শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


ইসহাক ফরিদীর ভাষ্যে দাওয়াতের আইডল আবুল কালাম রহ.

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাসউদুল কাদির।।

আমার প্রিয় উস্তাদ মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ফরিদী রহ. একবার আমাদের হবিগঞ্জ-মাধবপুর-নাসিরনগর এলাকায় মাহফিলে গেলেন। এখন ঠিক আমি বলতে পারবো না, হুজুরের কোন ছাত্র তাকে অনেক যত্নআত্তি করে নিয়ে গেলেন। মাহফিলের প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি।

সেই মাহফিলের স্থানীয় জনপ্রিয় বক্তা হিসেবে দাওয়াত পেয়েছেন মাওলানা আবুল কালাম চুনারুঘাটী। যদিও তার জন্মস্থান চুনারুঘাট নয়। নাসিরনগরের কালীউতা গ্রামে। চুনারুঘাটে থাকতে থাকতে চুনারুঘাটী হিসেবে তিনি খ্যাতি পেয়েছেন। হবিগঞ্জের ভাষার সঙ্গে অসাধারণ প্রতিভাধর মাওলানা আবুল কালাম ছিলেন জাদুর কাঠির মতো। জাদুর মতোই তিনি হবিগঞ্জের মানুষকে টানতে পারতেন। হবিগঞ্জের মানুষ কোন জিনিসকে কীভাবে ডাকেন, কখন কীভাবে বুলি আওরান, মহিলাদের শব্দ ব্যবহারও তিনি জানতেন। হবিগঞ্জবাসীর এমন হৃদয়ের ভাষায় আর দ্বিতীয় কেউ ওয়াজ করেন বলে আমার জানা নেই।

আদতে হবিগঞ্জের হৃদয়গ্রাহী ভাষায় বয়ান করেন অনেকেই। সত্যি বলতে কি মাওলানা আবুল কালামের ক্ষেত্রে সবাই যেনো নস্যি। তিনি ছিলেন একজন পারফেক্ট আঞ্চনিক বক্তা। আমি একবার আমাদের গ্রামে পেছনে বসে ওয়াজ শুনছিলাম। মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা মোস্তাফা আল হোসাইনী ওয়াজ করছিলেন। একজন বৃদ্ধকে উঠে যেতে দেখে আমি ডাক দিলাম। বল্লাম, চলে যাচ্ছেন কেন? তিনি বললেন, বুঝি নারে বাবা। অথচ মোস্তাফা আল হোসাইনী কী দারুণ গতিশীল বয়ান করছিলেন। আমার মতো ছোটবয়সী অনেকেই ওয়াজ শুনছিল। ঘটনাটা ২০/২২ বছর আগের হবে বৈকি।

আমি বলতে চাচ্ছিলাম, দাওয়াতের জন্য ভাষা খুবই বড় একটি বিষয়। ভাষায় পারদর্শী না হলে দাওয়াতের কাজ ভালোভাবে করা কঠিন। দারুল উলূম দেওবন্দ শুরুর পর থেকে বহু ভাষায় পারদর্শি করে গড়ে তোলার ভাষাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো। বহুভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা আজও অব্যাহত আছে। আজকে উর্দু জানলে পশ্চিমা বিশ্বে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশী তরুণরা। অনেক ক্ষেত্রে আরবির চেয়েও বেশি। এখন জাদিদ আরবিতে পারদর্শি হয়ে উঠছে আমাদের তারুণ্য। এটা নিশ্চয়ই আশার কথা। মাদরাসায়ও ইংরেজি ভাষার ক্লাস বেড়েছে। শিক্ষার্থীদের আগ্রহও আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের গণমাধ্যমেও বহুভাষা চর্চায় মাদরাসাগুলোতে যেসব ভাষা পড়ানো হয়-এর প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে।

যা হোক, হবিগঞ্জের মাটি ও মানুষের হৃদয়ের ভাষা পড়তেও জানতেন মাওলানা আবুল কালাম রহ.। দক্ষতা ও মুন্সিয়ানার সঙ্গে তা বলতেও পারতেন । মাঠের ওয়াজের শ্রোতার তুলনায় কোনো অংশেই পর্দার আড়ালের মা-বোনরা শ্রোতা হিসেবে কম ছিলেন না। রীতিমতো জোঁকের মতো নারীরাও ওয়াজের প্যান্ডেলের আশাপশের বাড়ি-ঘরে ভিড় জমাতেন। এসব আমি নিজেই দেখেছি। কারণ, মাওলানা আবুল কালাম প্রতিবেশি গ্রামেরই বাসিন্দা ছিলেন। আমাদের খড়কী গ্রামকে তিনি নিজের গ্রামের মতোই মনে করতেন। সকাল নেই বিকেল নেই- দাওয়াত দিলেই তিনি ছুটে আসতেন। দাওয়াতি কাজের একটা দরদিয়া মন ছিলো তার।

গ্রামে-গঞ্জে থেকেও দ্বীনের বড় দায়িত্ব পালন করাদের অন্যতম তিনি। যদিও জাতীয় পর্যায়ে তাকে অনেকেই হয়তো চেনেন না, জানেন না। কিন্তু সত্যিকার দ্বীনী দাওয়াতের ময়দানের অনেক বড় সিপাহসালার ছিলেন তিনি। নিঃসন্দেহে বলা যায়, তার বিয়োগের মাধ্যমে কেবল ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হবিগঞ্জ নয় দেশ একজন প্রকৃত দ্বীনের দায়ীকে হারালো।

গত ২৭ জুলাই মঙ্গলবার রাত ১২.১৫ টায় নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন মাওলানা আবুল কালাম। তিনি একটি মাদরাসার পবিত্র হাদিসের উস্তাদ ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের চাপরতলা ইউনিয়নের কালীউতা গ্ৰামে তিনি জন্মগ্ৰহণ করেন।

আমার উস্তাদ হযরত ইসহাক ফরিদী রহ.-এর কথা বলছিলাম। হুজুর একদিন আমাদের ক্লাসে বললেন, আমাকে এত সম্মান দেখিয়ে মাহফিলে নেয়া হয়েছিল যে, আমিও খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু বয়ানের ক্ষেত্রে, ওয়াজের ময়দানে তো আমি শিশু। হবিগঞ্জ অঞ্চলের ভাষার ক্ষেত্রেও আমার জানাশোনা নেই। আমাকে যখন মাহফিলে বয়ান করতে দেয়া হলো তখন পুরো মাঠজুড়ে মানুষ আর মানুষ। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম, ততক্ষণে অনেক মানুষ কমে গেছে। বয়ানের মধ্যেই ভাবলাম, যত বেশি সময় নেবো ততই মানুষ কমে যাবে। ভাষাগতই হোক বা যেকোনো কারণেই হোক লোকজন চলে যাচ্ছে। আমি আর দেরি না করে মাইক ছেড়ে দিলাম। আমার ছাত্রের মাহফিলটা যেনো সুন্দর থাকে সেই চিন্তা করলাম। পরে মাওলানা আবুল কালাম নামের স্থানীয় এক মাওলানাকে আনা হলো বয়ানে। ঘড়ি ধরে পাঁচ মিনিট হবিগঞ্জী ভাষায় বয়ান করলেন। আবারও মাঠ পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। কী অদ্ভূত এক জাদুর কাঠির সুরে পত্রপল্লবিত হলো যেন মাঠ। মাঠে তিলধারণের ঠাঁই নেই। স্থানীয় ভাষার শক্তি দেখলাম সেখানে।

আমি আসলে বলছিলাম, আঞ্চলিক ভাষার ওয়াজের আইডল ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম রহ.। স্থানীয় পর্যায়ে এমন আইডল এখনো অনেক আছে। তবে সবক্ষেত্রে সবারই বিশ্বায়ন জরুরি নয়। যিনি দাওয়াতের মানসিকতায় কাজ করেন তার কোনো পরাজয় নেই। একদিনের দাওয়াত বা এক মুহূর্তের দাওয়াত যদি আল্লাহ কবুল করেন তাহলেই তো ‘ফুজতু ওয়ারাব্বিল কাবা’র মতো সফল হয়ে যাবেন তিনি। মহান আল্লাহ আমার প্রিয় উস্তাদ মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ফরিদী রহ. ও মাওলানা আবুল কালাম রহ.কে কবুল করুন। আমীন।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, দৈনিক আমার বার্তা ও প্রেসিডেন্ট, শীলন বাংলাদেশ।

-এএ


সম্পর্কিত খবর