শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


আরাকানের মুসলমান : ইতিহাস ও ঐতিহ্য

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক

নরমিখলা অধ্যায়
১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে বিশেষ এক পরিস্থিতিতে আরাকানে মুসলমান আগমন শুরু হয়। আরাকানের রাখাইন রাজা নরমিখলা (Narameikhla) এক নারীকে অপহরণ করেন। কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, জোর করে বিয়ে করেন। এতে আরাকানি সম্ভ্রান্তরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলো; আরাকানি সামন্তবর্গ ক্রুদ্ধ হয়ে বার্মার রাজাকে লংগ্রেত আক্রমণ করতে প্রলুব্ধ করে।

ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে বার্মারাজ মেং শো আই লংগ্রেত আক্রমণ করার আগেই নরমিখলা তৎকালীন বাংলার রাজধানী পদ্মাপাড়ের গৌড় নগরীতে পালিয়ে এলেন। আশ্রয় নিলেন গৌড়ের প্রখ্যাত সুফিসাধক মোহাম্মদ জাকের নামের এক দরবেশের আস্তানায়। দরবেশের বদান্যতায় গৌড়ের রাজপ্রাসাদে নরমিখলা আতিথ্য লাভ করেন। গৌড়ের সুলতান ছিলেন জালালুদ্দীন মোহাম্মদ শাহ। তিনি ১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দে নরমিখলার রাজ্য উদ্ধারের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন।


নরমিখলার রাজ্য সীমানা

পরিকল্পনা মোতাবেক চট্টগ্রামের সেনাপতি ওয়ালী খানের নেতৃত্বে এক বিশাল মুসলিম সৈন্যদল প্রস্তুত করা হলো। ঐতিহাসিকদের মতে এই বাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা ছিল ২০ হাজারের অধিক। ওয়ালী খানের নেতৃত্বে আরাকান রাজা নরমিখলা আরাকানে আগমন করেন।

ওয়ালী খানের নেতৃত্বে সহজেই আরাকানের দখলদার আভা রাজাকে (ব্রহ্ম রাজা) উৎখাত করা সম্ভব হয়। কিন্তু ওয়ালী খান জালালুদ্দীন মোহাম্মদ শাহ এবং নরমিখলার (সোলাইমান শাহ) সঙ্গে বেঈমানি করেন এবং নরমিখলাকে (সোলাইমান শাহ) বন্দি করে নিজেই আরাকানের সিংহাসনে বসেন। আরাকানের ইতিহাসে ‘উলি খ্যাঙ’ নামে যে রাজাকে দেখা যায় তিনিই ‘ওয়ালী খান’ বলে গবেষকদের অভিমত।

নরমিখলা কৌশলে বন্দি দশা থেকে পালিয়ে আবার গৌড়ের সুলতানের আশ্রয়ে চলে যান। পরে বাংলার সুলতান জালালুদ্দীন মোহাম্মদ শাহ চট্টগ্রামের সেনাপতি সিন্ধী খানের নেতৃত্বে আবার আরাকানে ৩০ হাজার সৈন্য প্রেরণ করেন। সেই যুদ্ধে ওয়ালী খান পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান। দীর্ঘ ২৬ বছর পর বাংলার সুলতান জালালুদ্দীন মোহাম্মদ শাহের হস্তক্ষেপে নরমিখলা বা সোলাইমান শাহ আবার আরাকানের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং রাজত্ব ফিরে পান।

সোলাইমান শাহ তিন বছর রাজত্ব করার পর বর্মিদের হাত থেকে নিরাপদ থাকার জন্য রাজধানী লংগ্রিয়েত থেকে লেমব্রু নদীর তীরে স্থানান্তরিত করেন। লেমব্রু নদীর তীরে ম্রোহং নাম দিয়ে রাজধানী স্থাপন করে নরমিখলাই আরাকানে ম্রাউক-উ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। রাজধানী ম্রোহং বা মুসলমানদের মুখে রোয়াং বা রোসাঙ্গ বা পাত্থুরিকিল্লাতে হস্তান্তরিত করার পরই সোলাইমান শাহ মারা যান। সোলাইমান শাহ প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থার পরে আরাকানে প্রায় সোয়া দুইশো বছর ইসলামের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিরাজমান ছিল।


নরমিখলার রাজধানী

অনেক গবেষক মনে করেন, এ সময় আরাকান বাংলার একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে ছিল। আরাকানের যে ১৬ জন গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম রাজা ক্রমান্বয়ে এর ঠিক অব্যবহিত আগ পর্যন্ত একশো বছর বছর শাসন করেন। যেহেতু আরাকানী মুসলমানরা শিক্ষায়-দীক্ষায়, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সরকারি আচার-অনুষ্ঠানে ইসলামী জীবনধারাকে সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছেন, তাই জাবুক শাহ রীতিমত একটি ইসলামী রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছিলেন।

উল্লেখ করা প্রয়োজন, মুসলমান শাসকদের অনেকেই নিজ রাজশক্তি ও রাজদণ্ডকে একটি আদর্শ ইসলামী রূপ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। জাবুক শাহও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।

অবশেষে রাজা থদোর ছেলে রাজা থান্ধু থু ধর্ম্মা (১৬৫২-১৬৮৪) মুসলিম নাম ও উপাধি ধারণ নিষিদ্ধ করেন এবং নিজে ‘সুবর্ণ প্রাসাদের অধীশ্বর’ উপাধি ধারণ করেন। সেই থেকেই আরাকানের মুসলিম শাসনের ঐতিহ্যমণ্ডিত যুগের সমাপ্তি ঘটে।

গবেষকদের মতে নরমিখলা তথা সোলাইমান শাহের যুগ ছিল আরাকানের তথা আরাকানের মুসলমানদের জন্য একটি স্বর্ণযুগ।

উল্লেখ্য, নরমিখলা ইতোমধ্যে নিজের বৌদ্ধনাম বদলিয়ে মুহম্মদ সোলায়মান শাহ নাম ধারণ করেন। ফলে বার্মার ইতিহাসে তিনি মুহম্মদ সোলায়মান (মংস মোয়ান) হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। গৌড়ীয় সৈন্যের সহায়তায় নরমিখলা ওরফে সোলায়মান শাহ আরাকান অধিকার করে ম্রাউক-উ নামক এক রাজবংশের প্রতিষ্ঠান করেন। আর এ সাথে শুরু হয় বঙ্গোপসাগরের উপকূলে এক শ্রেষ্ঠ সভ্যতার। এভাবে আরাকান নিশ্চিতভাবে মুসলিম রাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে, একটি আধুনিক সভ্যতার সাথে এই সম্পর্ক আরাকানে এনে দেয় এক রেনেসাঁ। আরাকানী জাতির এক মহাযুগ শুরু হয়।

১৪৩০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শেখের কিছু কাল বাদ দিলে আরাকান ম্রাউক-উ রাজবংশের শাসনাধীন ছিলো। এ সময়ে প্রায় প্রত্যেক রাজা নিজেদের বৌদ্ধ নামের সাথে একটি মুসলিম নাম ব্যবহার করেছেন। ফারসি সরকারি ভাষা হিসেবে চালু হয়। গৌড়ের মুসলমানদের অনুকরণে মুদ্রা প্রথার প্রবর্তন হয়। মুদ্রার একপিঠে রাজার মুসলিম নাম ও অভিষেক কাল এবং অপরপিঠে মুসলমানদের কালিমা শরীফ আরবী হরফে লেখা হয়।

এ বংশের রাজধানী ছিল লেব্রো নদীর তীরে ম্রোহং (Mrohaung)। এখানে গৌড়ের সেনাপতি সিন্ধী খানের মসজিদের ধ্বংশাবশেষ এখনও দেখা যায়। কুড়ি হাজার গৌড়ীয় সৈন্য যাদের অধিকাংশই তুর্কি কিংবা পাঠান; তারা ম্রাউক-উ বংশের অধীনে চাকরি গ্রহণ করে এবং তারা ম্রোহং নগরে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। এই নগরের সঙ্গেই রোহিঙ্গারা সর্ম্পকিত বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। এম.এ. চৌধুরী লিখেছেন,
Among the Muslim populations in Myanmar, the term 'Mrohaung' (Old Arakanese Kingdom) was corrupted to Rohang. And thus inhabitants of the region are called Rohingya. (উইকিপিডিয়া : http://en.wikipedia.org/wiki/Rohingya_people লিঙ্ক )

কালিমাখচিত মুদ্রা

এককালে চট্টগ্রামের মানুষ রোয়াং যেতো অর্থ উপার্জনের জন্য। এ নিয়ে চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক ছড়া হলো,
“ভোয়াং ভোয়াং ভোয়াং
তর বাপ গিয়ে রোয়াং
রোয়াং-অর টিয়া বরুনা পান।
তর মারে কইছদে না কাঁদে পান।”

এদিকে বাংলাপিডিয়ায় সাদাত উল্লাহ খান লিখেছেন, ‘সাধারণত অতীতে তাদের (রোহিঙ্গাদের) আরাকানে অভিবাসন সংঘটিত হতো কৃষি মৌসুমে, আরাকানে কৃষি শ্রমিকদের ঘাটতির সময়ে।’ (বাংলাপিডিয়া : লিঙ্ক http://www.banglapedia.org/HT/A_0285.HTM)

সে যাই হোক, রোসাঙ্গ শাসকদের রাজত্বকালে অনেক তুর্কি ও পাঠান যোদ্ধারা ভাগ্যের অন্বেষণে আরাকানে আগমন করেন ও বসতি স্থাপন করেন। অত্যন্ত হাস্যকর এই যে, ম্রাউক-উ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় গৌড়ীয় মুসলিমদের অবদানের কথা আরাকানী বৌদ্ধ ঐতিহাসিকেরা বেমালুম চেপে গিয়েছেন! এ বিষয়ে জুলনুরাইন লিখেছেন,
Mrauk-U dynasty was founded by King Narameik Hla in 1430 AD with the benevolent military help of Bengal Muslim King. The Hey day of Arakan history began from then. But most Rakhine historians are reluctant to discuss this Muslim involvement openly and precisely. They prefer to mention the help of `Mon’ who were opponent of Myanmar then. The fact is `Mon’ struggle for about 20 years to get control of Arakan against `Ava’ (Myanmar King) was a failure. Exiled Arakan King Narameik Hla got the help of Bengal King. The King’s first retinue headed by General Walikhan consisting of ten thousand force (see: J. Lieder, Ascendance of Mrauk-U dynasty, 2004. expelled the occupying Burmese army and got control of Arakan, but betrayed his trust. Rohingya History: Myth and Reality)

আরও আশ্চর্যের বিষয় উইকিপিডিয়াতেও ম্রাউক- উ সাম্রাজ্য প্রসঙ্গে মুসলিমদের নামগন্ধও নেই।

হযরত বদর শাহ্ রহ. ও কিংবদন্তি আখ্যান
“দাড়ি মাল্লা কাঁদি উডিল ছুয়ানী টেণ্ডল
ক্রেমে ক্রেমে বাড়ি যার গই হাবার বলাবল
আচমানের অবস্থা দেখি মাথা নাহি থির
কেয়ামত করে বুঝি খোয়াজ খিজির
নছর মালুম যাইয়া ধরিল ছুয়ান
সাইগরে উঠিছে ডেউ মুড়ার সমান
দুই দিকে জুড়ি ঢেউ আসে লহরিয়া
দাড়ি মাল্লা কাঁদি উডিল বেনালে পড়িয়া
বদরের নামে কেহ ছিন্নি মানস করে
গুড়াগাড়ার লাগি কেহ মাথা থাবাই মরে ॥”

আবৃত্তিকৃত পালাগানের অংশটি শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন কর্তৃক সঙ্কলিত পূর্ববঙ্গ গীতিকার নছর মালুম পালাগান থেকে সংগৃহিত। পালাগানটি ১৬৬৬-১৬৬৭ সালে রচিত বলে সম্পাদকীয় কলামে তিনি জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম থেকে আরাকানের আকিয়াব পর্যন্ত বৃহত্তর চট্টগ্রামবাসীর জীবনের সাথে মিশে আছে পীর বদরের নাম। চট্টগ্রামের লোকজ ক্রীড়ায় পাড়ার যুবকদের জমায়েত করতে পীর বদরের নামেই গোলা বদর দেয়া হয়।

হযরত বদর শাহ আরাকান ও চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারে আগমনকারী প্রথমসারির সুফী সাধক। তিনি চট্টগ্রাম মুসলমান রাজ্যভুক্ত হওয়ার পূর্বে আরব দেশ থেকে এখানে আগমন করেন। তারপর ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁর সুলতান ফখরউদ্দিন মোবারক শাহর সেনাপতি কদল খাঁ গাজী সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম জয় করে মুসলমান রাজ্যভুক্ত করেন। এই বিজয়ের পূর্ব থেকে চট্টগ্রামে অবস্থানরত বদর শাহ সেনাপতি কদল খাঁ গাজীকে সহায়তা দান করেছিলেন। বদরশাহ চট্টগ্রাম মহানগরীর তৎকালীন দুর্গম পাহাড়ে বসতি স্থাপন করে চট্টগ্রাম শহরের গোড়াপত্তন করেন। হযরত বদর শাহের দরগাহ ভবনটি ৬৫০ বছরের প্রাচীন চট্টগ্রাম মহানগরীর একমাত্র স্থাপনা।

বদর শাহের নামেই বকশির হাটের উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে দক্ষিণে জেল রোড পর্যন্ত উত্তর দক্ষিণে প্রসারিত রাস্তাটির নাম হয় বদরপাতি রোড। তাঁর নামের স্মারকরূপেই বদরপাতি নামের উৎপত্তি। বদরপাতি শব্দটি বরদবাতি শব্দের বিকৃত বা বিবর্তিত রূপ। বদরশাহর সম্মানে হিন্দু মুসলমান ভক্তরা তাঁর দরগাহে বাতি জ্বালানো থেকে বদরবাতি শব্দের উদ্ভব।

পরবর্তীকালে বদরবাতি শব্দ লোকমুখে বিকৃত বা বিবর্তিত হয়ে বদরপাতি নাম প্রচলিত হয়েছে। শহর চট্টগ্রামের বহু পীর-দরবেশের মধ্যে চারজন দরবেশকে শহর চট্টগ্রামের অভিভাবক দরবেশরূপে শ্রদ্ধা করা হয়ে থাকে। পীর বদরশাহ তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। (দৈনিক পূর্বকোণ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)।

কবি মোহাম্মদ খাঁ তার মুক্তল হোসেন কাব্যে বদর শাহকে বদল আলম (অল্লামহু) বা মহাজ্ঞানী বদর শাহ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্তল হোসেন কাব্যের রচনাকাল ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দ। কাব্যের ভূমিকা সূত্রে জানা যায়,

কায় মনে প্রণাম করি বারে বার
কদল খান গাজী জান ভুবনের সার
যার রণে পড়িল অসংখ্য রিপুদল
ভক্ত কেহ মজ্জি গেল সমুদ্রের তল
একেশ্বর মহিম হৈল প্রাণহীন
রিপজিনি চাটিগ্রাম কৈলা নিজাধিন
একাদশ মিত্র সঙ্গে কদল খান গাজী রঙ্গে
দুই পীর বাড়ি লই গেলা
হাজি খলিলকে দেখি বদর আলম সুখী
অন্য অন্যে বহুল সম্ভাসিলা ॥

কদল খাঁ গাজীর চট্টগ্রাম বিজয়ের স্বল্পকালের মধ্যে হাজি খলিল পীর ও মাহি আছোয়ার নামক দুই আরব অভিযাত্রী চট্টগ্রাম আগমন করেছিলেন। তাঁদের সাথে কদল খাঁ গাজীর এবং বদর শাহের সাক্ষাৎ হয়েছিলো বলে মুক্তল হোসেন কাব্যের বর্ণনা সূত্রে জানা যায়।

পীর বদর শাহ শুধু চট্টগ্রামে নয়, বার্মা থেকে মালয় অবধি সুপরিচিত ছিলেন। এই সমস্ত দেশের বন্দরে বদর শাহর নামের স্মারকরূপে বদর মোকাম নামীয় স্মারক দরগাহ প্রতিষ্ঠিত ছিল। বদর মোকামের মধ্যে স্থাপিত একটি পাথরে বদর শাহর নামাজ পড়ার চিহ্ন হাত, পা, হাঁটু ও সিজদার স্থান অংকিত দেখা যায়। আরাকানের আকিয়াবের বদর মোকাম অদ্যপি বিদ্যমান। ( ابى معاذاحمد عبد الرحمن - مسلمواراكان و ستون عاما من الاضطهاد (مكة مكرمة : شبكة الالوكة ১৪৩৪ ه– ص ৫৬)

ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক ও ডক্টর আবদুল করিমের মতেÑ বদর শাহ ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দের পরে কোনো এক সময় এখানে পরলোকগমন করেন। উনার মৃত্যুর পর পর বদরশাহ দরগাহ ভবন নির্মিত হয়।

মগ শাসকরা কবরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কয়েকটি গ্রাম ওয়াক্ফ করেছেন। তারা দরগাহে উপস্থিত হয়ে পীর বদরের আস্তানার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন এবং দান খয়রাত করেন। সুতরাং শিহাব উদ্দিন তালিশের সাক্ষ্যে জানা যায় যে, সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগেও পীর বদরের সমাধিভবনটি বিদ্যমান ছিল। বদর শাহর দরগাহ দুষ্পাঠ্য শিলালিপিখানি দরগার পশ্চিম দেওয়ালে স্থাপিত আছে।

আসামের সীমানা থেকে মালয় উপদ্বীপ পর্যন্ত সমুদ্র তীরবর্তী ভূভাগের নানা স্থানে বুদ্ধের মোকাম নামক এক প্রকার অদ্ভুত মসজিদ আছে। এই মসজিদগুলিকে বৌদ্ধ ও চীনা মুসলমান জাতি সমভাবে সম্মান প্রদর্শন করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক সিদ্দিক খান নিজে আরাকানের আকিয়াবের বদর মোকাম দেখেন এবং বলেন যে, ঐ বদর মোকামে প্রকৃতপক্ষে দু’টি দালান আছে, প্রথমটি মিনার এবং গম্বুজসহ মনোরম টিলার ওপরে অবস্থিত এবং দেখতে উপমহাদেশীয় মসজিদের অনুরূপ। পাশেই একটি গুহা এবং গুহাটি পাথরের তৈরী। গুহাটি পীর বদর কর্তৃক সাধনার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত চিল্লাখানা। প্রত্নতত্ত্ববিদ Torchammer এই বদর মোকাম এর বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন।

মিয়ানমারের আকিয়াবে বদর মোকাম নির্মাণ সম্পর্কে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে আকিয়াবের ডেপুটি কমিশনার কর্নেল নেলসন ডেভিস কর্তৃক প্রদত্ত বিবরণে জানা যায়, ১৭৫৫ খিৃস্টাব্দে পীর বদর-উদ-দীন বদর-ই আলমের সম্মানে এটি নির্মিত হয়। বিবরণে আরও প্রকাশ, আঠার শতকের গোড়ার দিকে, আনুমানিক ১৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে চাঁদ সওদাগর ও মানিক সওদাগর নামক চট্টগ্রামের দু সওদাগর ভাই বেসিন থেকে আরাকান হয়ে বদর মোকাম-এর নিকট পৌঁছলে তাদের খাবার পানি শেষ হয়ে যায়।

তারা জাহাজ নোঙর করে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে। ঐ রাত্রে পীর বদর স্বপ্নে মানিক সওদাগরকে আদেশ দেন, তারা যেনো যেখান থেকে পানি যোগাড় করেছে সেখানে গৃহ তৈরী করে দেয়। মানিক সওদাগর তাদের আর্থিক অসচ্ছলতার কথা জানালে পীর সাহেব বলেন যে, তাদের সকল হলুদ সোনায় পরিণত হবে। সকালে ঘুম ভাঙার পর দুই ভাই সত্যি সত্যি দেখে অবাক হয়ে যায় যে, তাদের জাহাজস্থ হলুদ সব সোনায় পরিণত হয়েছে। অতঃপর তারা বদর মোকাম নামী ঐ পাকা দালানগুলি তৈরি করে দেয়।

বদর মোকাম

ঐ দিন থেকে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ সকলে ঐ স্থানকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছে। আরাকানের বদর মোকাম ছাড়াও আরও কয়েকটি বদর মোকাম এর অস্তিত্বের কথা জানা গেলেও একমাত্র আকিয়াবের বদর মোকাম ছাড়া আর সবগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। এছাড়াও বঙ্গোপসাগরীয় উপকূল হতে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া পর্যন্ত তৎকালীন সময়ের পূর্ব হতেই আরব বণিকদের যোগাযোগ থাকার প্রমাণ ইতিহাসে ভূরি ভূরি রয়েছে।

কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় শাহপরীর দ্বীপ বলে একটি স্থান রয়েছে। টেকনাফের অদূরে আরাকানের মংডু শহরের সন্নিকটস্থ সুউচ্চ দুটি পাহাড়ের চূড়ার একটির নাম হানিফার টংকী এবং পাশ্ববর্তী অপরটি কায়রা পরীর টংকী বলে খ্যাত। আরাকানে জনশ্রুতি আছে, ইসলামের চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রা.-এর ছেলে হযরত হানীফা রহ. ইয়াযীদের সাথে দন্দ্ব হওয়ার কারণে আরাকানে আসেন এবং ইসলাম প্রচার করেন। কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার পর ইতিহাসে হযরত হানিফা রহ. সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কিছু জানা যায়নি।

এসব কারণে কক্সবাজার জেলায় বসবাসকারী জনসাধারণ নিজেদের আরব বংশোদ্ভূত বলে মনে করে থাকেন। এই এলাকার জনগণের ভাষায় ক্রিয়াপদের পূর্বে না সূচক শব্দ ব্যবহার আরবী ভাষার প্রভাবের ফল বলে পন্ডিতগণের ধারণা। কক্সবাজারের জনগণের ভাষায় প্রচার আরবী ও ফারসি শব্দ এবং মঘী শব্দের আধিক্য দেখা যায়। মঘী জরিপের অনুরূপ অত্র এলাকার জমির পরিমাণ দ্রোন, কানী ও গণ্ডা ইত্যাদি হিসেবে হয়ে থাকেন।

অপরপক্ষে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে গৌড়ীয় পরিমাপ অনুসারে বিঘা, কাঠা ও পাখি হিসেবে হয়ে থাকে। নিঃসন্দেহে কক্সবাজারের জনগণের ওপর এটি রোসাঙ্গ সভ্যতার প্রভাবের ফল। অনেক ডাক ও পর্তুগীজ শব্দও জনগণের ভাষায় পরিলক্ষিত হয়। আরো দেখা যায়, পর্তুগীজ নাম ফারনানডেজ বিকৃত হয়ে পরান মিয়া, ম্যানুয়েল বিকৃত হয়ে মনু মিয়া হয়েছে।

ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে। বলছিলাম, আরাকানের ম্রাউক-উ সাম্রাজ্য পার্শ্ববর্তী বাংলা-ভারত অঞ্চল থেকে অনেক আচার, কৃষ্টি গ্রহণ করে। তারা ইসলামী অভিলিখনে মুদ্রাও বাজারে ছাড়েন। তারা বাংলা সাহিত্যকে পৃষ্ঠপোষকতাও দেন। তারা মুসলিম নামও অধিগ্রহণ করেন যে রীতি ষোড়শ শতাব্দীর প্রায় শেষভাগ পর্যন্ত চলে। বৈচিত্র্যপূর্ণ নৃ ও জাতিগোষ্ঠীর সমাহারে সাজানো এই সাম্রাজ্যে মুসলিমরা প্রশাসন, আদালত ও প্রতিরক্ষা বাহিনীতে বিশেষ অবদান রাখে। ১৭৮৪ সালের বর্মী রাজা বোদোপায়ার অধিগ্রহণের আগ পর্যন্ত প্রায় কয়েক শতাব্দী ধরেই এই বিচিত্র ও অনন্য রাজ্য ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন।

জাপানের কান্ডা ইউনিভার্সিটি অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অধ্যাপক আই চ্যান (Prof. Aye Chan)-এর ভাষ্য অনুযায়ী বোদোপায়া ছিলেন উগ্রপন্থী বৌদ্ধ, যিনি মুসলিম সম্পর্কিত সবকিছুই ধ্বংস করে ফেলতে চাইতেন। ধর্মীয় সৌহার্দপূর্ণ অঞ্চলে তিনি সংকীর্ণতাবাদী সাম্প্রদায়িকতার প্রচলন করেছিলেন।

১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত সিন্ধি খান মসজিদ

আরাকানের সৈকতজুড়ে থাকা মসজিদগুলোকে ধ্বংস করে তিনি সেখনে প্যাগোড়া ও বৌদ্ধ আশ্রম গড়ে তোলেন। আরাকান অধিগ্রহণের সময় তিনি কয়েক অযুত মুসলিমকে মারা ছাড়াও প্রায় ২০,০০০ মুসলিমকে বন্দী করে নিয়েছিলেন। তার নৃশংস রাজত্বকালে প্রায় দুই লক্ষ আরাকানবাসী পার্শ্ববর্তী ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় (আজকের বাংলাদেশ) পালিয়ে যায়। প্রায় ৪০ বছর বর্মী শাসনের পরে (১৮৮৪-১৯২৪) আরাকান ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ইংরেজরা ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালের বার্মার স্বাধীনতা পর্যন্ত এই আরাকান অঞ্চল শাসন করে। (Aye Chan, SOAS Bulletin of Burma Research, Vol. 3, No. 2, Autumn 2005, ISSN 1479-8484, The Development of a Muslim Enclave inArakan (Rakhine) State of Burma (Myanmar)

[চলবে]


সম্পর্কিত খবর