আফগানিস্তানের তালেবান সরকার সম্প্রতি শেখ সানিউল্লাহ ফারাহমান্দকে তুরস্কে আফগান রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। তালেবান এই সিদ্ধান্তকে কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা একে এখনই স্বীকৃতির পর্যায়ে না নিয়ে একটি সীমিত ও প্রতীকী অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন।
রাষ্ট্রদূতের পরিচয় অনুষ্ঠানে তালেবানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি বলেন, ‘তুরস্কের সাথে আমাদের সম্পর্ক এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার ভিত্তিতে কাজ শুরু করার জন্য আমরা এখানে একজন কূটনৈতিক রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করতে পারি।’ তিনি আরো দাবি করেন, এই সম্পর্ক স্বাভাবিক ও নিয়মিত হয়ে উঠেছে। তবে এখন পর্যন্ত তুরস্ক সরকার তালেবানের নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে কিনা, সে বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেয়নি।
নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত শেখ সানিউল্লাহ ফারাহমান্দের পূর্বের কোনো কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও তিনি কুন্দুজ প্রদেশের উলেমা কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন এবং তুর্কি বংশোদ্ভূত আফগান হিসেবে তার নিয়োগকে তালেবান সরকার প্রতীকী অন্তর্ভুক্তির বার্তা হিসেবে তুলে ধরছে। তালেবান সরকার যদিও ঘোষণা করেছিল যে তারা জাতিগত কোটাভিত্তিক সরকার পরিচালনা করে না, তথাপি এই নিয়োগ জাতিগত সংখ্যালঘুদের আশ্বস্ত করার একটি প্রচেষ্টা বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
অন্যদিকে, তুরস্কের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক গুরুত্বের কারণে এই পদক্ষেপ তালেবানদের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। চার বছর ধরে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়া সরকারের জন্য আঙ্কারার মতো প্রভাবশালী দেশের উন্মুক্ততা তালেবানদের বৈশ্বিক মঞ্চে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
তালেবানের মতে, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া, ইরান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাখস্তান, মালয়েশিয়া ও নরওয়েসহ একাধিক দেশ ইতোমধ্যে তাদের কূটনীতিকদের গ্রহণ করেছে। ভারতও মুম্বাইয়ে আফগান কনস্যুলেট তালেবানের কাছে হস্তান্তরে সম্মত হয়েছে, যদিও নয়াদিল্লি এখনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি।
তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুত্তাকি সম্প্রতি ইস্তাম্বুলে ওআইসি সম্মেলনে বক্তব্য প্রদান করেন, যেখানে তিনি আফগান অর্থনীতির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার আহ্বান জানান এবং আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জব্দকৃত সম্পদ মুক্তির দাবিও পুনর্ব্যক্ত করেন। তার ভাষণ চলাকালে তিনি বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন।
তবে বিশ্লেষক আহমেদ সাইদী মনে করেন, এই রাষ্ট্রদূত নিয়োগকে পূর্ণ রাজনৈতিক স্বীকৃতির চেয়ে কূটনৈতিক খাতায় সীমিত স্বীকৃতির পর্যায়ে দেখা উচিত। তিনি বলেন, ‘তালেবান বার্তা দিতে চাইছে যে তারা দায়িত্বশীল এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনায় সক্ষম একটি সত্তা। কিন্তু বেশিরভাগ দেশ এখনো কেবল মানবিক ও কনস্যুলার বিষয়েই তাদের সাথে যোগাযোগ রাখছে।’
সাইদীর মতে, তুরস্ক তালেবানের সাথে সম্পর্ক রাখলেও এখনো বিরোধীদের আশ্রয় দেয় এবং কৌশলগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই সম্পর্ক পরিচালনা করছে। অন্যদিকে, সাবেক আফগান কূটনীতিক ওমর সামাদ মন্তব্য করেন, এই নিয়োগ ধীরে ধীরে উন্মুক্ততার একটি পদক্ষেপ হলেও এটি তালেবান সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে বৈধতা দেয়ার সামগ্রিক মনোভাব পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় না।
সামাদের মতে, তালেবানদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে হলে প্রথমে মানবাধিকার, বিশেষ করে নারীদের অধিকার নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তার ভাষায়, ‘আফগানিস্তানের সাথে পশ্চিমা দেশের সম্পর্ক এখনো মূলত মানবিক ও কনস্যুলার সীমায় আবদ্ধ। রাজনৈতিক স্বীকৃতির জন্য তালেবানকে আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।’
সব মিলিয়ে, তুরস্কে তালেবান রাষ্ট্রদূত নিয়োগকে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে একধরনের প্রাথমিক সাফল্য হিসেবে দেখা গেলেও তা এখনই স্বীকৃতির পর্যায়ে পৌঁছেছে, এমনটি বলা যাচ্ছে না। বরং এটি প্রতীকী কূটনৈতিক কৌশল, যার মাধ্যমে তালেবান সরকার নিজেদের বৈধতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সূত্র : আল জাজিরা