মুহাম্মদ হাসান মুরাদ
খলিফা ওমর বিন আব্দুল আযিয রহ.।দ্বিতীয় ওমর হিসেবে যিনি পরিচিত ও প্রসিদ্ধ।ন্যায়-নীতি ও আদর্শে ছিলেন দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রা. এর প্রচ্ছদ ছবি। ৬১ হিজরীতে জন্ম ।মাত্র ৪০/৪১ বছর হায়াত পেয়েছিলেন।দুই বছর পাঁচ মাস খেলাফতে অধিষ্ঠিত ছিলেন।এই সামান্য সময়ের শাসনে পৃথিবী বাসীর জন্য আদর্শ শাসকের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
হাল যামানার শাসকেরা হয়ত তাকে আদর্শ পুরুষ বানাবেন না।তবে ইতিহাস সাক্ষী ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থা এমন অনেক শাসকদের জন্ম দিয়েছে যা অন্য মতাদর্শের কেউ দিতে পারেনি। আর এটা সম্ভব হয়েছে ইসলামের সৌন্দর্যের আলোতে।আজকের প্রবন্ধে শাসক ওমর বিন আব্দুল আযিয রহ. এর জীবনের নীতি-আদর্শপূর্ণ কিছু অজানা বিষয় জানার প্রয়াশ মাত্র।
১.ওমর বিন আব্দুল আযীয রহ. খেলাফতের বায়াত পূর্ণ করলেন।এবার আসন সমাসীন হওয়ার পালা । রাজকর্মচারীবৃন্দ গার্ড অফ অনার এর জন্য প্রস্তুত।লাল গালিচা বিছানো হল।কিন্তু খালিফা তা অস্বীকার করলেন।দামী গালিচা তুলে ফেলার নির্দেশ দিলেন।কক্ষের উন্নত পর্দা বিক্রি করে তা বায়তুল মালে জমা করে দিলেন।অন্যান্য প্রজাদের মত সাধারণ জীবন যাপন শুরু করলেন।
২. খলিফা হওয়ার পূর্বে ওমর বিন আব্দুল আযিয রহ.এর বিভিন্ন উসৎ থেকে মাসিক আয় ছিল ৪০ হাজার দিনার।খলিফা হয়ে তিনি নিজের এবং স্ত্রীর অলংকারসহ যাবতীয় সম্পদ বায়তুল মালে জমা করে দিলেন।নিজের মাসিক ভাতা নির্ধারণ করলেন মাত্র ৩০০দিরহাম।মোটা কাপড় পরতেন।জামা খুব ময়লা না হলে পরিবর্তন করতেন না। অনিন্দ সুন্দরী স্ত্রী সঙ্গ ,উন্নত খাদ্য বর্জন করলেন।আড়াই বছরের খেলাফত কালে কখনো ফরজ গোসলের প্রয়োজন হয়নি।নিজের কাজ নিজেই করতেন।
৩.নিজ ও সন্তনদের জন্য কোন প্রাসাদ নির্মাণ করেননি। কোন সম্পদও সঞ্চয় করেননি। খলিফার ১২ সন্তান ছিল।একবার একান্ত প্রিয় কিছু মানুষ বললেন, হযরত! অন্তত সন্তানদের জন্য কিছু করে যান।তখন খলিফা কোরআনের এই আয়াত পাঠ করলেন; “আমার সহায় তো হলেন আল্লাহ,যিনি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন।বস্তুত:তিনিই সৎকর্মশীল বান্দাদের সাহায্য করেন”(সুরা-আরাফ-১৯৬) এ আয়াত পড়ে উপস্থিত লোকদের বললেন,যদি আমার সন্তানগণ নেক হয় তবে তাদের দায়িত্ব আল্লাহ নিজেই নিয়েছেন।
আমার ভাবনার কিছু নেই।আর যদি তারা অসৎ হয় তবে আমি অসৎব্যক্তিদের জন্য কিছু করতে চাইনা। আল্লামা ইবনে কাসির রহ.বলেন, পূর্ব খলিফা সুলাইমান বিন আ.মালেক নিজ সন্তনদের জন্য অনেক সম্পদ রেখে গিয়েছলেন।কিন্তু এক সময় তারাই ওমর বিন আব্দুল আযীয রহ.এর ছেলেদের কাছে হাত পাততেন।
৩.খলিফার মৃত্যু সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তারই এক আযাদকৃত গোলাম খাদ্যে বিষ প্রয়োগ করে তাকে হত্যা করে। শত্রæপক্ষ এ জন্য গোলামকে এক হাজার দীনার দিয়েছিল।মৃত্যু পূর্বে খলিফা তার সে গোলামকে ডাকালেন।বললেন নির্বোধ! কিসে তোমাকে এ কাজে প্রয়োচিত করেছে।সে বলল,এক হাজার দীনর।খলিফা তার থেকে এক হাজার দীনার ফেরত নিয়ে, বাইতুল মালে জমা করে দিলেন।আর তাক বললেন, তুমি পালিয়ে এমন স্থানে চলে যাও, যেখানে তোমকে কেউ দেখবে না। আর মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই থাকবে।
৪. একদিন খলিফার শিশু ছেলে সমবয়সীদের সাথে খেলতে বের হল।খেলার সময় একটি বালক খলিফা পুত্রের মাথাই আঘাত করল।লোকেরা বালকটিকে ধরে খলিফার কাছে নিয়ে আসল।বালকটির মা তখন খলিফার কাছে মিনতি করে বলল,আমার ছেলে পিতৃহীন।খলিফা মহিলাকে আশ্বস্ত করে বললেন,তুমি শান্ত হও।উদ্বিগ্ন হয়ো না।এর পর খলিফা মহিলাটিকে রেশন দিলেন। বালকটিকে এতিমদের তালিকভুক্ত করে নিলেন।এহেন আচরণে স্ত্রী ফাতিমা বিনতে আব্দুল মালিক কিছুটা পতিবাদ করলেন।খলিফা স্ত্রীকে ভর্ৎসনা করে বললেন, সে পিতৃহীন আর তোমরা তাকে আতঙ্কগ্রস্ত করছ।
৫.একদিন এক ব্যক্তি খলিফার সাথে মন্দ আচরণ করল।খলিফা তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য উদ্যত হলেন।কিন্তু খলিফা নিজেকে সংযত করলেন।এরপর খলিফা লোকটিকে বললেন,তুমি আমাকে শাসকের ক্ষমতা দ্বারা বিভ্রান্ত করতে চেয়েছ।আমি তোমার সাথ দুর্ব্যবহার করব,আর তুমি কিয়ামতের দিন আমার থেকে বদলা নিবে? যাও! তোমাকে অব্যাহতি দিলাম। তোমার সাথে বিবাদ করার প্রয়োজন আমার নেই।
৬. তীব্র গরম। দাসি খলিফাকে  বাতাস দিচ্ছে।দাসি নিজেও গরমে হাসফাস করছে।গরম আর ক্লান্তি নিয়ে দাসিই ঘুমিয়ে গেল।এবার খলিফা নিজেই দাসিকে বাতাস করতে লাগলেন।আর বললেন, তুমিও অনেক গরম সহ্য করেছ।এখন আরাম কর।
৭.খলিফার স্ত্রী ফাতিমা বলেন,একদিন আমি খলিফার সাথে সাক্ষাতের অনুমতি চাইলাম।গিয়ে দেখি খলিফা জায়নামাজে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন।চেহারায় মলিনতা।বিষন্নতা।আমি বললাম,আপনি এতো চিন্তিত কেন? খলিফা বললেন ফাতিমা! আল্লাহ তোমার বোধদয় করুন। এই উম্মতের কী গুরু দায়িত্ব আমি গ্রহণ করেছে তুমি তা ভেবেছ? ক্ষুধার্ত দরিদ্র,মুমূর্ষ রোগী,বস্ত্রহীন কষ্টে নিপতিত,পিতৃহীন বিপর্যস্ত, নিঃসঙ্গ বিধবা,নির্যাতিত নিপীড়িত, আশ্রয়হীন,বন্দী,অতি বৃদ্ধ আরো বিপন্ন মানব যারা আমার সা¤্রাজ্যের দিকদিগন্তে ছড়িয়ে আছে, তাদের সকলের চিন্তা আমাকে সর্বদা ভাবিয়ে তোলো। পরকালে তাদের সম্পর্কে আমি জিজ্ঞাসিত হলে কি উত্তর দিব?
৮.খলিফা আল্লাহর ভয়ে এতো বেশি কাঁদতেন যে, তার চোখ দিয়ে পানির বদলে রক্ত পড়ত। ৯. খলিফা একটি কথা খুব বলতেন। হায়! মানুষ তাকওয়ার কথা অন্যকে বলে, কিন্তু নিজে তাকওয়ার উপর চলে না।
তথ্যসূত্র: আল-বিদয়া ওয়ান নিহায়া ৯/৩০৫-৩৪৮
 
                              
                           
                              
                           
                         
                              
                           
                        
                                                 
                      
                                                  
                                               
                                                  
                                               
                                      
                                         
                                      
                                         
                                      
                                        