্থের অনুবাদের মাধ্যমে তিনি উর্দু সাহিত্যে সকলের দৃষ্টি কাড়েন। তার উল্লেখযোগ্য রচনাবলির মধ্যে— ইহয়াউ উলুমিদ্দিনের বিখ্যাত উর্দু অনুবাদ, কুরআনুল কারীম কে ওয়াকেআত, মুসলমানু কে মিল্লি আওর সিয়াসি যিন্দেগী, হামারে মাদারিস মেজায আওর মানহাজ, তিন তালাক আওয়াম কী আদালত মে, ইসলাম আওর হামারি যিন্দেগি, বেমেসাল শখসিয়াত, বাকামাল উস্তাদ, আজ কা তারাবি, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি জাঙ্গি মুহিম্মাত ইত্যাদি।    

তার এক মাত্র ছেলে মাওলানা ইয়াসির নাদিম আল ওয়াজিদিও বর্তমান সময়ের একজন ইসলামিক স্কলার। আমেরিকা প্রবাসী এ আলেম তুলনামূলক ধর্মতত্ত¡ নিয়ে বিশ^ব্যাপী দাওয়াতি কাজ করছেন। আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানে ইসলামের অবদানসহ ইসলামকে বিশ^ মাধ্যমে তুলে ধরতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন মাওলানা ইয়াসির। বর্তমানে দেওবন্দের এ ফারেগ আমেরিকার শিকাগোতে নিজস্ব ইসলামিক সেন্টার ও মাদরাসার মাধ্যমে উলামায়ে দেওবন্দের প্রতিনিধিত্ব করছেন।

দেওবন্দে পড়াকালীন সময়ে বিভিন্ন সময়ে তার সাথে দেখা হলে তিনি দূর থেকে ‘কিয়া হাল হায়ে মৌলবি সাব’ বলে কাছে ডাকতেন। মাঝে মাঝে আসরের পর বাংলাদেশের অনেক গল্পও করতাম এ মহামনীষীর সাথে। বিশেষ করে ২০১৭ সালে আমার দ্বিতীয় দেওবন্দ সফরে হাদীসে মুসলসাল নিয়ে তার সাথে দীর্ঘ আলাপ হয়। তিনি হাকিমুল ইসলাম কারি মুহাম্মদ তায়্যিব রহ. থেকে হাদীসের সনদ লাভ করেন ও তার একান্ত শিষ্য ছিলেন। দূঃখের কথা হল, তার সারল্যের কারণে তার জীবদ্দশাতে তার উচু ব্যক্তিত্ব উপলব্ধি করতে পারিনি। সাদেগি ও সারল্যের এ গুণ মনে হয় উলামায়ে দেওবন্দ ছাড়া পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।    

ব্যক্তি জীবনে খুবই বিনয়ী ও সদালাপী এ মানুষটিকে কয়েকদিন যাবৎ বিভিন্ন অসুস্থতায় ভুগছিলেন। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ছেলের কাছে আমেরিকায় অবস্থান করছিলেন। সবশেষে দীর্ঘ কর্মময় জীবনের ইতিটেনে সত্তর বছর বয়সে কালের এ মনীষী গত ১৪ অক্টোবর সোমবার রাতে আল্লাহর প্রিয় হন। তার মৃত্যুতে ভারতের গবেষণা ও ইলমি ঘরণায় শোকের ছায়া নামে। তার ইন্তেকালে আমরা একজন রাসুল প্রেমিক সীরাত গবেষক লেখককে হারালাম। তার ইন্তেকালে ইতিমধ্যে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ও বিশিষ্ট ফকিহ মাওলনা খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানিসহ অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান শোক বার্তা পাঠিয়েছেন।

আমরা কালের এ মনীষীর জান্নাতুল ফেরদাউস কামনা করি। আল্লাহ তাআলা তার অসমাপ্ত কাজগুলো তার উত্তরাধিকারদের আঞ্জাম দেয়ার তাওফিক দান করুন। তার শূণ্যতা পূরণের তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: অনুবাদক ও মুহাদ্দিস, জামিয়া কাসেম নানুতবী ঢাকা।

হাআমা/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ