মাওলানা মাহফুয আহমদ
গতদিন ওয়াটসআপের একটা ইলমি গ্রুপে শায়খুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী সাহেব হাফিযাহুল্লাহর একটি উর্দু প্রবন্ধের পিডিএফ শেয়ার করা হলো। মুহতারাম হজরত মাওলানা আবু আসিম বদরুল ইসলাম সাহেবও ব্যক্তিগতভাবে ওটা পাঠালেন। হজরত শায়খুল ইসলামের যেকোনো কিছু পেলেই আগ্রহভরে পড়ি এবং নিজেকে সমৃদ্ধ করতে চেষ্টা করি। ১৪৩৬ হিজরি সনে রচিত এ প্রবন্ধটি ‘আল-হক’ মাসিক পত্রিকার জানুয়ারি ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পাঁচ পৃষ্ঠার সেই প্রবন্ধ থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
এক. হজরত বলেন, আমাদের ঘরে আব্বাজান মুফতি মুহাম্মাদ শফী রাহিমাহুল্লাহর বিশাল একটা ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিল। আব্বাজানকে নিয়মিত কিতাব পাঠে দেখতে দেখতে আমাদের বেড়ে ওঠা৷ আর সেটা আমাদেরকেও কিতাব পাঠে আগ্রহী করে তুললো।
এখান থেকে আমরা যারা পিতা এবং পরিবারের দায়িত্বশীল আছি; আমাদের জন্য শেখার আছে। আমাদের প্রত্যেককে মনে রাখা উচিত যে, কেবল আমার নাসীহাহ শিশুদের জন্য যথেষ্ট ও কার্যকরী নয়, আমাদেরকে বাস্তবে আমল করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলেই তবে সন্তানরা ভালো কাজগুলো শিখবে এবং ভালো কিছু করতে উদ্বুদ্ধ হবে।
দুই. হজরত বলেন, আমার উসতায মুফতি ওয়ালী হাসান খান টুনকী রাহিমাহুল্লাহ দরসে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন কিতাবের সঙ্গে আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিতেন। তিনি দরসের বাইরে প্রাসঙ্গিক কিতাবগুলো পড়তে রীতিমতো আমাদেরকে তাগিদ দিতেন। বরং আমরা দেখেছি, যখনই হযরত মাওলানা আবদুর রশীদ নোমানী রাহিমাহুল্লাহ আমাদের উসতায মুফতী ওয়ালী হাসান খান টুনকীর কাছে আসতেন; দুজনেই কোনো না কোনো ইলমী কিতাব নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিতেন। বস্তুত উসতাযের এমন অনুপ্রেরণা এবং বাস্তব কর্মপন্থা থেকেও কিতাব পাঠে আমরা উৎসাহিত হই।
এখান থেকে আমরা যারা শিক্ষক আছি; আমাদেরও শেখার আছে অনেক।
তিন. হজরত বলেন, আব্বাজান এবং উসতাযগণের এমন তরবিয়তের ফলে ছোটোবেলা থেকেই কিতাব পাঠের অভ্যাস গড়ে উঠে। আমাদের ঘরের পাঠাগারের সবগুলো কিতাবই আমি নাড়াচাড়া করে দেখেছি। প্রতিটি কিতাবের সবটুকু পাঠ না করতে পারলেও অন্তত কিতাবের নাম, লেখকের নাম, সূচিপত্র ও বিষয়বস্তু ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে পরিচিতি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছি। ফলে পরবর্তী সময়ে যখনই কোনো বিষয়ে জানার কিংবা লেখার প্রয়োজন হয়েছে তখন সেটা কোন কিতাবে পাওয়া যেতে পারে তার একটা আইডিয়া সহজেই পেয়ে যেতাম। তাছাড়া বাল্যকাল থেকেই আমার ভেতরে রচনা ও সাহিত্যের প্রতি আলাদা এক টান ও আকর্ষণ ছিলো। সেজন্য ছাত্রজীবনেই মাওলানা সায়্যিদ সোলাইমান নদবী, মাওলানা মানাযির আহসান গীলানী, মাওলানা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদবী প্রমুখ মনীষীর গ্রন্থাবলী সযত্নে পাঠ করতে শুরু করি। বরং পশ্চিমা ও আধুনিক বহু মতবাদের খণ্ডনে মুসলিম লেখকদের কিতাবগুলো খুব গুরুত্ব দিয়ে পড়তে থাকি। এক্ষেত্রে কখনও কখনও এমন লেখকদের গ্রন্থ পড়েছি যাদের মতের সঙ্গে আমাদের অমিল আছে। যেমন- মাওলানা আবুল আ'লা মওদুদী সাহেবের অধিকাংশ বই আমার পড়া হয়েছে। অবশ্য উম্মাহর স্বীকৃত কোনো বিষয়ে তার ভিন্নমত দ্বারা কখনোই প্রভাবিত হইনি।
চার. হজরত বলেন, এ তো ছিলো ছাত্রজীবনের পাঠাভ্যাসের গল্প। শিক্ষকতা জীবনে কিতাব পাঠের অভ্যাসে ভিন্নতা এলো। ইচ্ছে করলেই যে কোনো কিতাব পাঠের সময় থাকলো না৷ আমার দায়িত্বে থাকা কিতাবগুলো পাঠদান করতে গিয়ে অথবা লেখালেখির কাজে যেসব কিতাবের প্রয়োজন সেগুলো পাঠেই সীমাবদ্ধ থাকতে হলো। তবে এর অর্থ এই নয় যে, পাঠদানকৃত কিতাবের শুধু ব্যাখ্যাগ্রন্থ পড়েই শেষ। বরং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রাসঙ্গিক অনেক কিতাবও পড়তাম নিয়মিত; জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করবার জন্য। অবশ্য শিক্ষার্থীদের সামনে তা-ই উল্লেখ করতাম যা তাদের জন্য জরুরি, উপকারী এবং মুনাসিব মনে করতাম। অন্যদিকে আমার অত্যধিক সফর থাকায় যাত্রাপথে উড়োজাহাজেও যথারীতি কিতাব পাঠের অভ্যাস গড়ে উঠে। সেসময়ে সাহিত্য এবং নিজের শখের বিষয়গুলো সংক্রান্ত কিতাবও পাঠ করতে পারতাম।
পাঁচ. হজরত বলেন, ভ্রান্ত মতবাদের খণ্ডনেও আমি কিতাব লিখেছি। সেগুলো লেখার সময় আমার নীতি ছিলো, খণ্ডনকৃত মতবাদ ও ব্যক্তির কিতাব থেকেই সরাসরি তাদের অভিমত দেখে নিশ্চিত হওয়া এবং সেই অনুযায়ী জবাব উপস্থাপন করা। সেক্ষেত্রে অনেক ভ্রান্ত লোকের ও মতবাদের গ্রন্থও আমার পড়া হয়েছে। কেবল নিজের মতবাদের লোকদের কিতাব পড়ে অন্য মতবাদের খণ্ডন করতে যাওয়া কোনোভাবেই ঠিক নয়।
ছয়. হজরত বলেন, আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, কোন কোন লেখকের কিতাব দ্বারা আপনি প্রভাবিত হয়েছেন। বিষয় ও স্তরভেদে অনেক লেখকের নামই তালিকাভুক্ত করা যাবে। তবে নিরেট ইসলাহ, আত্মশুদ্ধি ও ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব ফেলেছে এমন কিতাবের কথা বলতে গেলে আমার উত্তর হবে একটাই। আর সেটা হলো, হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রাহিমাহুল্লাহ এর রচনাবলী আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। এসবে যেমন ইলমের তথ্য, তত্ত্ব ও নিগূঢ় রহস্য লুকিয়ে আছে, তেমনি যুগ-জিজ্ঞাসার অত্যন্ত হেকমতপূর্ণ কার্যকরী জবাব রয়েছে। হযরত থানবী রাহিমাহুল্লাহ এর একেকটা "মালফুয" (উক্তি ও বাণী) যেন ইলম ও মা'রেফতের দরিয়া। অধুনা পশ্চিমা চিন্তাধারার খণ্ডনে লিখিত হযরত থানবী রাহিমাহুল্লাহ এর "আল-ইন্তিবাহাতুল মুফীদাহ" কিতাবটি আমাদের সকলের জন্য খবুই গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্যপাঠ্য। কিতাবটি ইতোমধ্যে আমার পরামর্শ ও তত্ত্বাবধানে আরবী ও ইংলিশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ইংলিশ অনুবাদ হলো, "আনসার্স টু মডার্নিজম"।
হযরত শায়খুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী সাহেব হাফিযাহুল্লাহ এর পাঠাভ্যাসের এই বিবরণ থেকে আমাদের মতো তালিবুলইলম সাথীদের জন্য শেখার অনেক উপকরণ রয়েছে।
লেখক: লন্ডন প্রবাসী বিশিষ্ট দাঈ ও লেখক
এনএইচ/