||জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান||
বিশ্ব আজ এমন এক অদৃশ্য যুদ্ধের প্রান্তে দাঁড়িয়ে, যার কোনো শব্দ নেই, নেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী; আছে কেবল নীরব ধ্বংসের সম্ভাবনা। আধুনিক সভ্যতার হৃদয়ে ছড়িয়ে থাকা নেটওয়ার্ক আর সার্ভারের ভেতর দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে এক অচেনা শত্রু—কোডের তৈরি, অ্যালগরিদমের বুদ্ধিতে জন্ম নেওয়া, আর কৃত্রিম মস্তিষ্কের ঠাণ্ডা নির্লিপ্ততায় পরিচালিত। এই যুদ্ধের ভয়াবহতা ঠিক সেখানেই—এটি দেখা যায় না, শোনা যায় না, কিন্তু মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে একটি দেশের আলো, অচল করতে পারে ব্যাংকিং ব্যবস্থা, থামিয়ে দিতে পারে পরিবহন নেটওয়ার্ক ও হাসপাতালের জীবনরক্ষার ইঞ্জিন।
যে পৃথিবীতে একসময়ে যুদ্ধ শুরু হতো সীমান্তে, এখন আক্রমণ শুরু হয় সার্ভারের অন্তরে। একটি ম্যালওয়্যার, একটি ব্রিচ, একটি এআই-চালিত অটোনোমাস এজেন্ট—এগুলোর যেকোনোটি ক্ষয়িষ্ণু করে দিতে পারে একটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ঢাল। রাষ্ট্র-সমর্থিত সাইবার গ্রুপগুলো এখন বিশেষভাবে অবকাঠামোকে লক্ষ্য করছে; তাদের আক্রমণ নিঃশব্দ, কিন্তু প্রভাব গভীর। এমনকি একটি সঠিক সময়ে পরিচালিত সাইবার হামলা পুরো দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা থামিয়ে দিতে পারে, ব্যাংক লেনদেন স্থবির করে দিতে পারে, বিমানবন্দরের রানওয়ে অচল করে দিতে পারে।
সাইবার আক্রমণের এই ঢেউয়ে সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিকটি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগমন। এআই আর শুধু তথ্য বিশ্লেষণের যন্ত্র নয়; এখন তা নিজেই শিখছে, নিজেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, নিজেই আক্রমণ পরিচালনা করছে। যে আক্রমণ একসময় ঘটতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাগত, আজ তা সম্পন্ন হচ্ছে কয়েক মিনিটে। অ্যালগরিদমের স্পন্দনে তৈরি এই নতুন শত্রু মানুষের মতো অনুভব করে না, থামে না, ক্লান্ত হয় না।
প্রযুক্তিকে ঘিরে যে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে, তা এই সংকটকে আরও তীব্র করেছে। যুক্তরাষ্ট্র–চীন প্রযুক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা, রাশিয়ার সাইবার সক্ষমতা, ইউরোপের কঠোর নীতি—সব মিলিয়ে পৃথিবীর ওপর যেন এক অদৃশ্য নতুন শীতল যুদ্ধের ছায়া নেমে এসেছে। এই সংঘাতের ফল সরাসরি গিয়ে লাগছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। একটি দেশের নেটওয়ার্ক আক্রান্ত হলে তার প্রভাব পড়ছে অন্য দেশের সরবরাহ ব্যবস্থায়, বৈশ্বিক বাণিজ্যে, ডিজিটাল বন্দরগুলোতে।
মানবসভ্যতা এখন এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে, যেখানে জীবনযাত্রা, অর্থনীতি, চিকিৎসা, যোগাযোগ—সবই নির্ভর করছে নেটওয়ার্কের ওপর। সেই নেটওয়ার্কই আজ সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে। বৈশ্বিক বিশেষজ্ঞদের মতে, সামনের দিনগুলোতে সাইবার নিরাপত্তা হবে মানবসভ্যতার বেঁচে থাকার শর্ত—ঠিক যেমন খাদ্য বা পানি।
এই অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের জিজ্ঞাসা একটাই—বিশ্ব কি প্রস্তুত সেই অন্ধকার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে, যে একটিমাত্র কোডের মাধ্যমে অচল করে দিতে পারে সভ্যতার গতি?
তথ্যসূত্র: WEF,ক্যাসপারস্কি রিপোর্ট, ENISA, মার্কিন CISA,UN Cybercrime Report
লেখক: কলামিস্ট, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর
এলএইস/