
শায়খ মাওলানা রেজাউল হক। লন্ডন প্রবাসী একজন দরদি ও পরিশ্রমী আলেম। লন্ডনের বার্মিংহামে বিশাল মাদরাসা গড়ে তোলার পাশাপাশি বাংলাদেশেও নানারকম সেবামূলক কাজ অব্যাহত রেখেছেন। মূলত চলমান সময়ে রোহিঙ্গাদের উপর চরম নির্যাতন প্রত্যক্ষ করা ও তাদের সহায়তার জন্যই তিনি এসেছেন বাংলাদেশে। শিক্ষা ও সমাজসেবার পাশাপাশি যুক্ত রাজনীতিতেও। তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণ সম্পাদক এবং যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি। বার্মিংহামে প্রতিষ্ঠা করেছেন জামিয়া ইসলামিয়া দাওরায়ে হাদিস মাদরাসা। সেখানে প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদীসের দায়িত্বও পালন করছেন তিনি।
শায়খ মাওলানা রেজাউল হক সম্প্রতি দুই সপ্তাহের সফরে বাংলাদেশে এসেছেন। গত ১১ ফেব্রুয়ারি আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোরের সঙ্গে রাজধানীর পল্টনের একটি রেস্তোরাঁয় বৈঠক করেন তিনি। আওয়ার ইসলামের কাজের প্রশংসা করে তিনি মিডিয়ায় টিকে থাকার প্রেরণাও দেন। বৈঠকে আওয়ার ইসলামের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন নির্বাহী সম্পাদক রোকন রাইয়ান ও ইভেন্ট সমন্বয়ক জামিল আহমদ।
বৈঠকে মাওলানা রেজাউল হকের সঙ্গে একান্তে আলাপ হয় তাদের কাজ ও সামগ্রিক বিষয় নিয়ে। আলোচনাগুলো তুলে ধরা হলো।
লন্ডনে আপনার দীনি কাজের শুরু কীভাবে?
শায়খ মাওলানা রেজাউল হক: আমি ১৯৯০ সালে দাওরা পাশ করি। আমার বাবা থাকতেন লন্ডনে। দাওরা শেষ করার পর আমরা ভাইবোন মা সবাই মিলে লন্ডনে চলে যাই। আমার বাবাও গহরপুর মাদরাসার ফারেগ। দেশে তিনি একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেটি ৫০ বছর যাবত এখনো চলছে।
লন্ডনে আমার আব্বা ইমামতি করতেন। আমি যাওয়ার পর একটি মাদরাসায় শিক্ষকতায় যুক্ত হই। এখানে কেটে যায় দুই বছর। তবে এখানে আর্থিক একটা সমস্যা ছিল। যে কারণে আমাকে মসজিদের ইমামতি নিতে হয়। বৃটেনের পরিচিত শহর পোর্টমাউথে তখন একটাই জামে মসজিদ ছিল। সেই মসজিদে ইমামতি নিলাম। এখানে কেটে যায় পাঁচ বছর। এর মধ্যে সংসারিও হয়ে উঠি।
[caption id="attachment_26809" align="alignright" width="426"] বৈঠকের এক ফাঁকে[/caption]
 বৈঠকের এক ফাঁকে[/caption]
তখন আব্বা থাকতেন বার্মিংহামে। আমার সংসার হওয়ায় বললেন তাদের কাছে চলে যেতে। বার্মিংহামেই আমার পরিবারের সবাই থাকতেন। ৯৫ এর শেষের দিকে আমিও চলে আসি। আমার প্রতি আল্লাহর রহমত ছিল। কারণ ওই রাতেই আমাদের সিলেট এলাকার এক মুরব্বি হাজি বুরহান সাহেব থাকতেন বার্মিংহামে তিনি আব্বাকে ফোন করে বললেন আপনার ছেলে তো চলে এসেছে বার্মিংহামে। আমাদের মসজিদে তো একজন ইমাম প্রয়োজন।
বেশ পরিচ্ছিন্ন এলাকা, ছোট্ট একটা মসজিদ। আমি ইমামতি শুরু করলাম সেখানে। এখানে আশেপাশে কোনো মাদরাসা ছিল না। বছর খানেক পর আমি চিন্তা শুরু করি এবং অন্যরাও এগিয়ে আসেন। সেভাবেই একটি মাদরাসার সূচনা হয়। মাঝখানে মসজিদ পরিচালনার পুরোপুরি দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়। আমিও ধীরে ধীরে আরো বেশি মানুষকে ইসলাম ও দীনের খেদমতে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পারি। ১৯৯৮ এ পার্টটাইম মাদরাসা চালু করেছিলাম। ২০০০ সালে ব্রিটিশ অ্যাডুকেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে ফুলটাইম সেকেন্ডারি (হাইস্কুল) স্কুল চালু করি।
এখানে রেজিস্টার্ড স্কুলের কিছু নিয়ম কানুন থাকে। বড় জায়গা লাগবে। ছোট্ট জায়গা হবে না। আমরা তো প্রথম শুরু করেছিলাম মসজিদ ভবনে। এখন আলহামদুলিল্লাহ বিশাল জায়গা নিয়ে অবস্থিত। এটি সোয়া পাঁচ লক্ষ পাউন্ড দিয়ে কিনেছিলাম। জামিয়া ইসলামিয়া বার্মিংহাম নামে মাদরাটি প্রতিষ্ঠাও পেয়ে গেল অল্প সময়ে। এর জন্য অবশ্য এলাকাবাসীর আপ্রাণ চেষ্টা ও শ্রম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
আলহামদুলিল্লাহ কিছুদিনের মধ্যেই আমরা মাদরাসাটি দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত খুলে ফেলি। এখন সেটি বেশ সুনামের সঙ্গেই এগিয়ে চলছে। একটা প্রবলেম অবশ্য ছিল। মাদরাসার বোর্ডিং ছিল না। এ কারণে দূরের ছাত্ররা এখানে ভর্তি হতো না। আল্লাহ পাক সেটারও ব্যবস্থা করেছেন। কিছুদিন আগে মাদরাসার পাশেই এক একরের আরেকটি প্লট আমরা কিনেছি। এখন দুই একর জমিতে বিশাল মাদরাসা ক্যাম্পাস হচ্ছে। এখানে ৩০০ জন শিক্ষার্থীর অধ্যয়নের সুযোগ থাকবে। শিক্ষক থাকবে ২৫ জন। আলহামদুলিল্লাহ বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এত বড় ইসলামিক কোনো প্রজেক্ট পাস হয়নি।

জামিয়া ইসলামি বার্মিংহাম এখন ইসলামের বড় একটি সম্পদ এবং বড় পাওনা।
বর্তমানে মাদরাসাটিতে কতজন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে?
শায়খ মাওলানা রেজাউল হক: গত ১১ বছর যাবত এখানে দাওরায়ে হাদিস খোলা হয়েছে। এর পর থেকেই ছাত্র সংখ্যা ভালো। সেকেন্ডারি স্কুলসহ যারা ফুলটাইম পড়ালেখা করেন তাদের সংখ্যা ১৫৫ জন। এছাড়া মসজিদসহ পার্টটাইম ছাত্র মিলিয়ে ২৫০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী নানাভাবে মাদরাসা থেকে শিক্ষা নিচ্ছে।
বার্মিংহামে আসলে এ ধরনের একটি মাদরাসর প্রয়োজনীয়তা কেমন?
শায়খ মাওলানা রেজাউল হক: শুধু প্রয়োজন না আলহামদুলিল্লাহ পুরো ইউরুপজুড়ে এমন কিছু মাদরাসা খুবই জরুরি এবং ইতোমধ্যেই জামিয়া ইসলামিয়া বার্মিংহাম ইউরোপে মুসলিমদের সম্পদে পরিণত হয়েছে। যা ইউরোপের মুসলিমরা বড় রকমের অভাববোধ করছিলেন।
এখানকার শিক্ষার্থীরা কি শুরু বাংলাদেশি কমিউটির না অন্য দেশেরও রয়েছে?
শায়খ মাওলানা রেজাউল হক: বেশির ভাগ বাংলাদেশি। এছাড়াও ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, সোমালিয়া, আফ্রিকা এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর শিক্ষার্থী রয়েছে।
মূল ব্রিটিশ মুসলিমরা কি আপনাদের মাদরাসাগুলোতে আসে না?
শায়খ মাওলানা রেজাউল হক: আমাদের এই এলাকায় ফ্যামিলিসহ ব্রিটিশরা খুবই কম। আর যারা নতুন মুসলিম হন তারা সাধারণত একটু বাইরে বাইরে থাকতে চান। আমার মাদরাসায় এখন পর্যন্ত নতুন মুসলিম ভর্তির সুযোগ হয়নি। তবে এটি সম্ভব হবে বোর্ডিং হলে। আবাসনের ব্যবস্থা পেলে দূর দূরান্ত থেকে ছাত্ররা আসবে ইনশাআল্লাহ।
অমুসলিমদের ইসলামে আনার জন্য ওখানে কী ধরনের কাজ হয়?
শায়খ মাওলানা রেজাউল হক: আলেমগণ তো সময় দাওয়াতের কাজ করছেন। আর দাওয়াতি কাজের খুসুসিয়াত হলো এসব দেখে অমুসলিমরা আকৃষ্ট হন। ইসলাম যে ধরনের সৎ ন্যায়পরায়নতার দীক্ষা দেয় তাই প্রতিনিয়ত আকর্ষণ করে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের। এটা আল্লাহ তায়ালা একটি খাস অনুগ্রহ।

আপনাদের মাদরাসা কি নিজস্ব সিলেবাসে চলে নাকি সরকারি কারিকুলামে?
শায়খ মাওলানা রেজাউল হক: ফুলটাইম মাদারাসা যেগুলো যেমন দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত এরকম মাদরাসা আছে মাত্র দুই তিনটা। এর মধ্যে বাঙালি কমিউনিটিতে আমাদেরটাকেই সবাই বড় বলে জানে। এছাড়া অসংখ্য মক্তব আছে বিভিন্ন জায়গায়। আমাদের দেশে সকালের মক্তব যেমন। বড় মাদারাগুলোর জন্য সরকারের পুরো অনুমোদন লাগে এবং তাদের কযেকটি সিলেবাস অনুসরণ করতে হয়।
ব্রিটিশ অ্যাডুকেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে ৩টা সাবজেক্ট বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে। ইংলিশ, ম্যাথ এবং সায়েন্স। কিছুদিন যাবত সিটিজেনশিপকেউ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মারদাসাতে এগুলো বাধ্যতামূলক পড়াতে হয়। বাকি যে সময়টা থাকে আমরা দরসে নিজামি পড়াই।
বাংলাদেশি মুসলিম আর ব্রিটেনের মুসলিমদের মধ্যে দীন পালনের মৌলিক কোনো পার্থক্য দেখেন?
শায়খ মাওলানা রেজাউল হক: দুই দেশের সংস্কৃতি এক নয়। প্রতিটি দেশে মানুষের কালচাল আলাদা আলাদা ভাবে ফুটে উঠে। তবে ওখানকার মুসলিমদের মাঝে দীনদারীটা বেশিই বলতে হবে। বাংলাদেশ তো ইসলামপ্রধান দেশ যে কারণে দীন পালনে বা দীনের কাজে একটু অলসতা এসেই পড়বে। কিন্তু সেখানে তো মানুষকে কঠোরতার মধ্যে দিয়ে দীন শিখতে হয় যে কারণে যারা দীন বুঝে শক্তিশালীভাবে বুঝে। তাদের আমল আখলাকেও পরিপূর্ণতা দেখা যায়।
আপনি লন্ডনে থাকেন এবং উঁচু মাপের কাজ করে যাচ্ছেন সেখানে, বাংলাদেশে এসে আওয়ার ইসলামকে স্মরণ করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
শায়খ মাওলানা রেজাউল হক: আপনাদেরও ধন্যবাদ জানাই। আওয়ার ইসলাম আমি নিয়মিত দেখি। ভালো লাগে। ইসলামিক মিডিয়া কমিউনিটি তো সেভাবে আমাদের ভেতর গড়ে উঠেনি। আপনারা সেখানে ভালো খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। আপনারা অবশ্যই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।
কিন্তু ইসলামিক একটা মিডিয়া দাঁড় করানোর জন্য আমাদের আর্থিক ব্যবস্থা সেভাবে গড়ে উঠেনি। কর্পোরেট হাউজের সহায়তা আমরা পাই না। কোনো দল থেকেও আমরা সহায়তা নেই। আমরা এই মিডিয়া নিয়ে টিকে থাকবো কীভাবে?
শায়খ মাওলানা রেজাউল হক: হ্যাঁ এটিতে দু:খজনক বিষয়। ভালো পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া মিডিয়া গড়ে তোলা অসম্ভব। তবু আল্লাহর কাছে ভরসা। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে সবাইকে আহ্বান করি তারা যেন সমর্থন ও সহযোগিতার চেষ্টা করেন।
জামিয়া ইসলামিয়া বার্মিংহাম এর কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে ভিডিওটি দেখতে পারেন
 
                              
                           
                              
                           
                         
                              
                           
                        
                                                 
                      
                                                  
                                               
                                                  
                                               
                                      
                                         
                                      
                                         
                                      
                                        