শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


কেউ পালায়, কেউ রুখে দাঁড়ায়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

অঘোর মন্ডল: নিঃসঙ্গতা। একাকিত্বতা। এসব এক সময় জন্ম দিতে পারে হতাশা। অনেকে সেই হতাশা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেন। কেউ ডুবে মরেন। কেউ হতাশাকে পেছনে ফেলে দৌড়াতে চান। আশায় বুক বেঁধে বাঁচতে চান। কেউ মুক্তি খোঁজেন জীবনের ওপারে!

সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে এসে এক ভদ্রলোকের আত্মহত্যা দারুণ তোলপাড় ফেলেছে নেট দুনিয়ায়! গণমাধ্যমেও যার ঢেউ খানিকটা আঁচড়ে পড়েছে। কেন এই আত্মহত্যা? এর ব্যাখ্যা খুঁজতে গণমাধ্যমকর্মীরা ছুটেছেন মনোবিদদের কাছে। নানামাত্রিক ব্যাখ্যা মিলেছে।

কেউ বলেছেন, বহু রকম হতাশা থেকেই এই আত্মহত্যা! কিন্তু সেই আত্মহত্যার প্রচার-প্রচারণা যেভাবে হলো; তাতে বলতেই হচ্ছে গোটা সমাজই রোগগ্রস্ত! এবং সেটাও মানসিক রোগ। ফেসবুক লাইভে এসে যে লোকটা আত্মহত্যা করেছেন, তিনি রোগী। সন্দেহাতীতভাবে রোগী।

তিনি রোগাগ্রস্ত হওয়ার কারণ পারিবারিক, ব্যবসায়িক যাই হোক, সেই রোগমুক্তির প্রেসক্রিপশনটা তিনি নিজের হাতেই লিখলেন। খরচ করলেন নিজের পিস্তলের একটা বুলেট। কিন্তু সেই মৃত্যু বা আত্মহত্যার দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করে যারা লাখ লাখ ভিউ আর ব্যবসার দিকে ঝুঁকলেন, তারা কি মানসিকভাবে সুস্থ? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই কর্মকাণ্ড কি আমাদের সমাজের সুস্থতার পরিচয় বহন করছে। যদি করত তা হলে কী আদালত থেকে নির্দেশ দিতে হতো; ডিজিটাল প্ল্যাটফরম থেকে ওই দৃশ্য সরিয়ে ফেলার।

ব্যবসায় লোকসান হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা তাকে ছেড়ে দূরে চলে গেছেন বা যাচ্ছেন। পারিপার্শ্বিকতা তার ভেতর হতাশার জন্ম দিতে পারে। আর সেই লোকটা জীবনের লড়াই থেকে পালাতে চাইছেন। যে লোকটা ভয়ে লড়াই থেকে পালাচ্ছেন, সেটা দেখার জন্য আমরা কেন ফেসবুকে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম! আমাদের মস্তিষ্কের সুস্থতাও প্রশ্নবিদ্ধ।

জীবদ্দশায় সবাই অর্থ-নাম-খ্যাতি-পরিচিতি-সুখ-শান্তি সবকিছু পেয়েও ধরে রাখতে পারেন না। কিংবা এসব সামলাতে তার সমস্যা হয়। সে কারণেই জীবন থেকে পালায়। অনেক সফল মানুষ মনপ্রাণ দিয়ে সাফল্যের পেছনে ছুটেছেন। সফল হয়েছেন। সেটা উপভোগ করেছেন। আবার অনেকে জান বাজি রেখে সাফল্যের পেছনে ছুটেছেন।

হয়তো সাফল্য পাননি। কিন্তু জীবনকে বিসর্জন দেননি। রোজ রোজ শুধু সাফল্যের জন্য জীবনকে বাজি রেখে ছুটলে ভেতর থেকে পুড়ে চাই হয়ে যেতে হবে। ভদ্রলোক যে কোনো কারণেই হোক ভেতরে ভেতরে পুড়ে গিয়েছিলেন। পিস্তলের গুলির শব্দে ভেতরের সেই আগুনটাকে নিভিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি।

জীবনযুদ্ধে হতাশা আছে। আক্ষেপ আছে। সেগুলো আড়াল করার অসাধারণ ক্ষমতাও তাদের আছে। কারণ জয়ের মন্ত্রটা তাদের জানা। জীবনের জটিলতা-সংকট-সিস্টেমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লড়াই করার পথ খুঁজে নেন তারা। পৃথিবী তাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা না করে আবর্জনা হিসেবে, সেটাই তারা মাথায় রাখেন বেশি। খুঁজে নেন বেঁচে থাকার নানা ধরনের টনিক। ইনজেকশন। যা দূর করে তার হতাশা, দুঃখ, শোক, ব্যথা, বেদনাকে। জীবনকে উপভোগের আগে তাকে দেখার নিজস্ব একটা দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে।

আসলে জীবন একটা অসামান্য অভিজ্ঞতা। সেখানে যা পাচ্ছেন তাকেই ভালোবাসতে শিখুন। তা হলে জীবন থেকে পালানোর কথা মাথায় আসবে না। জীবন একটাই। গভীরভাবে সেই জীবনের মধ্যেই থাকতে হবে। চ‚ড়ান্ত দুর্ভাগ্যেও লড়াইয়ে ভঙ্গ দিতে নেই।

হাজার ব্যর্থতার মধ্যেও হয়তো আগামীকালকের সকালটা অন্য কোনো সাফল্য নিয়ে আপনার দরজায় হাজির হতে পারে। তবে অন্যের সাফল্যে চোখ টাটাতে গেলে হতাশা বাড়বে। জীবনের ভেলায় আপনার প্রাপ্তিটুকু নিয়ে ভাসলে হতাশায় ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

পৃথিবীতে অনেক বিখ্যাত, সফল মানুষের জীবনেও নানারকম ঝড়-ঝাপটা বয়ে গেছে। শোক-তাপ-হতাশা তাদের জীবনকেও ছুঁয়ে গেছে। লোনলিনেস তাদের জীবনেও এসেছে। কিন্তু সেই নিঃসঙ্গতা থেকে তারা কীভাবে তাদের রক্ষা করেছেন! একইভাবে নিশ্চয়ই নয়। নিঃসঙ্গতা রোগ। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে সেই রোগের উৎস এক নয়। তাই সবার জন্য ওষুধও এক নয়। তবে বাঙালির কাছে এসব রোগের মহৌষধের নাম রবীন্দ্রনাথ।

মানসিকভাবে রক্তাক্ত হতে হতে কবিগুরু ডুব দিয়েছেন নিজের সৃষ্টিতেই। কী না তৈরি হয়েছে তার হাতে। দুঃখে-শোকে ভেঙে পড়া অনেক মানুষের আশ্রয়স্থল রবিঠাকুরের সৃষ্টির জগৎ। বই। নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তির বড় এক অনুষঙ্গ। বই পড়া।

বই পড়া যাদের নেশা তাদের অনেকেই বলেছেন, এই নেশা তাদের নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি দিয়েছে। বাঁচিয়েছে। বইয়ের থেকে বড় বন্ধু কে আছে? ইংরেজিতে একটা কথা আছে যার কাছাকাছি বাংলা দাঁড়ায়, বই নেভার ফেইলিং ফ্রেন্ডস! নিঃসঙ্গতা-হতাশা থেকে মুক্তির জন্য বই পড়ার চেয়ে ভালো কী আছে!

আমরা পড়ছি। প্রতিদিন পড়ছি। ধনী-গরিব-ছোট-বড় প্রায় সবাই যার হাতে একটা স্মার্ট মোবাইল আছে, তিনি পড়ছেন! এবং বই-ই পড়ছেন। সেটা মুখবই। ফেসবুক। অন্যের মুখ পড়েই আমরা এখন সমাজকে দেখতে চাইছি। সেই সমাজে নিজের অবস্থান বিচার করতে চাইছি! মার্ক জুকারবার্গ আমাদের পড়া শিখিয়েছেন। ছবি দেখা শিখিয়েছেন। নিজের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সুযোগ করে দিয়েছেন।

কিন্তু তিনি আর তার বন্ধুরাই আবার বলছেন, তাদের সৃষ্টি সেই ‘মুখবই’ হয়তো কয়েকটা প্রজন্মকেই মূর্খ করে দিচ্ছে! গেল ৪ ফেব্রুয়ারি মুখবইয়ের জন্মদিন ছিল। কত মানুষ তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন জানি না। তবে এই ফেসবুকে কত মানুষ তাদের বন্ধু-বান্ধবকে কত রকম শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। কারও মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছেন। আলোর গতিকে পেছনে ফেলে ফেসবুকের সৌজন্যে কত খবর দ্রুত গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। এবং একজন ব্যবসায়ী মহসীন সাহেবও সেটা জানতেন। তাই আত্মহত্যার আগে তিনি ফেসবুক লাইভে এলেন। কথা বললেন। তার পর বুলেটের শব্দে নিজেকে থামিয়ে দিলেন। তিনি যদি প্রাক-ফেসবুক জমানায় এই কাজটা করতেন, তা হলে তিনি কি এভাবে খবরের শিরোনাম হতেন! নিশ্চয়ই না। একজন পরিণত মানুষের এভাবে আত্মহত্যা হয়তো ‘অপমৃত্যু’র সাইনবোর্ড বুকে নিয়ে সময়ের কোলে হারিয়ে যাবে। কিন্তু সমাজের বুকে বড় একটা ক্ষত রেখে যাচ্ছে। আদালতের নির্দেশে হয়তো সোশ্যাল মিডিয়া থেকে তার সেই মৃত্যুর দৃশ্য সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মানুষের মন থেকে? সেটা সরে যেতে সময় লাগবে।

মৃত্যু মানুষের কাছে অনভ্যস্ত এক অনুভূতির নাম। প্রাণ থাকলে প্রাণ চলে যাবে। এটাই জীবনের ভবিতব্য। পৃথিবীর সব জীবের নিয়তি এক। মৃত্যুকে কেউ পোষ মানাতে পারে না। খানিকটা দার্শনিকতা নিয়ে অনেকে অনেকভাবে মৃত্যুর কথা বলেন। কিন্তু মৃত্যুর কাছ থেকে মুক্তির পথ কিন্তু কোনো যুক্তি-তর্কে নিহিত নেই। তবে জীবনের কাছে হারতে হবে ভেবে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণে কোনো বীরত্ব নেই। গৌরবও নেই।

যুক্তি-মন-মনন সব মিলিয়ে দুর্বিপাকগুলোকে সামাল দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারলে ‘হিট উইকেট’ হতে হয় না জীবনের বাইশগজে। একজন মহসীন সাহেব, আপনি নিজেই নিজের উইকেট ছুড়ে দিয়ে গেলেন! এবং সেটা ইচ্ছাকৃত হিট উইকেট। আপনার জীবনের সার্থকতা কী থাকল।

ফেসবুকে শান্তগলায় আপনার আবেগতাড়িত কথা, আর বুলেটের জোরালো শব্দ কী বারতা দিয়ে গেল আমাদের সমাজে! অর্থ-যশ-খ্যাতি-সম্পদের পেছনে ছুটে আমরা অনেকেই পারিবারিক সম্পর্কের বাঁধনটা আলগা করে ফেলছি। জীবনে শুধু ছোটা নয়। মাঝে মধ্যে ব্রেকও দরকার।

স্যোশাল মিডিয়া আমাদের অনেক কিছু শেখাচ্ছে। দেখাচ্ছে। জানাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কী শিখছি। কী দেখছি। কী জানছি। মানতেই হবে সোশ্যাল মিডিয়া এখন অনেক পাওয়ারফুল। এটাকে ব্যবহার করে কেউ তার আত্মহত্যার খবরও দুনিয়ার কাছে ছড়িয়ে দিয়ে যায়। আবার এই সোশ্যাল মিডিয়া এক প্রতিবাদী তরুণী মুসকানকেও চিনিয়ে দিয়ে যায়। হিজাবের দোহাই দিয়ে কারও শিক্ষা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদটা কী হতে পারে। একাও জীবনে লড়াই করা যায়, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এক মুসকানকে দেখে সেটাও আমরা জানলাম।

নিঃসঙ্গতার কারণে আত্মহত্যা! এই খবর এক সময় মন থেকে ডিলিট হয়ে যাবে। কিন্তু জীবনে লড়ে যাওয়া মানুষগুলোর লড়াইয়ের খবর খুব তাড়াতাড়ি ডিলিট করা যায় না মন থেকে। সেগুলো অনেক মানুষকে জীবনযুদ্ধে লড়াইয়ের অুনপ্রেরণা জোগায়। তাই সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারটা যেন আমরা বোকার মতো করে না ফেলি। টাকা-ভিউ-শেয়ার-লাইকের লোভে ন্যূনতম বিচারবুদ্ধিকে বিসর্জন না দিই।

লেখক, সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর