শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


সৃষ্টিতে স্রষ্টার পরিচয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতী কামরুজ্জামান।।

ইমাম কুরতুবী রহ. তার তাফসীরে জাফর বিন মুহাম্মাদ থেকে একটি রেওয়ায়েত এনেছেন- ইমাম ছা’লাবী কিতাবুল আরাইজে উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ তা’য়ালার এক ফেরেস্তা আছে যার নাম হল হিযকিয়াইল, যাকে আল্লাহ ১৮ হাজার ডানা দিয়েছেন, এক ডানা থেকে আরেক ডানার দূরত্ব হল ৫০০ বছরের রাস্তা, কেউ তাকে বলল তুমি কি পুরো আরশটাকে দেখার ক্ষমতা রাখো? তখন আল্লাহ তার ডানাকে দ্বিগুন করে দিলেন এখন তার ৩৬ হাজার ডানা হল এবং দুই ডানার দুরত্ব ৫০০ বছরের রাস্তা। এরপর আল্লাহ তাকে বললেন হে ফেরেস্তা তুমি উড়ো ফেরেস্তা ২০ হাজার বছর উড়তে থাকলো।

কিন্তু আরশের কোন পায়ার মাথা পর্যন্ত পৌছতে পারলো না। অতপর আল্লাহ তাকে ডানা ও সামর্থ আরো বাড়িয়ে দিয়ে উড়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। অতপর সে ৩০ হাজার বছর উড়তে থাকল কিন্তু সে আরশের পায়ার মাথা পর্যন্ত পৌছতে পারলো না। তখন আল্লাহ বললেন হে ফেরেস্তা তুমি সিঙ্গায় ফুক দেয়া পর্যন্ত তোমার ডানা ও সামর্থ সহ উড়তে থাকো তবুও আমার আরশের খুটির পা পর্যন্ত পৌছতে পারবে না। তখন ফেরেস্তা বলে উঠলো “সুবহানা রব্বিয়াল আ’লা”। অতপর আল্লাহ নাযিল করলেন سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى অতপর নবী কারীম সা. বললেন একে সিজদায় পড়। অর্থাৎ “সুবহানা রব্বিয়াল আ’লা” ।

মহান আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেন:- سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى (১) الَّذِي خَلَقَ فَسَوَّى (২) ...الخ

পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। হে নবী আপনি আপনার মহান রবের মহিমা ঘোষণা করুন যিনি সৃষ্টিজীবকে সৃষ্টি করেছেন এবং করেছেন ভারসম্যপূর্ণ,সামাঞ্জস্যপূর্ণ,সুন্দর। মুসনাদে আহমাদে হযরত উকবা ইবনে আমের রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যখন فسبح باسم ربك العظيم

আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন রাসূল সা. আমাদেরকে বলেন এটাকে তোমরা রুকুতে (পড়ার জন্য) নির্ধারণ করে নাও। অতপর যখন سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى

আয়াত অবতীর্ণ হল তখন রাসুল সা. বলেন এটাকে তোমরা সিজদায় নির্ধারণ করে নাও। আর যিনি নির্ধারণ করেন কে হবে ভগ্যবান ও কে হবে হতভাগা। অতপর প্রত্যেক সৃষ্টিজীবকে পথ নির্দেশ করেছেন। আর যিনি সকল প্রকার উদ্ভিদ সৃষ্টি করেছেন।

এ সূরার শুরুতে আল্লাহ তা’য়াল তার নবীকে স্বীয় রবের মহিমা ঘোষণা করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। সাথে সাথে মহান রবের কয়েকটি বৈশিষ্টও বর্ণনা করেছেন।আল্লাহ তা’য়ালা বলেন হে নবী আপনি আপনার মহান রবের মহিমা ঘোষণা করুন। রব বলা হয়, যিনি সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা, পালনকর্তা।

সেই রবের মহিমা ঘোষণা করুন যিনি সৃষ্টি করেছেন। “খলক” বলা হয় কোন সৃষ্টিকে নাস্তি থেকে হাস্তিতে আনা। তার পরে তাকে সুগঠিত করা। অর্থাৎ প্রত্যেক মাখলুকের অঙ্গ-প্রতঙ্গ যে পরিমান হওয়া উচিত ও যেখানে স্থাপন করা দরকার সেটাকে সেখানে সুচারু রুপে স্থাপন করেছেন। প্রত্যেককে সুন্দর অবয়ব দান করেছেন। সেই রবের মহিমা ঘোষণা করুন। তিনি প্রত্যেক সৃষ্টির ভালো-মন্দ ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন। তারপর তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে চলার পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। ভালো-মন্দ সব বিষয়ে তাকে নির্দেশনা প্রদান করেছেন। وَالَّذِي أَخْرَجَ الْمَرْعَى

আর যিনি গাছ-পালা, তরুলতা ও উদ্ভিদ রাজি (যমীন ফেড়ে) অংকুরিত করেছেন। অতপর সেগুলো শুকনো কালো খরকুটায় পরিনত করেছেন। এ আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা এ বিষয়ে ইংগিত করেছেন যে, মানুষসহ প্রত্যেক সৃষ্টির জীবনে বসন্তকাল আসবে। যখন তার মধ্যে তারুন্যের জোয়ার দেখা দিবে, তারপর এক সময় সব মানুষই জরাজীর্ন ও বার্ধক্যের অনিবার্য বাস্তবতার সম্মুখিন হবে।

سَنُقْرِئُكَ فَلَا تَنْسَى

হে নবী আপনাকে আমি অচিরেই পড়িয়ে দিবো ফলে আপনি ভুলবেন না। এ আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট হল নবীজী সা. ওহি নাযিলের সুচনা লগ্নে কুরআনে কারীমের আয়াত, আয়ত্ব করার জন্য তারাহুড়া করতেন। যাতে করে ভুলে না যান। পরবর্তীতে আল্লাহ তা’য়ালা সুরা কিয়ামার উদ্ধৃত আয়াত গুলো নাযিল করেন।

لَا تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ (১৬) إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ (১৭) فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ (১৮) ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ (১৯)

হে নবী আপনি তরিত গতিতে কুরআন আয়ত্বের জন্য আপনার জিহবাকে সঞ্চারিত করবেন না। নিশ্চয়ই তা সংরক্ষণ ও পড়িয়ে দেয়া আমার দায়িত্ব। সুতরাং আমি যখন আপনাকে পড়িয়ে দিবো আপনি আমার পড়া অনুসরণ করুন। অতপর এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন করে দেয়া আমার দায়িত্ব।

আলোচ্য আয়াতে এবিষয়ে ইংগিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন অচিরেই আমি আপনাকে পড়িয়ে দিবো। ফলে আপনি ভুলবেন না। তবে আল্লাহ যেটা ভুলিয়ে দেয়ার ও রহিত করে দেয়ার ইচ্ছা করবেন তা ব্যতিত। إِنَّهُ يَعْلَمُ الْجَهْرَ وَمَا يَخْفَى নিশ্চয় তিনি প্রকাশ্য-গোপন সব বিষয়ে জানেন। কে প্রকাশ্যে গুনাহ করে আর কে গোপনে গুনাহ করে আল্লাহ তা’য়ালা সবই জানেন।

وَنُيَسِّرُكَ لِلْيُسْرَى আর হে নবী আপনাকে আমি শরীয়তের জন্য সহজ করে দিবো। অর্থাৎ শরিয়তকে আপনার স্বভাব ও মেজাজের উপযোগী করে দেবো। এভাবে তালিম, তরবিয়াত, তাযকিয়া ও দাওয়াত ও তাবলীগ এর কাজও সহজ করে দিবো।

فَذَكِّرْ إِنْ نَفَعَتِ الذِّكْرَى আপনি তাদেরকে উপদেশ প্রদান করুন যদি উপদেশ তাদের জন্য ফলপ্রসূ হয়। অর্থাৎ আপনি উপদেশ ধারাবাহিক ভাবে প্রদান করতে থাকুন। যাতে করে এক সময় উপদেশ তাদের কাজে আসে।

سَيَذَّكَّرُ مَنْ يَخْشَى (১০) وَيَتَجَنَّبُهَا الْأَشْقَى (১১) যে আল্লাহকে ভয় করে সে অচিরেই উপদেশ গ্রহণ করবে। আর এর থেকে দুর্ভাগা ব্যক্তিই কেবল দূরে থাকবে। যে মহা আগুনের মধ্যে প্রবেশ করবে, অতপর সে তাতে মরবেও না বাচবেও না। অর্থাৎ সে বাচার মত বাচবেও না আবার একেবারে মরবেও না।

قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى (১৪) وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّهِ فَصَلَّى (১৫) মহান আল্লাহ বলেন সফল ঐব্যক্তি যে তার আত্বাকে শুদ্ধ করেছে, অর্থাৎ আহকামাতের উপর আমল করেছে ও সমস্ত গুনাহ থেকে বিরত থেকেছে এবং তার রবের নামে যিকির করে অতপর নামাজ আদায় করে।

بَلْ تُؤْثِرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا তোমরা তো দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে থাকো অথচ আখেরাতের জীবনই হচ্ছে উত্তম ও স্থায়ী। অর্থাৎ দুনিয়ার সব কিছুই অসম্পূর্ণ ও অস্থায়ী এবং আখেরাতের সব নিয়ামত পরিপূর্ণ ও স্থায়ী।

إِنَّ هَذَا لَفِي الصُّحُفِ الْأُولَى নিশ্চয় এটা পূর্ববতী ছহীফা। তথা ইবরাহীম আ. ও মুছা আ. এর ছহীফায় রয়েছে। এ আয়াতের দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে। ১. তোমরা আখেরাতের সব নিয়ামত উত্তম ও স্থায়ী হওয়া সত্বেও দুনিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে থাকো, এ কথাটা ইবরাহীম আ. ও মুছা আ. এর ছহীফা গুলোতে রয়েছে। ২. এ সূরার মধ্যে যে বিষয়গুলো সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে তা ইবরাহীম আ. ও মুছা আ. এর ছহীফা গুলোতে বিদ্যমান রয়েছে।

লেখক: মুহতামমি- জাময়িা আরাবয়িা শামসুল উলুম- ফরদিপুর ও সেক্রেটারী, বেফকুল মাদারসিলি আরাবয়িা ফরদিপুর জেলা।


সম্পর্কিত খবর