সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫ ।। ১৬ আষাঢ় ১৪৩২ ।। ৫ মহর্‌রম ১৪৪৭


গীবত ও তুহমত

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ আবদুল হামিদ।।

গীবত কি?
‘গীবত’ আরবী শব্দ। এর অর্থ: পরনিন্দা, অপরের দোষ বর্ণনা করা। অর্থাৎ একজনের দোষ অন্যজনের কাছে প্রকাশ করা, বর্ণনা করা। গীবত হলো কোন মানুষের এমন আচরণ তার অগোচরে বর্ণনা করা, যা সে খারাপ জানে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী সা. বলেছেন, তোমরা কি জানো- গীবত কি? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ভালো জানেন।

এরপর রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, তোমার ভাই সম্পর্কে এমন আলোচনা করা, যা শুনলে সে দুঃখিত হবে। একজন সাহাবি বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি কি মনে করেন যে, আমি যা বলছি, তা যদি তার মধ্যে থাকে? রাসুল সা. বললেন, তুমি যা বলছো, তা যদি তার মধ্যে থাকে, তাহলে তা হবে গীবত আর যদি না থাকে, তাহলে তা হবে তুহমত। [মুসলিম ২/৩২২]।

গীবতের বিভিন্ন ধরন রয়েছে। যেমন- কোন ব্যক্তির দৈহিক বা চারিত্রিক কিংবা আকার-আকৃতি বিষয়ক দোষ আলোচনা করা, বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে তার কর্মকান্ড তুলে ধরা ইত্যাদি।

তুহমত কি?
‘তুহমত’ অর্থ: কারো ওপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়া, কুৎসা রটনা করা, বদনাম করা, কারও চারিত্রিক স্খলনের অভিযোগ করা, কামাচার ও ব্যভিচারের জন্য দোষারোপ করা ইত্যাদি। কোন ব্যক্তির এমন দোষ বর্ণনা করা বা অভিযোগ করা যে দোষ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে নেই। সাহাবায়ে কেরাম গীবত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা.-কে বললেন, হুজুর! যদি সত্যিই তার মধ্যে সে দোষ থাকে তাহলেও কি তা বলা গীবত হবে? রাসূল [সাঃ] বললেন, সত্য সমালোচনাই গীবত আর মিথ্যা হলে তা ‘তুহমত’ যা গীবত অপেক্ষা আরও ভয়ংকর।

গীবত ও অপবাদের ক্ষতিকর প্রভাব:
অপবাদ সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য হিসেবে তুলে ধরে। অপবাদ মানুষকে কোনো কারণ ছাড়াই অপরাধী হিসেবে বানায়। মানুষের সম্মান ও ব্যক্তিত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সুস্থ্য সামাজিক পরিবেশ বিনষ্ট করে। গীবত সাধারণত একটি হালকা এবং গুরুত্বহীন ব্যাপার মনে হয়। সমাজে মানুষের মান-ইজ্জত নিয়ে অহেতুক নাক গলানো একটি সহজ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন, দুষ্ট লোকজন কীভাবে আপবাদ ও গীবতকে ব্যবহার করে ছোট-বড় সামাজিক দূর্ঘটনা ও কোন্দল সৃষ্টি করে। গীবত ও অপবাদ সমাজে ভাইরাসের মত ক্রিয়া করে। একটি সুস্থ্য সমাজ ব্যবস্থায় পঁচন ধরায়।

চর্বনকারীরা নিজের চরিত্র নিয়ে ভবে না; বরং অন্যের দোষ খোজতে ব্যস্ত থাকে। সভ্য, ভদ্র মানুষকে অন্যের কাছে সন্দেহের পাত্র বানায়। এমনকি অন্যের কাছ থেকে অশুভ তথ্য শোনার পর সৎ, ভদ্র, ভালো মানুষটিকে অন্যরা খারাপ মনে করে। এতে করে মানুষে মানুষে মারামারি হানাহানি শত্রুতা সৃষ্টি হয়। অন্যের প্রতি মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসা অন্তর থেকে মুছে যায়। পারস্পরিক সুস¤পর্ক বিনষ্ট হয়। সামাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। কোন মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নয়। মানুষের ভূলগুলো তার অগোচরে অন্যের কাছে বলে বেড়ানো খুবই মন্দ স্বভাব। এর পরিণতি ভয়াবহ।

গীবতের ভয়াবহ পরিণতি:

গীবত করা কবীরাহ গুনাহ। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, ‘গীবত ব্যবিচারের চেয়েও মারাত্মক অপরাধ।’ আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন গীবত বা পরনিন্দাকে মারাত্মক ঘৃণিত কাজ বলে উল্লেখ করেছেন। এ কাজ থেকে দূরে থাকার জন্য মানবজাতিকে কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। গীবত করাকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন।

আল-কুরআনে আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন বলেন, “তোমরা একে অপরের গীবত কর না। তোমাদের কেউ কি স্বীয় মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ পছন্দ করে? অনন্তর তোমরা তা অপছন্দই কর।” [সূরা হুজুরাত ১২]।

এই আয়তে মৃত মানে অনুপস্থিত এবং গোশত খাওয়া মানে দোষচর্চা করা। মৃত মানুষের গোশত খাওয়া যেমন ঘৃণীত তেমনি গীবত করাও ঘৃণীত কাজ। একজন ‘মৃত’ ব্যক্তির শরীর থেকে গোশত খুলে নিলেও মৃত ব্যক্তি যেমন কোনো প্রতিবাদ করতে বা বাধা দিতে পারে না তেমনি একজন ‘অনুপস্থিত’ ব্যক্তির নামে হাজারটা সত্য/মিথ্যা দোষের কথা বর্ণনা করে গেলেও অনুপস্থিত থাকার কারণে সে ঐসব কথার কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না কিংবা নিজের স্বপক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারে না।

অথচ এসব কথা তার সাক্ষাতে বলা হলে সে নিশ্চয়ই আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিছু না কিছু বলতো। নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মত রুচি কেবল অসভ্য জংলী মানুষদেরই হয়ে থাকে। সভ্য মানুষের সমাজে মানুষ হয়ে মানুষের গোশত খাওয়ার কথা শোনা যায় না।

সভ্য, ভদ্র, সুশীল ও সামাজিক মানুষের পক্ষে যেমন নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া কোনো স্বাভাবিক আচরণ নয় তেমনি গীবত বলা বা শোনা কোনো মুসলিম ভদ্রলোকের পক্ষে স্বাভাবিক আচরণ নয়। উল্লিখিত আয়াতের ভাষ্য অনুযায়ী গীবত চর্চা করা একটি অসভ্য আচরণ।
কুরআন মজিদে আরও বলা হয়েছে, ‘দুর্ভোগ [জাহান্নাম] ওইসব ব্যক্তির জন্য, যারা পশ্চাতে ও সমুখে সমালোচনা করে, দোষ অনুসন্ধান ও নিন্দাচর্চা করে।’ [সুরা হুমাজাহ-১]।

এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ সা. ইরশাদ করেছেন, মিরাজকালে আমি এমন কিছু লোকের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখগুলি পিতলের তৈরি, তারা তা দিয়ে তাদের মুখমন্ডল ও বক্ষগুলিকে ছিঁড়তে ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা হে জিবরীল? তিনি বললেন, এরা তারাই যারা মানুষের গোশত খেত (গীবত করতো) এবং তাদের ইজ্জত-আবরু বিনষ্ট করত। [আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ]।

যে মানুষের দোষত্রুটি অন্বেষণ করে আল্লাহ তার দোষত্রুটি অন্বেষণ করেন। হজরত আবু বরয়া আসলমি রা. থেকে বর্ণিত। রাসুল সা. বলেন, হে ঐ সকল লোক! যারা মুখে ঈমান এনেছে অথচ অন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি, তোমরা গীবত করো না এবং অন্যের দোষত্রুটি অন্বেষণ করো না। কারণ, যে তাদের দোষত্রুটি অন্বেষণ করবে, মহান রাব্বুল আলামিন তার দোষ অন্বেষণ করবেন। আর আল্লাহপাক যার দোষত্রুটি অন্বেষণ করবেন, তাকে অপদস্থ করে ছাড়বেন। [আবু দাউদ: ২/৩২৯]।

গীবত করা এবং শোনা দু’টোই সমান অপরাধ। সুতরাং গীবত তো করা যাবেই না; এমনটি গীবত শোনা থেকেও বিরত থাকতে হবে। সর্বনাশা গীবতের অনিষ্ট থেকে বাঁচতে শেখ সাদী রহ. বলেছিলেন, ‘কারো কাছ থেকে উপকার আশা করি না। শুধু এতটুকু চাই যে- সে যেন সর্বনাশ করে না বসে।’

অপবাদের শাস্তি ও পরিণতি:
তুহমত বা মিথ্যা অপবাদ দেওয়া রাসুলুল্লাহ সা.-এর বর্ণিত কয়েকটি ধ্বংসাত্মক কবিরা গুনাহ’র একটি। এ জন্য ঘোষিত হয়েছে কঠোর হুঁশিয়ারি। কেউ যদি কোনো মুমিন সতী নারীর ওপর ‘মিথ্যা অপবাদ’ দেয়, আর তা প্রমাণ করতে চার জন স্বাক্ষী উপস্থিত করতে না পারে তাহলে শরিয়তে ৮০টি বেত্রাঘাতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর কোনদিন তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না।’ (সূরা নূর- ৪)।

অপবাদ আরোপকারীদের দুনিয়া ও আখিরাতে লানত এবং আজাবের দুঃসংবাদ দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির ওপর অপবাদ আরোপ করে, সে নিজের মাথায় বহন করে জঘন্য মিথ্যা ও প্রকাশ্য গোনাহ।’ [সুরা নিসা, আয়াত ১১২]।

পবিত্র হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার উদ্দেশ্যে এমন কথা বললো, যা তার মধ্যে নেই, তাহলে এমন ব্যক্তিকে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’লা জাহান্নামে বন্দী করে রাখবেন যতক্ষণ না সে তার কথার সত্যতা প্রমাণ করে দেবে।’ [তিবরানি]।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরো বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে অধিক ঘৃণার পাত্র ওইসব লোকেরা, যারা দুর্নাম রটনা করে এবং অপর ভাইদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে।’ কাউকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া এমনই একটি পাপ যার কোন কাফ্ফারা হয় না। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে এমন দোষে দোষারোপ করবে, যা থেকে সে মুক্ত। আল্লাহপাক তাকে “রাদগাতুল খাবাল” নামক জাহান্নামের গর্তে স্থান করে দেবেন, যতক্ষণ সে অপবাদ থেকে ফিরে না আসে।’

সুতরাং গীবত ও তুহমত জঘন্য পাপ। এ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। পাশাপাশি গীবত শোনা থেকেও সাবধান থাকতে হবে। কোনো চর্বনকারীকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। একথা নিশ্চিত, যে ব্যক্তি আপনার সামনে অন্যের দোষ স¤পর্কে বলে থাকে সে অবশ্যই অগোচরে অপর ব্যক্তিকে আপনার দোষও বলাবলি করবে।

লেখক: জামেয়া আনওয়ারে মদিনা, পশ্চিম ভাটপাড়া, ইসলামপুর সিলেট।

-এটি


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ