বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫ ।। ১৯ আষাঢ় ১৪৩২ ।। ৮ মহর্‌রম ১৪৪৭

শিরোনাম :
এ মাসের মধ্যেই জুলাই সনদ চূড়ান্ত করতে হবে: খেলাফত মজলিস মহররম-আশুরার শিক্ষা ও ইতিহাস পিলখানায় বিজিবির বৃক্ষরোপণ অভিযানের উদ্বোধন করলেন মহাপরিচালক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন সম্ভব না : এ্যানি ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ৩৫৮ বৃষ্টির দিনে ভিজে গেলে তাড়াতাড়ি কাপড় শুকানোর কার্যকর উপায় হারানো ৯০০ স্মার্টফোন উদ্ধার করে মালিকদের হাতে হস্তান্তর  আধুনিক ইতিহাসে অন্যতম নিষ্ঠুর গণহত্যাকারী ইসরায়েল: জাতিসংঘের বিশেষ দূত জুলাই সনদ ছাড়া নির্বাচনে যাবে না এনসিপি: নাহিদ ইসলাম গুমের সঙ্গে জড়িত সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে: সেনাবাহিনী

সায়ীদ উসমানের অনুবাদে মির্জা গালিব: প্রেম ও আধ্যাত্মিকতার অপূর্ব সম্মিলন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শামস আরেফিন

বিখ্যাত লেখকদের রচনা পড়ে পাঠক আলোড়িত হন। লেখকের মতো পাঠক ভাবতে শেখেন। আর সেই বিখ্যাত পূর্বসূরীর লেখা পড়ে পরবর্তী সময়ে তার পরপুরুষ লেখক সে রকম লেখার চেষ্টা করেন।

আবার অবাক করার বিষয়- সেই বিখ্যাত লেখকের লেখায় প্রভাবিত হয়ে, লেখা পাঠ করে আমরা সাধারণ পাঠকরাও আলোড়িত। তাই অমর কবিতা পড়ে সাধারণ মানুষের মনের খোরাক যেমন জোটে, ঠিক তেমনি অমর কবিতা পাঠ করে একজন লেখকের লেখার খোরাকও জুটতে পারে।

যেমন গালিবের শের

বিরহের স্বাদ প্রিয় আমার/মিলনের স্বাদ চাই না তাই
কবির জুটুক বিরহ আর/ মিলনের স্বাদ পাক সবাই।

প্রথমত কেন কবি বিরহ পেতে চান? মিলনকে তিনি কেন ভয় পান। কারণ আমরা অনেকেই জানি “ভালোবাসা মিলনে মলিন বিরহে উজ্জ্বল হয়।”

এখন প্রশ্ন হতে পারে কোথা থেকে আমরা এ কবিতা জানলাম। উত্তরটা খুব সোজা। আর তা হলো যে জ্বলে আগুন জ্বলের কবি হেলাল হাফিজ থেকে।

কারণ কবিরা জানে, বিরহের আগুনে পুড়লে তিনি প্রেমিক হিসেবে খাঁটি সোনা হতে পারবেন। তিনি হতে পারবেন খাঁটি প্রেমিক। পাবেন আরও কয়েকটি ভালোবাসার কবিতা।

তাই হেলাল হাফিজের এই কবিতার ভাবার্থকে যদি সারংশ হিসেবে দাঁড় করানো চেষ্টা করি- তবে তা সত্য হবে গালিবের এই রুবাইয়াৎ এ।

অথবা বলুন প্রিয়াকে চাঁদের সাথে তুলনা করা, পূর্ণিমা হিসেবে মেয়েদের নাম রাখা, বা জোৎস্না হিসেবে মেয়েদের নাম রাখা বা কবিতায় এবং গানে বলা “লোকে বলে আমার ঘরে চাঁদ উঠেছে/ নাগো না আমার বন্ধু এসেছে” এই যে উপমা তা কিন্তু এই গালিবের হাত দিয়ে প্রথম এসেছে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনাই প্রকট। যেমন

প্রভুর এ কোন কারিশমা সে/আমার ঘরে আজ এসেছে
এসো এসো দেখো সবাই/ আমার ঘরে চাঁদ উঠেছে।

মির্জা গালিব প্রেম ও আধ্যাত্মিকতার অপূর্ব সম্মিলন। তার এ প্রেম ও আধ্যত্মিকতা আমাদের এক অনন্য ভালোবাসার জোয়ারে ভাসতে সাহায্য করে। মিলন ও বিরহ এ দুইয়ের যে চিত্রায়ন তিনি করতে পেরেছেন, তা অনন্য। তার উদাহরণ উপস্থাপন অন্য কারও পক্ষে কঠিন।

যেমন গালিব যখন বলেন- লালন তখন বলেন-

মিলন হবে কখন কবে/প্রিয়ার স্মৃতি নেই তো মনে
প্রেমের ফাগুন জ্বাললো আগুন/ছাই হলো সব সেই আগুনে।

মিলন হবে কত দিনে/ আমার মনের মানুষের সনে
মেঘের বিদ্যুৎ মেঘে যেমন/ লুকালে না পায় অন্বেষণ।

কালারে হারায়ে তেমন/ ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে।
আমার মনের মানুষের সনে।

আর এখানে যদি আমরা লালনের “মিলন হবে কত দিনে” গানটিতে এই দুই মহামানব নিজেকের প্রেমিকাকে কাছে না পেয়ে আহত হৃদয়ে কবিতা বা গান লিখেছেন।

একজন দ্বারস্থ হয়েছেন গজলের বা রুবাইয়্যাতের। আর একজন দ্বারস্থ হয়েছেন গানের। তবে একজনের মনে ফাগুন এলে প্রেমের আগুন জ্বলে, অন্য জনের মেঘের বিদ্যুতের মতো জ্বলে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন।

একজন লালন যখন প্রেমিকাকে না পেয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন, একজন গালিব সেখানে নিজেকে প্রেমের আগুনের পুড়ে ছাই হিসেবে অস্তিত্বহীন খুঁজে পান। আর এভাবে একসাথে লালনের গান ও গালিবের গজল যদি পাঠ করি, তবে তার ভাবের সামাঞ্জ্যসতা উপলব্ধি করতে সহজ হবে।

প্রেমকে গালিব যতভাবে সজ্ঞায়িত করেছেন, ততভাবে খুব কম কবিই সজ্ঞায়িত করেছেন। সম্ভবত এ কারণে যে কোন পৃথিবীর যুগল যদি কোন কবিতা পড়ে প্রেমে পড়ে, তবে সেই কবিতা গালিবের হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।

প্রেম সাধারণ মানুষের আবেগের সর্বোচ্চ প্রকাশ। আর মানুষ যখন আবেগের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে, তখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এ কারণে বলতে হয়, যে প্রেমে পাগলামি নেই, তা প্রকৃত প্রেম নয়।

আর এ পাগলামি যুক্ত প্রকৃত প্রেম কী রকম হতে পারে, তা বোঝা যায় গালিবের রুবাইয়্যাত পাঠ করে। কারণ গালিবই প্রেমের ও বিরহের প্রকৃত অবস্থা সহজ ও সাবলিল ভাষায় উচ্চারণ করতে পারেন।

এ প্রেম রস আস্বাদন করতে গিয়ে বর্তমানে যে কোন কবির পাঠে সাধারণ পাঠক হারিয়ে যান। তবে এক্ষেত্রে আধ্যাত্মিকতা ও প্রেমের সংমিশ্রণে মাওলানা রুমি অদ্বিতীয়। তারপর সম্ভবত আমরা গালিবের নাম উচ্চারণ করতে পারি।

এতকিছুর পরেও গালিব এ উপমহাদেশের ও এ অবিভক্ত ভারতবর্ষের। তাই গালিবই বলতে পারেন

প্রেমই নাকি সুখ-ঠিকান/ব্যথার ওষুধ প্রেমেই আছে
প্রেমেই এমন ব্যথা পেলাম/যার ওষুধ নেই কারো কাছে।

প্রেম নিয়ে হায় জোর চলে না/গালিব এ এক অগ্নিদহন
জ্বালিয়ে দিলেও জ্বলে না প্রেম/নিভিয়ে দিলেও নেভে না মন।

প্রথম রুবাইয়্যাতে তিনি বলতে চেয়েছেন, প্রেম রোগের কোন অষুধ নেই। দ্বিতীয় রুবাইয়্যাতে তিনি বলেছেন- প্রেমের আবেগ কে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

প্রেমকে একবার প্রজ্জ্বলন করে সেই প্রেমে নিজেসহ জ্বলে পুড়ে মরতে চাইলে মরা যায় না। এ কথা অন্তত পৃথিবীর কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক বাংলাদেশিরা করি। কারণ আমাদের শিল্পী আব্দুল আলীমের লোকগীতিতে অনেক জনপ্রিয় গান- “প্রেমের মরা জলে ডোবে না” শুনে আমরা অভ্যস্ত।

আবার প্রেমকে নিভিয়ে দিয়ে মনের আগুনও নেভানো যায় না। কারণ প্রেম মনের দরজায় বারবার করাঘাত করতে চায়। এ তো গেলো প্রেমের বিষয়। কিন্তু যে আধ্যাত্মিকতা ও প্রেম মিলে একাকার তার উদাহরণ বলতে পারি গালিবের এ পঙক্তি-

পারলে না হায় খোদা তাকেই/এনে দিতে আমার কাছে
খোদা তোমার কৃতজ্ঞতা/চেয়ো নাই তাই আমার কাছে।

অর্থাৎ আল্লাহ আপনার অস্তিত্ব আছে এতে বিশ্বাস করি। আপনার ক্ষমতা অসীম তাও ঠিক। আপনি চাইলেই যাকে ইচ্ছা তাকে সম্মান দিতে পারেন। সম্পদ দিতে পারেন, ধনবান করতে পারেন, আবার যাকে ইচ্ছা তাকে অসম্মান করতে পারেন।

দারিদ্র্যে পরিণত করতে পারেন। আপনার যে অশেষ নেয়ামত, তা স্বীকার করে বান্দার উচিত আপনার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা। তবে সামান্য এ প্রেমিক, যে আপনারই সৃষ্টি, তাকে আমার জন্য কেন করে দিলেন না।

আপনি ইচ্ছে করেই তা করেননি। আপনার ক্ষমতা থাকা স্বত্তেও যেহেতু আপনি করেননি এ সামান্য বিষয়টি, তাই আমি আপনার বান্দা হিসেবে স্বীকার করি। তবে এ ক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারলাম না।

কারণ খোদা তুমি তাকে এনে দিতে পারলে না আমার জন্য। এ যেন প্রকৃত আধ্যাত্মিক বান্দার শেকওয়া ও জওয়াবে শেকওয়ার মতো তর্ক বিতর্ক।

শুধু তাই নয় প্রেমের বৃষ্টিতে ভেঁজা, প্রেমিকা ফুল যে বাগানে ফোটে তার মালি হওয়া, ঘরে চাঁদ ওঠা প্রেমিকা এলে, প্রেমিকাকে গোলাব বলে চিত্রিত করা, রূপে মজে যাওয়া, এমন চিরন্তন কিছু উপমা তিনি বারবার সৃষ্টি করতে পেরেছেন।

এখনও কবিরা তাদের কবিতায় এমন পঙক্তি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উপস্থাপন করেন নানাভাবে। আর যে কোন প্রেমিক- তার প্রেমিকাকে ঘায়েল করতে কতোবার যে এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করে, তার হিসাব রাখা কঠিন।

এমন পঙক্তি লিখে বা পাঠ করে অনেক পাঠক ও লেখক একজন মহৎ কবির কবিতাতে প্রভাবিত হন, আর তা ভেবে আপ্লুত হয়ে তৃপ্ত হন। শুধু তাই নয়, চার পঙক্তির রুবাইয়্যাতে তিনি নারীর মহত্ব ও নারী ছাড়া পুরুষ যে অপূর্ণ, তা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন।

তাই নারীর অস্তিত্ব পুরুষের জন্য কতটা অপরিহার্য তা বোঝাতে তিনি বলেছেন

চর্তুদিকে জবর খবর / গালিব হবে চূর্ণ যে হায়
কবি তখন নারীর সুরায়/ ডুবে গিয়ে পূর্ণতা পায়।

আর এ সত্যতা নারী কবিতা সত্যায়ন করেছেন আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কারণ তিনি বলেছেন “নারী বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি প্রাণ ”।

বরং নজরুল তো আরও জোর দিয়ে বলেছেন - “কোন কালে একা হয়নি’ক জয়ী পুরুষের তরবারী/প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়ী লক্ষি নারী।”

এই যে মহৎ কবিদের চিন্তার সম্মিলন ও সমন্বয়, তা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করে। আমরা নতুন করে ভাবতে শিখি। আর এসব সম্ভব হয়- যখন পাঠক হিসেবে লেখকরা সচেতন হবো।

লেখক হিসেবে যখন সাহিত্যের স্বাদ নেওয়ার জন্য শুধু একটি ভাষায় সীমাবদ্ধ না থেকে, শুধু বাংলা, শুধু ইংরেজি বা শুধু আরবি বা উর্দুতে সীমাবদ্ধ থাকবো না, বরং অন্য ভাষার সাহিত্য রস আস্বাদনে মনযোগী।

আর এক্ষেত্রে বিশ্বসাহিত্য স্বাদ গ্রহণে যথার্থ ও প্রকৃত অনুবাদ আমাদের সাহিত্য রুচিবোধকে উন্নত করতে পারে। তাই অনেকে যখন বলেন- অনুবাদ সাহিত্য মৌলিক সাহিত্য নয়, তখন বিষয়টা তর্কাতীত নয়।

যে সাহিত্য প্রকৃত সাহিত্যের প্রসারে সহায়ক ভূমিকা রাখে, প্রকৃত সাহিত্য রচনায় উৎসাহিত করে, তা অবশ্যই প্রকৃত সাহিত্যের শাখা-প্রশাখা। আর যদি অখাদ্য ও কুখাদ্য রচনা করে বই প্রকাশ করা হয় মাতৃভাষায় বা নিজের মতাদর্শ প্রকাশ করা হয়, তবে তা কখনো সাহিত্যের পর্যায় পড়ে না।

মৌলিক হওয়া তো দূরের কথা। তাই একজন প্রকৃত লেখক একইসাথে লেখকও অনুবাদক হওয়া উচিত। কারণ লেখকই প্রকৃত অনুবাদ করতে পারে।

যেমনটা পেরেছেন সায়ীদ উসমান রুবাইয়াৎ-ই-মির্জা গালিব উর্দু থেকে অনুবাদ করে। যখন সংস্কৃত অক্ষরে উর্দুকে উপস্থাপন করে উচ্চবর্ণের সনাতনী পণ্ডিতরা প্রমাণ করতে চাইলেন হিন্দি প্রকৃত ভাষা, উর্দুকে অনুসরণ করে হিন্দি করা হয়নি, তখন এমন অনেক উর্দু ভাষার মহৎ কবির অস্তিত্ব সে ভাষার মানুষের কাছে অপরিচিত হয়ে যায়।

তখন অন্য ভাষার প্রকৃত লেখকরা সায়ীদ উসমানের মতো অনুবাদ করেছেন গালিবকে। যেমন ড. সরফরাজ কে. নিয়াজী রচিত “LOVE SONNETS OF GHALIB” নামের ইংরেজি অনুবাদ উল্লেখযোগ্য।

ঠিক এমনই একটি বাংলা অনুবাদন করে গালিবের কবিতার রস আস্বাদনের সুযোগ আমাদের দিয়েছেন। এধরনের প্রচেষ্টার জন্য সায়ীদ উসমানকে ধন্যবাদ দিতে হয়। ধন্যবাদ দিতে হয় প্রকাশককে যে তিনি বই নির্বাচনে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন।

লেখক: কবি ও গবেষক


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ