বুধবার, ২৭ আগস্ট ২০২৫ ।। ১২ ভাদ্র ১৪৩২ ।। ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

শিরোনাম :
যমুনা অভিমুখে বুয়েট শিক্ষার্থীরা, পুলিশের টিয়ারশেল-জলকামানে ছত্রভঙ্গ নওগাঁয় অটোরিকশা চালক হত্যায় পাঁচজনের যাবজ্জীবন তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি আফতাবনগর মাদরাসায় সিরাতুন্নবী সা. মাহফিল কাল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ফের শাহবাগ অবরোধ আলোকিত সাইকেল পথ: পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে পোল্যান্ডের অনন্য উদ্যোগ ডাকসুতে আচরণবিধি লঙ্ঘনকারীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি প্রেশার কখন মাপা উত্তম: স্বাস্থ্য সচেতনতায় সঠিক সময়ের গুরুত্ব ‘তরুণদের মধ্যে প্রবীণদের উপেক্ষার প্রবণতাটা খারাপ’  নওমুসলিমের হৃদয়ছোঁয়া গল্প : আলোকের পথে আত্মিক যাত্রা (প্রথম পর্ব)

‘তরুণদের মধ্যে প্রবীণদের উপেক্ষার প্রবণতাটা খারাপ’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শেখ ফজলুল করীম মারুফ

পাঠের গভীরতা, ভাবনার বৈচিত্র্য এবং সময়কে ধারণ করার সক্ষমতায় নিজের একটি স্বতন্ত্র জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছেন শেখ ফজলুল করীম মারুফ। ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন অভিভাবক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। রাজনীতির বাইরেও চিন্তাশীল তারুণ্যের খোরাক জোগাতে কাজ করছেন। লেখালেখি ছাড়াও শিক্ষা ও সমাজসেবামূলক নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তার মুখোমুখি হয়েছিলেন: এমদাদুল হক তাসনিম

লেখকপত্র: আপনি একটি ইসলামি দলের ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। ছাত্রজীবনে রাজনীতিতে জড়ানো কতটা সমীচীন? এর দ্বারা পড়াশোনার ক্ষতির আশঙ্কা আছে কি?

মারুফ: রাজনীতি বলতে কী বোঝাচ্ছি তার ওপর নির্ভর করে ছাত্রজীবনে রাজনীতি করা ক্ষতিকর কি না। বর্তমান বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে ছাত্র রাজনীতিকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়। ক. ক্ষমতাকেন্দ্রিক কোনো দলের ছাত্র সংগঠন হিসেবে কাজ করা; যারা মূল দলের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ভূমিকা রাখে। খ. বিপ্লবী কোনো দলের চিন্তা লালন করে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সহিংস ভূমিকা রাখা, দেশের আইনশৃঙ্খলাকে চ্যালেঞ্জ করা। গ. ইসলামকে আদর্শ হিসেবে ধরে আমি যে পড়াশোনা করছি, যে বিশ্বাস লালন করছি তাকে দেশের উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে সমাজে প্রয়োগের জন্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা করা। প্রথম ধারার রাজনীতি পড়াশোনা ও জীবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। দ্বিতীয় ধারার রাজনীতি ভালো কি মন্দ সেই বিচার না করেই বলা যায় এটা পড়াশোনার ক্ষতি করে। আর তৃতীয় ধারার যে রাজনীতি তাতে পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হয় না। বরং এর মাধ্যমে সমাজবোধ তৈরি হয়। মানুষের সাথে মেশার প্রবণতা তৈরি হয়। নবীদের উত্তরসূরি হিসেবে ভূমিকা রাখার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। আমি এই তৃতীয় ধারার রাজনীতি করেছি।

লেখকপত্র: বিভিন্ন ইস্যুতে আপনার চিন্তাধারায় অন্যদের চেয়ে কিছুটা ভিন্নতা থাকে। এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

মারুফ: বাংলাদেশের সমাজে শিক্ষা ও চিন্তাগত ধারা অনেক। সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, রাষ্ট্রে ধর্মের অবস্থান-ভূমিকা, বাংলা অঞ্চলের ইতিহাস, ইসলামের সাথে বাঙালি সংস্কৃতির সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে বহুমত ও চিন্তা আছে। আমাকে রাজনৈতিক কারণে এবং আমার একাডেমিক পড়াশোনার বৈচিত্র্যের কারণে তাদের সবার সাথেই বোঝাপড়া করতে হয়। একটা ইস্যুকে কোনো একক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ আমার নেই। সেজন্য আমার চিন্তাধারা সবার কাছেই খানিকটা ভিন্নতর মনে হয়। আরেকটা বিষয় হলো, তানজিমাত যুগের উলামায়ে কেরাম এবং সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহিমাহুমুল্লাহদের চিন্তার প্রভাবের কারণে আমার মধ্যে সমন্বয়ধর্মী ও ক্রিটিক্যাল চিন্তাধারা তৈরি হয়েছে। আধুনিকতাকে ইসলামের ছাঁচে ঢেলে ব্যবহার করা, পশ্চিমকে বিনাবিচারে বাতিল সাব্যস্ত না করা এবং বাঙালির ইতিহাসের সাথে ইসলামের ঐতিহাসিক সম্পর্ক নিয়ে বোঝাপড়ার কারণেই হয়তো ভিন্নতা তৈরি হয়। আমি বারবার বলেছি, ফিকাহ আর শরিয়াহ এক জিনিস না। শরিয়াহ অনেক বিস্তৃত। ফিকাহ তার আইনি ভাষ্য। কিন্তু আমাদের এখানে ফিকাহকেন্দ্রিক ইলম চর্চার কারণে সবকিছুকে ফিকাহ দিয়ে বিচার করার একটা প্রবণতা আছে। আমি তার বিরোধিতা করি। আরেকটা বিষয় হলো, মালিক বিন নাবীর চিন্তা। তিনি বলেন, কুরআন নাজিল হয়েছে একটি রিয়েলিটি ও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে। মানে আগে রিয়েলিটি, তার পরিপ্রেক্ষিতে টেক্সট। অন্যান্য নবীদের মতো করে কেবলই টেক্সট আকারে কুরআন নাজিল হয়নি। তাই এখনো কোনো টেক্সটকে প্রয়োগ করার আগে রিয়েলিটি ও বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে টেক্সট প্রয়োগ করতে হবে। আমি এই নীতি মান্য করি। ফলে অনেকের সাথেই আমার মতের ভিন্নতা তৈরি হয়। পয়লা বৈশাখ, শবে বরাতের সংস্কৃতি, সাকরাইন, কাওয়ালি উৎসবে সমর্থন দেওয়া, গণতন্ত্রকে শুরা ব্যবস্থা বলার মতো যতগুলো ইস্যুতে আমার মতকে ভিন্নতর মনে হয়েছে তা এসব কারণে। আমি যদি ব্যাখ্যা করার সুযোগ পাই তাহলে আপনিও আমার মতের সাথে একমত হবেন। তারপরেও মতভিন্নতা কেন এসেছে? আমি টেক্সট প্রয়োগের আগে রিয়েলিটি বিবেচনায় নিয়েছি, অনেকে তা নেয়নি। আমি ফিকহি ডোমেইনের বাইরে এসে শরিয়াহর বিস্তৃত পরিধির ব্যবহার করেছি, অনেকে তা করেনি। এটাই মূলত ভিন্নতার কারণ।

লেখকপত্র: রাজনীতিতে তরুণদের বড় অংশের অনীহা আছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে সেই অনীহা কিছুটা দূর হয়েছে বলে মনে হয় কি?

মারুফ: মানুষের প্রতি নিঃশ্বাসে কতটা বিশুদ্ধ বাতাস পাবে, ময়লা পানি খাবে না বিশুদ্ধ পানি খাবে, হজে যাবে বেশি টাকা দিয়ে না কম টাকা দিয়ে, সেজদার জায়নামাজে সুদমিশ্রিত হবে কি হবে না ইত্যাদি জীবনের প্রতিটি বিষয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। ফলে রাজনীতিতে অনীহা থাকা মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। আমাদের তারুণ্যের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে অনীহা ছিল। এখন কিছুটা কেটেছে। এটা আরও পরিবর্তন হওয়া উচিত। তারুণ্যকে আরও বেশি করে রাজনীতিতে আসা উচিত।

লেখকপত্র: এই সময়ের তরুণদের মধ্যে চিন্তাগত কোন বিচ্যুতিগুলো লক্ষ্য করেন? প্রবীণদের সঙ্গে নবীনদের চিন্তার ফারাক রয়েছে কি?

মারুফ: তারুণ্যের চিন্তায় নতুনত্ব থাকবে। উন্নতি থাকবে। তাই বলে প্রবীণদের উপেক্ষা করার প্রবণতাটা খারাপ। বিশেষ করে ইসলামি পরিম-লে চিন্তার ধারাবাহিকতা ও সূত্র থাকা জরুরি। আমাদের কিতাব ও রিজাল সমান্তরাল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সাম্প্রতিক আমাদের রিজালকে বিতর্কিত করার একটা প্রবণতা লক্ষণীয়। এর পরিণতি ভয়াবহ। কারণ ইসলামি চিন্তা কখনোই রিজাল ছাড়া বৈধতা পাবে না। আর রিজালকে বিতর্কিত করার মাধ্যমে সমাজে ধর্মহীনতা আসবে। ইউরোপের ইতিহাস দেখেন। সেখানে আগে রিজালকে বিতর্কিত করা হয়েছে। কারণ রিজালেই কিতাবকে ব্যাখ্যা করে। কিতাবের প্রতিফলন ঘটায়। ইসলামি পরিম-লে যারা রিজালকে উপেক্ষা করছেন তাদের পরিণতি ভালো না। এবং সামগ্রিক ইসলামপন্থার জন্যও ভালো হবে না।

লেখকপত্র: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভালো ও মন্দ দুটি দিকই আছে। সামগ্রিক বিচারে ‘নিউ মিডিয়া’ কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে বলে মনে হয় কি?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোনো ভালো দিক আমি দেখি না। সাম্প্রতিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে কিছু পরিবর্তন হলেও সত্য হলো এই ধরনের স্বৈরাচার তৈরিই হতে পেরেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, জ্ঞানগত কোনো বিবেচনাতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোনো ইতিবাচক দিক আমি অন্তত দেখি না।

লেখকপত্র: তরুণদের মধ্যে পাঠের গভীরতা কমে আসছে বলে মনে করেন কেউ কেউ। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

মারুফ: এটা সত্য। আমি একবার দাওরায়ে হাদিস শেষ করা উলামায়ে কেরামের একটি বড় মজলিসে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সিরাতে খাতামুন নাবিয়্যিন বাদে অন্তত একটা সিরাতগ্রন্থ পড়েছেন এমন কে কে আছেন? আমি মারাত্মকভাবে হতাশ হয়েছিলাম। সিরাত, শরিয়াহ, মেজাজে শরিয়াহ, মাকাসিদে শরিয়াহ, সমাজ, রাষ্ট্র ও ইতিহাস নিয়ে উলামায়ে কেরামের পড়াশোনা ভয়াবহ রকম কম। এর প্রতিফল আমরা ইতোমধ্যেই ভোগ করছি। লেখকপত্র: তরুণদের যারা আপনাকে অনুসরণ করেন তাদের উদ্দেশে আপনার বার্তা কী?

মারুফ: আমাকে যারা অনুসরণ করে বা করে না সবার প্রতিই অনুরোধ থাকবে, প্রচুর পড়ুন। সিরাত, শরিয়াহ, মেজাজে শরিয়াহ, মাকাসিদে শরিয়াহ, সমাজ, রাষ্ট্র ও ইতিহাস নিয়ে বিস্তৃত পড়াশোনা করুন। এবং তার ভিত্তিতে নিজের চিন্তাকে প্রসারিত করুন। কাউকে সহজে খারিজ কইরেন না। আবার কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাসও কইরেন না। বড়দের প্রতি সম্মান রাখুন। মতভিন্নতায় মধ্যমপন্থা অবলম্বন করুন।

[লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক সাময়িকী লেখকপত্রের ২৪তম সংখ্যার সৌজন্যে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত]

আরএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ