শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


বিনয় ছিল তার জীবনের অনন্য দ্যুতি: মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

নুরুদ্দীন তাসলিম।।

‘বিনয় ছিল আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ.-এর জীবনের অনন্য দ্যুতি। দেওবন্দী ওলামায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত ছিল তার জীবন ’।

শায়খুল হাদিস আল্লামা কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ রহ. বর্ণাঢ্য জীবন চর্চা ও গবেষণা সপ্তাহ- ২০২১ উপলক্ষ্যে জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল আওয়ার ইসলাম ২৪. কম আয়োজিত বিশেষ লাইভ অনুষ্ঠান ‘আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ রহ.; দেওবন্দিয়াত ও আল্লামা মাদানী রহ. এর চিন্তাধারা’য় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এ মন্তব্য করেন জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ী মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন।

অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন আওয়ার ইসলাম সম্পাদক মুফতি হুমায়ুন আইয়ুব।

অনুষ্ঠানে মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন বলেন, ‘৫ বছর আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ.-এর সান্নিধ্যে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। ১৯৮৩ সালে মালিবাগ জামিয়ায় হেদায়া জামাতে ভর্তি হই, সেখানে ৪ বছর পড়ে দেওবন্দে যাই, এরপর হুজুরের তত্ত্বাবধানেই মালিবাগে শিক্ষক হিসেবে ছিলাম। আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ. ছিলেন দেওবন্দ ও দেওবন্দীয়াতের অনন্য চেতনাধারী’।

দেওবন্দ-এর নাম নিলে অনেকে ফেরকাবাজি দলাদলি বুঝাতে চান। বিষয়টা আসলে এমন নয়। তারিখে দেওবন্দ কিতাবে ক্বারী তৈয়্যব সাহেব রহ. বলেছেন, ‘দেওবন্দিয়াত হল, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বহুমুখী ফিকির, কর্মকাণ্ডের মাঝে সমন্বয় করে চলা। আকায়েদ,সিয়াসাত, তাসাউফ সব ক্ষেত্রেই তাদের অনুসরণ করা। কোন একটা অনুসরণ করতে গিয়ে আরেকটা ছেড়ে না দেওয়া এবং ভারসাম্য রক্ষা করা’।

মুহাদ্দিস মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন বলেন, ‘আকাবিরে দেওবন্দের মধ্যে যাদেরকে আমরা পেয়েছি তাদের কারো মাঝে ভারসাম্যহীনতা ছিলনা, অর্থাৎ শুধু কোন একটা দিক নিয়ে তারা ভেবেছেন, একটাকে ধরেছেন ,আরেকটাকে বর্জন করেছেন, এমন ছিল না তাদের কারো জীবনে। সবকিছুর মাঝে সমন্বয় করেছেন দেওবন্দী ওলামায়ে কেরাম এবং এটার নামই দেওবন্দিয়াত। ক্বারী তৈয়্যব সাহেব রহ. -এর বক্তব্যের মাধ্যমে এই বিষয়টাই স্পষ্ট হয়’।

দেওবন্দী আকাবিরদের আদর্শের বণর্না দিতে গিয়ে লাইভ অনুষ্ঠানে তিনি আরো বলেন,  ’দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়াত ‘ শিরোনামে মালিবাগ জামিয়ায় একবার একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়, আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ. দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন সেখানে। দেওবন্দিয়াতের পরিচয় দিতে গিয়ে আলোচনায়  তিনি  ক্বারী তৈয়্যব সাহেব রহ. -এর বক্তব্যের  সাথে একটা  বিষয় যুক্ত করেছিলেন। হযরতের বর্ণনা ছিল অনেকটা এমন, ‘দেওবন্দিয়াত হল মোটা ভাত, কাপড়, এবং সাদাসিধা জীবন ও নিরহংকার থাকার নাম’।

মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন বলেন, দেওবন্দী ওলামায়ে কেরাম ইলমি বিষয়ে যতটা উচ্চ অবস্থানে ছিলেন তাদের কথাবার্তা, আচার-আচরনে কখনো তা প্রকাশ পায়নি।

দেওবন্দি আকাবিরদের বিনয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘খাতামুল মুহাদ্দিসীন হযরত আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ.- এর মতো ব্যক্তিত্ব যার সম্পর্কে আল্লামা শিব্বির আহমদ ওসমানী রহ. ফাতহুল মুলিম-এর মুকাদ্দামায় বলেছেন, জগতের কোন চোখ তার মতো ব্যক্তিত্বকে দেখেনি; এমনকি তিনি নিজেও তার ব্যক্তিত্বকে দেখেননি কখনো। এতবড় ব্যক্তিত্ব তারপরও আত্মগোপনে থাকতেন; কোথাও কখনো কোন বিষয়ের তাহকীক নিয়ে লম্ফঝম্পও করতেন না।

তিনি বলেন, ‘আমরা প্রায় সময় দেখতে পাই, অনেক ফেরকার লোকজন লাফালাফি করতে থাকে, বলতে থাকে হানাফী মাযহাবের অমুক বিষয়ে কোন দলিল নেই,  কুরআন-হাদিসে কোথাও এ বিষয়ে স্পষ্ট কোন বর্ণনা নেই। তাদেরকে যখন দেখিয়ে দেওয়া হয়- অমুক জায়গায় এ বিষয়ে সহি হাদিস আছে; তখন তারা একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যায়। প্রথমে মারার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে আসে, এরপর দলিল দেখিয়ে দিলে একেবারে চিৎপটাং হয়ে যায়। উলামায়ে দেওবন্দ কখনো এমন করেন না। নিরবে কাজ করেন তারা। পোশাক-আশাক, ঘরবাড়ি কোন কিছুতে আড়ম্বর নেই তাদের, সবকিছুতেই সাদেগী। দেওবন্দী ওলামায়ে কেরামের জীবন বিশ্লেষণ করলে তাই খুঁজে পাওয়া যায়। আমরা আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ.-কে এমনই পেয়েছি।

লাইভ অনুষ্ঠানে মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন তার প্রিয় উস্তাদ  কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ.-এর বিনয় ও সাধাসিধে জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘আমরা যখন মালিবাগ জামিয়ায় পড়েছি তখন বেফাকের ১ম, ২য়, ৩য় সিরিয়ালগুলো বেশিরভাগ সময় মালিবাগের ছাত্রদের দখলেই থাকতো। তখনকার প্রায় সব ওস্তাদ অনেক বেশি যোগ্য ছিলেন তারপরও কোন বিষয়ে খটকা লাগল তারা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ.-এর কাছে গিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতেন; কিন্তু হযরত কখনো নিজের ইলমি যোগ্যতা অন্যের সামনে ফুটিয়ে গর্ববোধ করতেন না।

স্মৃতিচারণে তিনি আরো বলেন,  ‘ হযরতের দরসে আমরা খেয়াল করেছি, কোন বিষয় বুঝাতে গিয়ে তিনি কখনো বলতেন না, এই বিষয়টার তাশরিহ অমুকেএভাবে করেছেন, তার তাশরিহটা গলত বা তাশরিহকারী বিষয়টি বুঝতে পারেননি। অনেক ক্ষেত্রে নিজের কোন তাহকীক থাকলে তা পেশ করতেন; তবে তা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিনয় বজায় রাখতেন।

কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ.-এর বিনয় ও সাধাসিধে জীবনের চাক্ষুস সাক্ষী মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন  প্রিয় উস্তাদের সাথে নিজের একান্ত একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ‘ আমরা তখন জালালাইনে পড়ি। হযরত লেখালেখি করতেন। একবার কোন একটা শব্দে হযরত আটকে গিয়েছিলেন। হুজুর এসে আমাদের রুমের সামনে দাঁড়ালেন। বললেন, হেমায়েত! এমন একটা শব্দ বল, যার অর্থ হবে অবশ্যই করতে হবে, না করলে নয়; দুটোর অর্থ একসাথে বুঝাবে। ‘অবশ্যই’ শব্দটা শুধু করতে হবে বোঝায়, কিন্তু না করলে নয় এটা বোঝা যায় না।

তখন আমি বললাম, হযরত অনিবার্য বলা যেতে পারে। হযরত একটু লম্বা করে টেনে তার স্বরে বললেন, ঠিক বলেছ। আমরা সবাই অবাক, বিস্ময়ে থ বনে গেলাম, এত বড় একজন মানুষ, একটা শব্দের জন্য ছাত্রের কাছে চলে এসেছেন!

তিনি বলেন, আমাদের দেওবন্দী আকাবির  ইয়াকুব নানুতবী রহ.-এর সর্ম্পকেও শুনেছি, তিনি ছাত্রের কাছে ছুটে যেতেন। এই যে বিনয়, সাধাসিধে জীবনযাপন, যার উপস্থিতি সম্পূর্ণরূপে ছিল কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ.-এর মাঝে, এটাই দেওবন্দী ওলামায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য।

এমডব্লিউ/কেএল


সম্পর্কিত খবর