||ওলিউল্লাহ মুহাম্মাদ||
গত ৬ নভেম্বর ২০২৫, বৃহস্পতিবার আছরের পর থেকেই শুরু হয় যশোরের ঐতিহ্যবাহী মাসনা মাদরাসার বার্ষিক দ্বীনি মাহফিল। টানা তিন দিনব্যাপী এই মাহফিল আজ ৯ নভেম্বর ফজরের পর আখেরি বয়ান ও হাজারো মুসল্লির অশ্রুভেজা দোয়ার মাধ্যমে পরিসমাপ্ত হয়।
প্রতিবারের মতো এবারের মাহফিলেও ছিল অভূতপূর্ব জনসমাগম—দেশের নানা প্রান্ত থেকে শিক্ষক-ছাত্র, কৃষক-শ্রমিক, ব্যবসায়ী-চাকরিজীবী, নেতৃস্থানীয় ও সাধারণ মানুষ সবাই এসে মিলিত হন এক কাতারে। তিন দিনের জন্য তারা দুনিয়াবি ব্যস্ততা ভুলে, পার্থিব চিন্তা দূরে রেখে নিমগ্ন হন এক ভিন্ন জগতে—যেখানে কেবল আল্লাহর স্মরণ, দোয়া, দুরুদ ও জিকিরের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয় চারদিক জুড়ে। শেষ রাতের তাহাজ্জুদের রোনাজারীতে কেঁপে ওঠে পুরো ময়দান, চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে অসংখ্য হৃদয়ে।
লৌকিকতা, প্রতিযোগিতা আর বাহ্যিক চাকচিক্যের এই যুগে মাসনা মাদরাসার মাহফিল যেন এক নির্মল বাতাসের পরশ। এখানে নেই রঙিন আলোর ঝলকানি, নেই লাল-নীল বাতির বাহার, নেই দামী সামিয়ানার চমক কিংবা লোকদেখানো আয়োজন। নেই রাজনৈতিক প্রভাব, নেই অর্থসংগ্রহের কোনো ঘোষণা বা কালেকশন।
বরং এই মাহফিলে আছে এক অভূতপূর্ব প্রশান্তি—দিলের সুকুন, আত্মার পরিতৃপ্তি, রুহের খোরাক।
মানুষের মাঝে দ্বীন পৌঁছে দেওয়ার দায়বদ্ধতা ও হৃদয়ের তাগিদ থেকেই প্রায় এক যুগ আগে শায়েখে মাসনা হযরত মুফতি ইয়াহইয়া সাহেব (দাঃবাঃ) দ্বীনি মেহনতের ধারাবাহিকতায় এই মাহফিলের সূচনা করেন।
আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে অল্প কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তির অংশগ্রহণে শুরু হওয়া এ প্রচেষ্টা আজ পরিণত হয়েছে এক জনসমুদ্রে।
মাত্র এক যুগের নিরলস মেহনত ও খালিস নিয়তের বরকতে এই দাওয়াতি কার্যক্রম দেশের প্রায় অধিকাংশ জেলায় জাগিয়ে তুলেছে ব্যাপক সাড়া ও আত্মিক জাগরণ।
এই মাহফিলের প্রাণ, সবার প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু—শায়েখে মাসনা, হযরত মুফতি ইয়াহইয়া (দাঃবাঃ)। তাঁর বয়ানেই যেন লুকিয়ে থাকে এক অপার্থিব আকর্ষণ। সেই বয়ানে পিপাসার্ত হৃদয় খুঁজে পায় পরিতৃপ্তি, পাথরের মত শক্ত আত্মা গলে যায় মোমের মত, পথহারা মানুষ ফিরে পায় সঠিক দিকনির্দেশনা।
হযরতের কণ্ঠে নেই প্রচলিত বক্তাদের নাটকীয় সুরের মূর্ছনা, তবুও তাঁর প্রতিটি শব্দে আছে ঐশী প্রভাব—যার ছোঁয়ায় শ্রোতারা বিমোহিত হয়ে পড়েন। বাদ মাগরিবের বয়ানের সময় পুরো ময়দান ঢেকে যায় এক অলৌকিক নীরবতায়, পোকামাকড়ের ডানার শব্দ পর্যন্ত থেমে যায় যেন। রাস্তা, দোকান, বাজার—সব কিছুই যেন নীরব এক ভক্তিময় আবহে মোড়ানো।
এই তিন দিনের সংক্ষিপ্ত সময়ে মানুষ শিখে নেয় জীবনের প্রকৃত শিক্ষা—পবিত্রতা, নামাজ, রোজা, আত্মশুদ্ধি, নৈতিকতা ও দাওয়াতের আহ্বান। কেউ পান আত্মার খোরাক, কেউ খুঁজে পান নতুন জীবনের অর্থ।
অসংখ্য তরুণ অশ্রুসিক্ত চোখে তাওবার অঙ্গীকার করে ফিরে যান নতুন উদ্যমে, অন্ধকার জগৎ ছেড়ে আলোর পথে হাঁটার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে।
প্রচলিত বাহ্যিক চাকচিক্যে ভরা মাহফিল সংস্কৃতির ভিড়ে মাসনা মাদরাসার মাহফিল আজ এক অনন্য দৃষ্টান্ত, এক উজ্জ্বল মাইলফলক।
এটি প্রমাণ করে—দাওয়াত ও তাযকিয়ার সত্যিকারের প্রভাব লুকিয়ে থাকে আন্তরিকতায়, বিনয়ে, এবং আল্লাহমুখী হৃদয়ের আহ্বানে।
মাসনা মাদরাসার এই মাহফিল যেন চিরকাল থেকে যায় আত্মিক জাগরণ ও ঈমানি প্রেরণার এক অবিনশ্বর দৃষ্টান্ত হিসেবে—কোটি মানুষের হৃদয়ে জ্বালিয়ে দিক হিদায়াতের আলোকবর্তিকা, আর ছড়িয়ে দিক নবিজি ﷺ ও সাহাবায়ে কেরামের আদর্শভিত্তিক জীবনের সুগন্ধি বার্তা।
এলএইস/