বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫ ।। ১৯ আষাঢ় ১৪৩২ ।। ৮ মহর্‌রম ১৪৪৭

শিরোনাম :
আধুনিক ইতিহাসে অন্যতম নিষ্ঠুর গণহত্যাকারী ইসরায়েল: জাতিসংঘের বিশেষ দূত জুলাই সনদ ছাড়া নির্বাচনে যাবে না এনসিপি: নাহিদ ইসলাম গুমের সঙ্গে জড়িত সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে: সেনাবাহিনী জাতিসংঘের সমকামী দূত ও কার্যালয় স্থাপন বাতিলের দাবি খেলাফতের ভোর থেকে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৭৩ ফিলিস্তিনি নিহত তাবেলা সিজার হত্যা : তিনজনের যাবজ্জীবন, চারজন খালাস হযরত মুহাম্মদ (সা.) -এর অবমাননা একটি উসকানিমূলক ও ঘৃণিত কাজ জামেয়া ইসলামিয়া মুনশীবাজারে প্রয়াত শিক্ষকদের স্মরণে আলোচনা সভা ১২ জুলাই মুহতামিম সম্মেলন সফল করতে মানিকছড়িতে মতবিনিময় সভা শুটকি মাছের পুষ্টিগুণ

নারীর প্রতি উচ্চ পদস্থ দায়িত্বশীলের অসম্মান-গালমন্দ: কী ভাবছেন ইসলামী চিন্তাবীদগণ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

নুরুদ্দীন তাসলিম।।

সাম্প্রতিক সময়ে নারীর প্রতি অসম্মান, অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করা এক উচ্চ পদস্থ দায়িত্বশীলের অডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে। নারীকে নিয়ে অশালীন বাক্য বিনিময় ছাড়াও ঐ উচ্চপদস্থ দাত্বিশীল বিগত কয়েকদিনে ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে একের পর এক বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে একের পর এক এমন বেফাঁস মন্তব্যে হৃদয়ে আঘাত পেয়েছেন দেশের সব সচেতন শ্রেণীর নাগরিক। সর্বশেষ নারী কেলেঙ্কারীর ঘটনায় ফেঁসেছেন তিনি। এতে করে শুধু সচেতন নাগরিক সমাজ নয়, প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত লেখক, সম্পাদক, কলামিস্টরাও ছেড়ে কথা বলেননি তাকে। নারীবাদীরাও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে তার কুশপুত্তলিকা দাহ করেছেন। সামাজিক মাধ্যমেও ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে বিষয়টি।

নারী আমাদের মা, বোন, মেয়ে। মা হিসেবে একজন নারীর সাথে আমাদের সম্পর্ক শ্রদ্ধা ও সম্মানের, বোন হিসাবে তার সাথে সম্পর্ক হৃদয়ের, মেয়ে হিসেবে সম্পর্কটা স্নেহের ও ভালোবাসার। স্বভাবতই কোথাও নারী অশোভন আচরণের শিকার হলে কেউ তা সহ্য করতে চাইবেন না। নিজের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবেন। বাংলাদেশের আইনেও নারীর সঙ্গে অশোভন আচরণকারীর বিরুদ্ধে রয়েছে শাস্তির ব্যবস্থা।

দেশীয় দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারা অনুযায়ী কোনো নারীর শালীনতার অমর্যাদা করার ইচ্ছায় কোনো মন্তব্য, অঙ্গভঙ্গি বা যেকোনো প্রকারের কাজই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কোনো নারীর শালীনতার অমর্যাদা করার ইচ্ছায় এ উদ্দেশ্যে কোনো মন্তব্য করে, কোনো শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি করে বা কোনো বস্তু প্রদর্শন করে যে উক্ত নারী অনুরূপ মন্তব্য বা শব্দ শুনতে পায় অথবা অনুরূপ অঙ্গভঙ্গি বা বস্তু দেখতে পায়, কিংবা উক্ত নারীর নির্জনবাসে অনধিকার প্রবেশ করে, সে ব্যক্তি এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন অধ্যাদেশের ৭৬ ধারা অনুযায়ী নারীদের উত্ত্যক্ত করার শাস্তি হিসেবে উল্লেখ আছে কমপক্ষে এক বছরের শাস্তি অথবা দুই হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী যদি যৌন কামনার উদ্দেশ্যে যৌনাঙ্গ বা অন্য কোনো অঙ্গ স্পর্শ করলে বা শ্লীলতাহানি করলে এর জন্য সর্বোচ্চ ১০ বছর সাজা এবং সর্বনিম্ন তিন বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

নারীর সঙ্গে অশোভন আচরণ ও শ্লীলহানীর বিষয়টি ইসলামের দৃষ্টিতেও জঘন্য অপরাধ। এ বিষয়ে সময়ের জনপ্রিয় ইসলামিক স্কলার ও আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমদুল্লাহ বলছেন, ‘মুক্ত করার নামে নারীকে প্রদর্শন ও পণ্যায়নের সংস্কৃতি নারীকে নিছক ভোগ্যপণ্যে পরিণত করে। আর তাই স্বভাবগত লাজ-লজ্জা বিসর্জন দিয়ে তথাকথিত ‘সাহসী’ উপাধী পাওয়া নারীর অসহায়ত্ব ও করুণ চিত্র দু-এক সময় প্রকাশ পেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থেকে যায় অপ্রকাশিত’।

তিনি বলেন, ‘মদীনার বনু কাইনুকা’র বাজারে একজন নারীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা হলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার জেরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেও পিছপা হননি’।

‘নারীকে নিয়ে কেউ বাজে চিন্তা ও অশ্লীল কল্পনা করুক সেটা কোনোভাবেই চায় না ইসলাম। আর সেজন্যই মহান আল্লাহ দৃষ্টির সংযম এবং পর্দার নির্দেশ করেছেন। নারীর ইজ্জতের দিকে নোংরা হাত বাড়ানো দূরের কথা, তার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও নিষেধ করেছে ইসলাম। নিষেধাজ্ঞার ব্যত্যয় হলে রেখেছে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা’।-বলেন এই ইসলামি চিন্তাবিদ।

‘নারী-পুরুষ সবার জন্য পরিপূর্ণ সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে একমাত্র ইসলামের ছায়াতলে। সুতরাং আসুন, আমরা ইসলামের দিকেই ফিরে আসি; পরিপূর্ণ মুমিন হয়ে উঠি। এতেই রয়েছে মুক্তি, সম্মান এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সার্বিক সফলতা’- বলেন শায়খ আহমদুল্লাহ।

এদিকে এ বিষয়ে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি জানাতে গিয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘ইসলাম নারীকে যে অধিকার ও সম্মান দিয়েছে তা অন্য কোন ধর্ম দিতে পারেনি। নারী আমাদের মা হলে তাকে সম্মানের বিষয়টি কুরআনে স্পষ্ট ভাবে এসেছে। এক্ষেত্রে কুরআনে বলা হয়েছে, ওফ শব্দও যেন করা না হয়। অর্থাৎ মায়ের সাথে ধমকের স্বরে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে কুরআনে। আবার নারী বোন হলে বাবার পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে তাকে তার অধিকার বুঝিয়ে দিতে হবে।  নারী আমার স্ত্রী হলে স্বামীর কাছ থেকে তার যে প্রাপ্য অধিকার এ বিষয়েও কুরআনে কারীমে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। স্ত্রীর সাথে কোন ধরনের জোর জুলুম নির্যাতন করা যাবে না। এমন হলে পুরুষের জন্য কঠিন শাস্তির কথা বলা হয়েছে কোরআনে ‘।

‘এর বাইরেও নারীকে সম্মান দিতে গিয়ে কুরআনে সূরা নিসা নামে একটি সূরা নাযিল করা হয়েছে। কোন পুরুষকে সম্মান দেখিয়ে সূরাতুর রিজাল নামে কোন সূরা নাজিল করা হয়নি। নারীকে ইসলাম কতটা সম্মান দিয়েছে এই বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলেই তা বুঝে আসে’ বলেন তিনি।

‘যে নারীকে ইসলামী এতো দিক থেকে সম্মানিত করেছে, পুরুষের উপর প্রাধান্য দিয়েছে, সেই নারীকে অবজ্ঞা অবহেলা, তার সাথে অশালীন আচরণ ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। তবে নারীর কাছ থেকে কোন ধরনের পদস্খলন অথবা ভুল প্রকাশ পেলে তা ন্যায় সঙ্গত ও যুক্তিসঙ্গতভাবে শুধরানোর চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু উল্টো তাকে প্রকাশ্যে অপদস্ত ও অপমানিত করা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়’।

দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে নারীর প্রতি যেই অশোভন আচরণ প্রকাশ পেয়েছে এর মাধ্যমে দেশের মানুষ কি ধরণের বার্তা নিতে পারেন এবং জনগণের প্রতি এর কেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে?

এ বিষয়ে মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলছেন, ‘দায়িত্বশীল পর্যায়ে থেকে কেউ যদি নারীর সাথে কোন ধরনের অশোভন আচরণ করে থাকেন এবং নারীকে অশ্লীলতার দিকে ধাবিত করতে জোরজবরদস্তি করার প্রচেষ্টা চালান, তাহলে তো এটা মস্তিস্ক বিকৃত মানুষের কাজ বলেই ধরে নেওয়া হবে’।

তিনি আরো যুক্ত করেন, ‘দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে এমন কিছু প্রকাশ পাওয়া মানে এই পদের প্রতি এবং নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রতি এক ধরনের অবিচার ও অন্যায় করা’।

তিনি আরো বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা আমাদের দেশের জন্য বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল’।

তিনি মনে করেন, ‘পদের  প্রভাব খাটিয়ে কাউকে অন্যায়ের দিকে দিকে প্ররোচিত করার যে চেষ্টা এতে করে অন্যায় জগত উৎসাহিত হবে, সমাজ ভুল পথে এগোবে’।

সামাজিক মাধ্যমে নারীদের নিয়ে স্পর্শকাতর অশ্লীল যে অডিও রেকর্ড ছড়িয়ে পড়ছে, দেশের কিশোর প্রজন্ম ও শিশুদের উপর এর কতটা বাজে প্রভাব পড়বে?

‘একটি সমাজকে অসুস্থ করে দেওয়ার জন্য এই বিষয়গুলো অনেকাংশে দায়ী’ বলে মনে করেন এই ইসলামী চিন্তাবিদ।

‘আমাদের আগামী প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে আরও সচেতন হতে হবে। মা-বাবার সাথে সন্তানদের সম্পর্ক আরো স্ট্রং করতে হবে। এর মাধ্যমে লাজ-লজ্জা যা একজন মুমিনের অপরিহার্য গুণ সেগুলো দূর হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। তাই এ বিষয়ে সর্বাধিক সচেতনতা প্রয়োজন ‘- বলেন মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী।

এদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য যে দায়িত্বশীল পর্যায়ে এমন কিছু অযোগ্য লোককে বসিয়ে রাখা হয়েছে যাদের কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত আমাদের বিব্রত করে চলেছে। তবে দেশের মানুষ সব সময় সচেতন ছিলেন, সব বিষয়ে অটল থেকে বিভিন্ন সময়ে জবাব দিয়েছেন তারা। দায়িত্বশীলদের অশ্লীল কর্মকাণ্ডে গা ভাসিয়ে দেননি দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ’।

তিনি আরো বলেন, ‘এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যক্তির কথায় ইসলাম ও নারীর প্রতি মানুষের কোন ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে না’।

‘নারী কেলেঙ্কারিতে ফাঁসছেন এমন অনেকেই দেখা দেখা যায় বিভিন্ন সময় নারী নির্যাতন ও নারী সহিংসতা বিরোধী বিভিন্ন কনসার্টে অংশ নিয়ে নীতির বুলি আওড়ান’- এ বিষয়ে মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘এটাই হলো তাদের স্বভাব, তারা সব সময় দ্বিমুখীতা ও ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকে। এই লোকদের সব থেকে ভয়ঙ্কর দিক হলো তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপব্যবহার করে। তারা ভেবে নিয়েছে এই চেতনার নাম বিকিয়ে সব ধরনের অপকর্ম চালিয়ে যাবে তারা। তাদের লাগাম টানার মতো কেউ থাকবে না’।

‘প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়ে দেশের চালক হিসেবে কলকাঠি নাড়ছেন এমন অনেকের মাঝেই যে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব, এ বিষয়টি সাম্প্রতিক ঘটনার মাধ্যমে আবারো দৃশ্যমান হলো। তাই প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে নৈতিক ইসলামিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রকে আবারও ভাবতে হবে’- বলেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘সর্বস্তরে মুসলিম সন্তানদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার যে দাবি আমরা দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছি, এই দাবির যৌক্তিকতা আবারও প্রমাণিত হলো। এ দাবি মানা না হলে দেখা যাবে দেশের ঘরে ঘরে এমন সন্তান জন্ম নিবে যারা দেশ, নারী ও দেশের হাজার বছরের সংস্কৃতির জন্য হুমকি’।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ