শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫ ।। ৩০ কার্তিক ১৪৩২ ।। ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

শিরোনাম :
আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস: সহনশীলতা ছাড়া শান্তি অসম্ভব ‘শিল্প-সাহিত্যেও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দিতে হবে’ চট্টগ্রাম সমিতি কাতারের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা খতমে নবুওয়ত মহাসম্মেলনে হাজারো মেহমানকে সতেজতার স্বস্তি দিলো পিসব কাদিয়ানী ইস্যুতে সংসদীয় সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে: আল্লামা ওবায়দুল্লাহ ফারুক শিক্ষার মাঠে বৈষম্যের দেয়াল, এক পেশার দুই প্রান্তের গল্প খতমে নবুওয়তের দাবিতে একত্রিত উম্মাহ: আহমদীয়া ইস্যুতে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের দাবি কাদিয়ানী ইস্যুতে রাজনৈতিক মহলের স্পষ্ট অবস্থান চান পীর সাহেব মধুপুরী উম্মাহর ঐক্যই খতমে নবুয়তের শক্তি: মাওলানা ফজলুর রহমান আহমদীয়াদের অমুসলিম ঘোষণা সময়ের দাবি: মহিবুল্লাহ বাবুনগরী

শিক্ষার মাঠে বৈষম্যের দেয়াল, এক পেশার দুই প্রান্তের গল্প

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

||জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান||
 
বাংলাদেশের শিক্ষার মেরুদণ্ড শিক্ষক সমাজ। তাঁদের কলমে লেখাই জাতির ভবিষ্যতের রূপরেখা। কিন্তু সেই শিক্ষকেরাই আজ বিভক্ত—এক অংশ সরকারি, অন্য অংশ এমপিওভুক্ত। একই কাজ, একই যোগ্যতা, অথচ সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদায় আকাশ–পাতাল তফাৎ। এই বৈষম্য এখন শিক্ষাক্ষেত্রের নীরব ব্যাধি।
 
এমপিও (Monthly Pay Order) পদ্ধতির আওতায় থাকা শিক্ষকরা দেশের অসংখ্য বেসরকারি স্কুল–কলেজে পাঠদান করেন। তাঁরা সরকারের আর্থিক সহায়তায় বেতন পান, কিন্তু সরকারি শিক্ষকদের মতো নিশ্চিন্ত চাকরি বা পূর্ণাঙ্গ সুযোগ-সুবিধা তাঁদের জন্য অধরাই থেকে যায়। ফলে এক শ্রেণির শিক্ষক যেখানে জীবনের নিরাপত্তা ও সম্মানে নিশ্চিন্ত, অন্য শ্রেণি সেখানে প্রতিনিয়ত বঞ্চনা ও অনিশ্চয়তার সঙ্গে লড়ছেন।
 
সরকারি শিক্ষকরা তুলনামূলকভাবে উচ্চ বেতন ও ভাতা, চাকরির স্থায়িত্ব এবং অবসরের পর পেনশন সুবিধা ভোগ করেন। তাঁদের বাড়ি ভাড়া ভাতা মূল বেতনের প্রায় ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত, চিকিৎসা ভাতা মাসে ১৫০০ টাকা, আর উৎসব ভাতা মূল বেতনের পুরো পরিমাণ—১০০ শতাংশ। এই সুবিধাগুলো তাঁদের জীবনে একটি আর্থিক নিশ্চয়তা এনে দেয়, যা কর্মে প্রেরণা যোগায়।
 
অন্যদিকে, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাস্তবতা অনেক কঠিন। তাঁদের বাড়ি ভাড়া ভাতা সাধারণত স্থির হার—মাত্র ১০০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা, আর উৎসব ভাতা মূল বেতনের এক-চতুর্থাংশ। তাঁদের কোনো পূর্ণাঙ্গ পেনশন নেই। বরং চাকরিজীবনে বেতন থেকে ৬ শতাংশ অবসর সুবিধা তহবিল ও ৪ শতাংশ কল্যাণ তহবিল হিসেবে কেটে নেওয়া হয়। অবসরের পর এই টাকার একটি অংশ এককালীন হাতে এলেও, সেটি প্রায়ই বছরের পর বছর অপেক্ষার পর পাওয়া যায়। এমন অনিশ্চয়তা কেবল আর্থিক নয়—একটি জীবনের স্থিতি ও মর্যাদার সঙ্কট।
 
একই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেও এমপিওভুক্ত শিক্ষককে ‘বেসরকারি’ বলা হয়, আর সরকারি শিক্ষক পান ‘রাষ্ট্রীয় মর্যাদা’। এই সামাজিক বিভাজন শুধু বেতনের অঙ্কে নয়, সম্মানের পরিমাপে আরও গভীর। শিক্ষক সমাজের একাংশ নিয়মিত প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি ও সরকারি প্রণোদনার সুযোগ পান; অন্য অংশকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় বছরের পর বছর।
 
এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত মজবুত স্তম্ভ। গ্রামের প্রান্তিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে শহরের কলেজ পর্যন্ত তাঁদের ঘামেই শিক্ষা টিকে আছে। তাঁদের শ্রমে লাখো ছাত্রছাত্রী শিক্ষার আলো পায়। অথচ এই শিক্ষকরা মাসের পর মাস আন্দোলন করে ন্যায্য বেতন ও প্রাপ্য সুবিধা দাবি করতে বাধ্য হন—যা একটি সভ্য রাষ্ট্রের জন্য লজ্জার বিষয়।
 
অন্যদিকে সরকারি শিক্ষকরা তাঁদের দায়িত্বের ভার বহন করেন এক অন্য বাস্তবতায়। তাঁদের কাজের পরিধি বিস্তৃত, দায়ভার বেশি, কিন্তু তাঁরা অন্তত আর্থিক নিশ্চয়তার পরশ পান। তাঁরা জানেন, চাকরি শেষে পেনশন আসবে, চিকিৎসার নিশ্চয়তা থাকবে, সন্তানদের ভবিষ্যৎ কিছুটা হলেও সুরক্ষিত। এই নিশ্চয়তা শিক্ষকদের মনোবল বাড়ায়—আর সেই মনোবলই শিক্ষার মান বাড়ানোর মূল চাবিকাঠি।
 
প্রশ্ন হলো, একই পেশার মধ্যে এত বৈষম্য কেন? শিক্ষক যে শুধু পাঠদানকারী নন, তিনি সমাজ গড়ার কারিগর। তাই তাঁর মর্যাদা, সম্মান ও প্রাপ্য সুবিধা কোনো বিলাসিতা নয়—এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
যখন শিক্ষকই অসন্তুষ্ট, অনিশ্চিত ও অবমূল্যায়িত, তখন শিক্ষার মান কিভাবে উন্নত হবে?
 
বছরের পর বছর ধরে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দাবি জানিয়ে আসছেন তাঁদের চাকরি জাতীয়করণের, অথবা অন্তত সরকারি শিক্ষকদের সমপর্যায়ের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের। তাঁদের এই দাবি কেবল অর্থনৈতিক নয়—এটি ন্যায়বিচারের দাবি, মর্যাদার দাবি, একটি সম্মানজনক জীবনের দাবি।
 
রাষ্ট্র যদি সত্যিই শিক্ষার মান উন্নত করতে চায়, তবে প্রথমেই দরকার শিক্ষকের প্রাপ্য মর্যাদা নিশ্চিত করা। শিক্ষকের হাসি মানেই শিক্ষার আলো—আর বৈষম্যের দেয়াল ভাঙলেই সেই আলো ছড়িয়ে পড়বে সারাদেশে।
 
লেখক, কলামিস্ট ও শিক্ষার্থী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর
 
এলএইস/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ