জুলাই আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর উত্তরার আজমপুরে গুলিবিদ্ধ হন মো. ইমরান হোসেন। ১৮ জুলাই ইমরানের চোখ, মুখ, বাঁ-হাত ও শরীরে গুলি লাগে। ইমরান কোনোদিক দিয়েই এখন পুরোপুরি সুস্থ নন। এক চোখ হারিয়েছেন চিরদিনের জন্য। যেটি ভালো, সেই চোখও ফুলে ঝাপসা দেখছেন। দুই চোখের আলো নিভুনিভু করছে।
ইমরানকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছিল চিকিৎসার জন্য। তাতেও কোনো উন্নতি নেই। আস্তে আস্তে তার বাঁ-হাতটিও অবশ হয়ে গেছে। মেটালিক পিলেট এখনো হাতে বিদ্ধ। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ঘুরেও চিকিৎসা ছাড়া ফিরে এসেছেন। ইমরান জানান, সবখানে তিনি অবহেলার শিকার। গাজীপুরের টঙ্গীতে বাড়ি ইমরানের। তিনি এখন পরিবারের বোঝা।
সঙ্গে আলাপকালে ইমরান বলেন, কোনো আর্থিক সহায়তা চাই না, পুরোপুরি চিকিৎসা চাই। সুস্থভাবে একটু বাঁচতে চাই।
শুধু ইমরান নয়, রাজধানীর জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ১১ জন দুই চোখের দৃষ্টি চিরতরে হারিয়েছেন। আর ৪৯৩ জন চিরতরে হারিয়েছেন এক চোখের দৃষ্টি। আহতদের অভিযোগ, আজীবন চিকিৎসার জন্য হেলথ কার্ড, ভাতা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম ধীরগতিতে চলছে। সবখানে অবহেলা রয়েছে। আগের মতো মূল্যায়ন করা হচ্ছে না।
এমন বাস্তবতায় আজ ৯ অক্টোবর দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব দৃষ্টি দিবস। প্ৰতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অন্ধত্ব এবং চোখের বিকলতা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় এ দিবস। ২০০০ সালে লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক অনুষ্ঠিত সাইট-ফার্স্ট-ক্যাম্পেইনের ফলে এই দিবসের শুরু হয়। দিবসটি উপলক্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং ন্যাশনাল আই কেয়ারের পাশাপাশি চক্ষু সেবায় নিয়োজিত সংস্থা আন্ধেরি হিলফি, ব্র্যাক, সিবিএম গ্লোবাল, ফ্রেড হোলোস ফাউন্ডেশন, হার্ট টু হার্ট ফাউন্ডেশন, হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল, অরবিস ইন্টারন্যাশনাল, সাইট সেভারস, ভিশন স্প্রিং এবং এসিলর লাকসোটিকা জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি এবং বিশেষ চক্ষুসেবার আয়োজন করেছে। মানুষের চক্ষুরোগ কমানোর জন্য ন্যাশনাল আই কেয়ার এ পর্যন্ত উপজেলা হাসপাতালগুলোতে ২০০টি কমিউনিটি আই কেয়ার সেন্টার স্থাপন করে চক্ষুসেবার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া চক্ষুসেবার কাজে নিয়োজিত ১০টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান জনগণের দোরগোড়ায় চক্ষুসেবা পৌঁছে দিচ্ছে।
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তথ্যমতে, জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে চোখে গুলিতে আঘাত নিয়ে ৮৬৪ জন হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়। এর মধ্যে দুই চোখের দৃষ্টি চিরতরে হারিয়েছে ১১ জন, আর ৪৯৩ জন হারিয়েছে এক চোখের দৃষ্টি। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নেওয়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ২৮ জন দুই চোখে গুরুতর দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন। ৪৭ জন এক চোখে গুরুতর দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন। আর ৪৩ জন এক চোখে সাধারণ দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ দেওয়া জবানবন্দিতে হাসপাতালটির রেটিনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জাকিয়া সুলতানা বলেন, ‘হাসপাতালটিতে যেসব রোগী চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন, তাদের অধিকাংশই মেটালিক পেলেট, কেউ কেউ রিয়েল বুলেটে আহত ছিলেন। রোগীদের আহত হওয়ার ধরন ছিল চোখের কর্নিয়া ছিদ্র হয়ে যাওয়া, চোখের সাদা অংশ ছিদ্র হয়ে যাওয়া, চোখ ফেটে যাওয়া, চোখের রেটিনা আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া ও চোখে রক্তক্ষরণ।
এদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, পৃথিবীতে প্রায় ২২০ কোটি মানুষ অন্ধত্ব বা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতায় ভুগছে, যার মধ্যে এক বিলিয়ন মানুষের অন্ধত্ব বা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতা প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা সম্ভব।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, জুলাই আন্দোলনে আহতদের সবাইকে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে হেলথ কার্ড বিতরণ চলমান রয়েছে। সবাই এখনো পায়নি, তবে চলমান। মন্ত্রণালয় থেকে সারা দেশের হাসপাতালে চিঠি দেওয়া হয়েছে, যাতে করে আহতরা বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পায়।
তিনি জানান, আহতদের ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরিতে ভাগ করে সরকারি ভাতা দেওয়া হচ্ছে। পুনর্বাসন বিক্ষিপ্তভাবে করা হচ্ছে। অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে করছেন। তবে সমন্বিতভাবে পুনর্বাসন কাজ এখনো দৃশ্যমান হয়নি। যেমন—বেসরকারি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে দুই চোখ হারানো ১১ জুলাই যোদ্ধা ও তার অ্যাটেন্ডেন্টকে সরকারি অর্থায়নে ওমরাহ করানো হচ্ছে। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় দুই চোখ হারানো চার জুলাই যোদ্ধা ও অ্যাটেন্ডেন্ট যাচ্ছেন।
আরএইচ/