শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


মেয়ের বাড়ির ইফতার: অমানবিক প্রথা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতী এইচ এম আবু বকর সিদ্দীক।।

গত ২০ এপ্রিলের একটি খবরে আমাদের অনেকের চোখ আটকে গেছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় বাবার বাড়ি থেকে রমাদানের ইফতারি না দেয়ায় শফিক নামের এক যুবক তার স্ত্রী আখি বেগমকে বেদম মারধর করেন।

আখি বেগমের মা রাহিমা বেগম গণমাধ্যমে বলেন, ‘মেয়েকে মারধরের কথা শুনে স্বামীকে নিয়ে জামাইয়ের বাড়িতে যাই। বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্রই আখির শাশুড়ি আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত হন। একপর্যায়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে সফিক, তার বাবা-মা চেয়ার দিয়ে এলোপাতাড়ি আমাদের মারধর শুরু করেন। মেয়ে আমাদের বাঁচাতে এগিয়ে এলে সবাই মিলে তার ওপর নির্যাতন চালান।’

তিনি আরও বলেন, ‘মারধর শেষে কয়েক ঘণ্টা ঘরের মধ্যে আমাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন তারা। পরে স্থানীয়রা আমাদের উদ্ধার করে কলাপাড়া হাসপাতালে ভর্তি করেন।’

মেয়ের বাবার বাড়ি থেকে জামাই বাড়িতে রমাদানে ইফতার পাঠানো নামক কুসংস্কারের জঘন্য উদাহরণ এটা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাহে রমাদানকে কেন্দ্র করে এই কুপ্রথা এখন শেকড় গেড়েছে। অনেকে মনে করে থাকেন, মেয়ের বাবার বাড়ি থেকে জামাই বাড়িতে বাহারি ইফতার পাঠালে শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের মুখ উজ্জ্বল হয়, তাকে সবাই ভালোবাসে। তাই ঋণ করে হলেও জামাই বাড়িতে মেয়ের বাবা মা জৌলুসপূর্ণ ইফতারি পাঠায়। শুধু অশিক্ষিত পরিবারগুলোতেই যে এর ছড়াছড়ি তা নয়, সমাজের সাধারণ শিক্ষিত এমনকি ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত পরিবারেও লেগেছে এই অভিশাপের ছোঁয়া।

মাওলানা সাইমুম সাদী নামক একজন সচেতন আলেম তার ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘এক অভিনব আবেদন এসেছে আমার মেসেঞ্জারে। যিনি পাঠিয়েছেন তিনি একজন মসজিদের ইমাম। চার মেয়ে ও দুই ছেলে রয়েছে তার।

ইমাম সাহেব রমজান মাসে চার মেয়ের বাড়িতে ইফতারি পাঠাতে চান। কিন্তু তার কাছে সেই পরিমাণ টাকা নেই। খুব অল্প বেতন পান মসজিদে। সেই বেতনে নিজেই চলতে পারেননা। চার মেয়ের শশুরবাড়িতে ইফতারি পাঠাতে কমপক্ষে বিশ হাজার টাকা লাগবে। এই টাকা ম্যানেজ করতে পারছেননা। তাই কিছু সাহায্য চাচ্ছেন।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, চার মেয়ের জামাইরা কি করেন? তিনি যা জানালেন তাতে বুঝলাম, জামাইয়ের দুইজন ব্যবসা করেন, একজন মধ্যপ্রাচ্যে চাকুরী করে এবং একজন বেকার অবস্থায় আছে। কিন্তু এই অবস্থায়ও মেয়ের বাড়িতে ইফতার দিতে হয় বাধ্যতামূলক। না দিলে অনেকটা যৌতুকের মতই মেয়েকে বিভিন্ন রকম মানসিক অত্যাচারের সম্মুখিন হতে হয়।

ইফতারি নামক এই অন্যায় কালচারের বিরুদ্ধে আমাদের কথা বলা উচিত। যারা বিবাহিত তাদের উচিত এই ঘোষণা দেওয়া যে, আমি শশুরবাড়ি থেকে এই বাধ্যতামূলক ইফতারি নেবনা ইনশাআল্লাহ। এটা স্পষ্টত অত্যাচার। যৌতুকের মতই একটি লজ্জাজনক চাওয়া।’

আসলে ইসলামের বিধান মতে একটি মেয়েকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সঠিক পাত্রস্থ করার পরে বাবা মায়ের উপরে তার কোনো দায়িত্ব বর্তায় না। স্ত্রী হিসেবে তার সবধরনের প্রয়োজন স্বামীই পূর্ণ করবে। সভ্য সমাজের একজন মানুষ হিসেবে স্ত্রীর পরিবারের প্রতি স্বামীর এজন্য কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত যে, সচেতনতার সাথে বাবা মা তাদের মেয়েকে আদর্শ শিক্ষা দিয়েছেন, নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রেখেছেন, কতো আদর যত্নে তাকে বড় করে যোগ্য স্ত্রী হিসেবে তার হাতে তুলে দিয়েছেন। সুতরাং এধরণের অন্যায় চাহিদার বিরুদ্ধে সবাইকে সচেতন হতে হবে।

তাছাড়া মাহে রমাদান মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাহর জন্য রহমত ও মাগফিরাতের বাার্তা বয়ে আনে। এই মাসে সবধরনের গোনাহের জন্য যেমন ক্ষমা চাইতে হয় তেমনি সবরকমের গর্হিত কাজ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। কারণ, এই মাসে সওয়াব করলে যেমন তার ফজিলত বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়া হয় তেমনি হারাম কাজের বিপরীতেও অধিক গোনাহ ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়। আর মেয়ের বাড়ির ইফতারের মতো জবরদস্তি মূলক আবদার অবশ্যই হারাম। এর মাধ্যমে মানুষকে কষ্ট দেয়া, অন্যায় দাবির মতো ভয়াবহ গোনাহের কাজ সংঘটিত হয়ে থাকে।

তবুও যারা মনে করেন, এজাতীয় কাজে পারস্পরিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। তারা খাদ্যসামগ্রীর আদান প্রদান বাদ দিয়ে আত্মীয়-স্বজনরা পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কের স্থায়িত্ব ও বারাকাহ লাভের নিমিত্তে বেশি বেশি দোয়ার আবেদন ও নেক আমলের আদান প্রদান করুন। এতে মহান আল্লাহ অবশ্যই খুশি হয়ে কাঙ্খিত বারাকাহ দান করবেন।

যাদের সামর্থ্য আছে তারও এই প্রথাকে বর্জন করুন। কারণ, আপনার দেখাদেখি অন্যরাও যাতে এই কাজে উৎসাহিত না হয়। এটা না করলে কোনো পাপ নাই বরং একটি পাপ প্রথাকে রহিত করার উদ্দেশ্যে বিরত থাকলে আপনিও সওয়াবের অংশীদার হবেন ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমীন।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ