শরিফুল ইসলাম রিয়াদ
সমঝোতার প্রথম বৈঠক হওয়ার কথা ছিল ১২ ডিসেম্বর। বৈঠকে অংশ নিতে পীর সাহেব চরমোনাই বরিশাল থেকে ঢাকায় আসেন। কিন্তু ঢাকায় পৌঁছানোর আগেই জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, সেদিন বৈঠক করা সম্ভব হবে না। পীর সাহেব হুজুর তখন বলেন, অন্তত সৌজন্য সাক্ষাৎ হলেও যেন হয়। কিন্তু জামায়াতের পক্ষ থেকে জানানো হয়— আপাতত সেটিও সম্ভব নয়, কারণ ড. আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের অসুস্থ। হুজুর বলেন, তাহলে তাহের ভাইকে দেখে আসতে চান। জবাবে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল জানান— তাহের ভাই এতটাই অসুস্থ যে সাক্ষাৎ করাও সম্ভব নয়।
এরপর পীর সাহেব হুজুর ঢাকায় অবস্থান করতে থাকেন এবং ধারাবাহিকভাবে সমঝোতার বৈঠক আয়োজনের তাগাদা দেন। তিনি বারবার বলেন
সমঝোতা দ্রুত শেষ করা জরুরি। কারণ, নমিনেশন উত্তোলনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। সময়মতো সিদ্ধান্ত না হলে সকল দলকেই আলাদাভাবে নমিনেশন নিতে হবে, যা দেখতে অসুন্দর হবে এবং তৃণমূলে বিভ্রান্তিকর বার্তা দেবে।
যেহেতু সিদ্ধান্ত ছিল সকল আসনে সব দলের পক্ষ থেকে একক প্রার্থী দেওয়া হবে, তাই সমঝোতা চূড়ান্ত করা অত্যন্ত জরুরি। তবুও সমঝোতার বৈঠক নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে প্রত্যাশিত আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়নি।
এই অবস্থায় হঠাৎ দেখা যায়— জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে অন্য সাত দলের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই জামায়াতের প্রার্থীদের নমিনেশন উত্তোলনের নির্দেশ দেওয়া হয়। বিষয়টি পীর সাহেব হুজুর জামায়াতের হাই কমান্ডকে অবহিত করে বলেন— এভাবে একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া অসুন্দর হয়েছে। এতে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হবে এবং তৃণমূলে নেতিবাচক বার্তা যাবে। বরং সকল দল মিলে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একজনের পক্ষে নমিনেশন উত্তোলন করলে সমঝোতা আরও শক্তিশালী হতো।
এই পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে পীর সাহেব হুজুর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের (আইএবি) প্রার্থীদেরও নমিনেশন উত্তোলনের নির্দেশ দেন। যদিও তিনি নিজে আলোচনার বাইরে গিয়ে সবাই নমিনেশন নিক, এমনটা চাননি।
অবশেষে ১৯ ডিসেম্বর প্রথম সমঝোতার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটি হয় জামায়াতে ইসলামীর এক সিনিয়র নেতার বাসায়। সেখানে এক-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়, বাকি দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে আলোচনা অসম্পূর্ণ থাকে। সিদ্ধান্ত হয়, ধারাবাহিকভাবে বৈঠক চলবে।
পরবর্তী নির্ধারিত বৈঠকের দিন আইএবির নেতৃবৃন্দ যথাসময়ে বৈঠকের স্থানে পৌঁছান। জামায়াতের লিয়াজোঁ কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে একাধিকবার ফোন করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। প্রায় এক ঘণ্টা নেতৃবৃন্দ বাসার নিচে অপেক্ষা করেন।
এক ঘণ্টা পর ঐ সিনিয়র নেতার পিএস কল ব্যাক করে জানান— স্যার মিটিংয়ে আছেন, তাই কল রিসিভ করতে পারেননি। নেতৃবৃন্দ জানান— আজ তো পূর্বনির্ধারিত বৈঠকের দিন, আমরা বাসার নিচে অপেক্ষা করছি। অনুগ্রহ করে ভাইকে বিষয়টি জানান।
এরপর ঐ সিনিয়র নেতা কল করে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন— আজ বৈঠক থাকার কথা তিনি ভুলে গেছেন, তাই বৈঠক করা সম্ভব নয়। এমন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ভুলে যাওয়ায় নেতৃবৃন্দ বিস্মিত ও অপমানিত বোধ করেন।
তখন নেতৃবৃন্দ বলেন— যেহেতু তারা চলে এসেছেন, অন্তত তাহের ভাইয়ের সঙ্গে কিছু আলোচনা করা হোক। উত্তরে জানানো হয়— তাহের ভাই জরুরি প্রয়োজনে আমীরে জামায়াতের বাসায় গেছেন, তাই সাক্ষাৎ কঠিন হবে।
যদিও পরবর্তীতে জানা যায়— ড. আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের ভাই আসলে নিজ বাসায় ছিলেন এবং এনসিপির সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। এতে ধারণা করা হয়— এনসিপির সঙ্গে বৈঠক করতেই জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতার বৈঠক উপেক্ষিত হয়েছে এবং তাহের ভাইয়ের অবস্থান সম্পর্কে অসত্য তথ্য দেওয়া হয়েছে।
১৯ ডিসেম্বরের পর আর কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। কখনো তাহের ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে, কখনো আজাদ ভাইয়ের ওমরাহ— এ ধরনের কারণ দেখিয়ে বৈঠক স্থগিত রাখা হয়। অথচ নমিনেশন সাবমিটের সময় দ্রুত এগিয়ে আসছিল।
এই পরিস্থিতিতে পীর সাহেব হুজুর আবারও জামায়াতের হাই কমান্ডের ওপর সমঝোতা সম্পন্ন করার জন্য চাপ দেন এবং নমিনেশন ডেডলাইনের গুরুত্ব তুলে ধরেন। অবশেষে ২৫ ডিসেম্বর বৈঠকের তারিখ নির্ধারণ হয়— একেবারে শেষ মুহূর্তে।
বৈঠক হলেও জামায়াতে ইসলামীর শক্ত অবস্থানের কারণে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ফলে শেষ পর্যন্ত সব দলই আলাদাভাবে নমিনেশন সাবমিট করতে বাধ্য হয়।
এতে বিভিন্ন ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়, তৃণমূল ও অভ্যন্তরে অস্থিরতা বাড়তে থাকে এবং সার্বিক অবস্থা বিবেচনায়, পেছনে কারও রাজনৈতিক কৌশল কাজ করছে কি না— এমন প্রশ্নও উঠে আসে।
সবশেষে বলবো— এ ঐতিহাসিক সমঝোতার রাজনীতিতে কে কতটুকু দায় ও দরদ দেখিয়েছে, তা জনগণই বিচার করবে। তবে এটুকু জানা জরুরি যে, পীর সাহেব চরমোনাই কেবল সমঝোতার বৈঠকের জন্যই ১২ ডিসেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে লাগাতার অবস্থান করছেন যা তাঁর রাজনৈতিক জীবনে প্রথম। মধ্যেখানে বিমানযোগে কুড়িগ্রাম ৩ দিনব্যাপী মাহফিলে অংশগ্রহণের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন।
লেখক: সাবেক সভাপতি, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ
আরএইচ/