আঙিনার এক পাশে মসজিদ, অন্য পাশে মন্দির। অভিন্ন আঙিনায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন মুসল্লিরা। মন্দিরে সকাল-সন্ধ্যা চলে প্রাত্যহিক পূজা-অর্চনা। একই স্থানে দুই সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় কার্যক্রম সম্পাদনে কখনও কারও কোনো সমস্যা হয়নি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য এ নিদর্শন দেখা গেছে লালমনিরহাট, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে।
লালমনিরহাট শহরে ১৮৩৬ সালে পুরানবাজার কালীমন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৫ সালে মন্দিরের দেড় থেকে দুই ফুট দূরত্বে ওয়াক্তিয়া মসজিদ তৈরি হয়। পরে কালীমন্দিরের পাশে দুর্গামন্দির আর ওয়াক্তিয়া মসজিদ পুরানবাজার জামে মসজিদে রূপান্তরিত হয়। সেই থেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দুটি পাশাপাশি অবস্থান করে সম্প্রীতির নির্দশন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। অভিন্ন আঙিনায় মুসলিমদের জানাজা হয়। আবার লীলাকীর্তনসহ হিন্দুদের নানা অনুষ্ঠান চলে।
কালীমন্দিরের প্রধান পুরোহিত সুমন চক্রবর্তী জানান, প্রতিবারের মতো এবারও উৎসবমুখর পরিবেশে পূজা-অর্চনা হবে। নামাজের সময় মাইক ও মন্দিরের ঢাক-ঢোল বন্ধ থাকবে। নামাজ শেষে সুগন্ধি ছড়াবে ধূপের কাঠি। শুরু হবে ঢাকের বাজনা। যুগ যুগ ধরে চলা এই সম্প্রীতি আমরা ধরে রাখব।
প্রতিমা তৈরির কারিগর পল্লব মালি বলেন, মন্দিরের বাইরে পর্দা টাঙ্গিয়ে ভিতরে আমরা কাজ করেছি। প্রতিমায় তুলির শেষ আঁচরের কাজ চলছে।
সম্প্রীতির অনন্য আরেক উদাহারণ পঞ্চগড়ের জিতাপাড়া এলাকা। উপজেলা সদরের গরিনাবাড়ী ইউনিয়নের জিতাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠের এক পাশে মসজিদ ও অন্য পাশে পূজামণ্ডপ। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে এই মাঠে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করছেন মুসুল্লীরা। পাশেই পূজামণ্ডপে চলে পূজা-অর্চনা আর উলুধ্বনি। তবে নামাজের সময় মাইক বন্ধ রাখা হয়। মসজিদ কমিটি ও পুজা উৎযাপন কমিটি আলোচনার মাধ্যমে নিজ নিজ ধর্ম পালন করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা সুমন চন্দ্র রায় বলেন, জিতাপাড়া সার্বজনীন পূজামন্ডপে ২৫/৩০ বছর ধরে দূর্গোৎসব পালন করছি। পাশেই মসজিদ। মুসল্লিরা নামাজ পড়েন, আমরা পূজা অর্চনা করি। নামাজের সময় গান বাজনা, ঢাক ঢোল বন্ধ রাখি। আমাদের কখনই কোন সমস্যা হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না।
জিতাপাড়া সার্বজনীন পূজামণ্ডপের সাধারণ সম্পাদক জয়দেব বর্মন বলেন, ২৪ বছর ধরে এখানে পূজা করে আসছি। কারও কোন সমস্যা হচ্ছে না। মুসুল্লিরা আমাদের সব সময় সহযোগিতা করেন।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার কাছারী মাঠের একপাশে কাছারী মাঠ জামে মসজিদ, অন্যপাশে কাচারী মাঠ দুর্গাপূজা মন্দির। একশ গজ দূরত্বের দুইটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ৫০ বছর ধরে মানবতার অনন্য নিদর্শন হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
জানা গেছে, দেশ স্বাধীনের আগে জগদিস নারায়ন বুত বাহাদুর দুর্গাপূজা পালন করতে ছোট আকারে চালা ঘর তৈরি করেন। ফুলবাড়ী–লালমনিরহাট সড়কে জিরো পয়েন্টের পাশে কাছারী মাঠে নির্মাণ করা হয় মন্দির। আশির দশকের আগে ফুলবাড়ী বাজারে টিনসেড ঘরে নামাজ আদায় শুরু করেন মুসল্লিরা। বাজারের জন্য ঘর করায় মসজিদটি ভেঙ্গে ফেলা হয়। স্থানীয়রা চাঁদা তুলে কাচারী মাঠের পশ্চিমে দিকে টিন দিয়ে ঘর নিমার্ণ করে নামাজ আদায় করে আসছেন।
শুশিল চন্দ্র বর্মন বলেন, ১৯৪৭ সালে কেন্দ্রীয় সার্বজনীন মন্দ্রির হিসেবে এটি পরিচিত। পাশে মসজিদ রয়েছে। এতে আমাদের কোনো সমস্যা হয় না। মুসলিম ধর্মের মানুষ আমাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে।
কাছারী মসজিদ কমিটির ক্যাসিয়ার প্রভাষক আরাবুর রহমান বলেন, জন্মের পর থেকেই পাশাপাশি মসজিদ ও মন্দির দেখছি। সনাতন ধর্মের লোকজন পূজা করেন। মুসল্লিরা নামাজ পরেন। আজ পর্যন্ত এখানে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আশা করি কখনো ঘটবেও না।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেনুমা তারান্নম জানান, ফুলবাড়ীর মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। এলাকার একই আঙ্গিনায় মসজিদ আর মন্দির সম্প্রীতির সাক্ষী হয়ে আছে। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হবে। মানুষে-মানুষে ভাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতি অটুট থাকুক।
আরএইচ/