
আমানুল্লাহ নোমান
আধুনিক অর্থব্যবস্থায় বীমা একটি গুরুত্বপূর্র্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ক্ষেত্রবিশেষে এর গুরুত্ব ব্যাংকের চাইতেও বেশি হয়। দুর্ঘটনার কারণে কারো ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা যানবাহন ক্ষতিগ্রস্থ হলে অথবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কোন কারণে ধ্বংস হয়ে গেলে বীমা ব্যবস্থা যেভাবে তাকে সহায়তার কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারে ব্যাংক সেভাবে পারে না। মৃত্যুর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। পরিবারের প্রধান বা মূল উপার্জনকারীর দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বা মৃত্যু হলে পরিবারের যখন দুঃখের অমানিশা নেমে আসে ও আর্থিক নিরাপ্তাহীনতা দেখা দেয় তখন বীমাই তাদের কার্যকর সহায়তা দিতে পারে। কিন্তু বীমা নিয়ে আমাদের সমাজে নানা ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়ে আছে। আমরা অনেকেই প্রচলিত বীমা ও ইসলামি বীমা (তাকাফুল) এর মাঝে বৈশিষ্টগত পার্থক্য থাকলেও আমরা অনেক সময় দুটিকে এক করে ফেলি।
আপাত দৃষ্টিতে প্রচলিত সুদভিত্তিক বীমা ব্যবস্থা ভবিষ্যত প্রয়োজন মেটাবার ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন সঞ্চয়ী ব্যবস্থা বলে মনে হয়। কিন্তু এতে এমন পাঁচটি মৌলিক শরীয়াহবিরোধী উপাদান রয়েছে যার প্রতিবিধান না ঘটলে মুসলমানদের পক্ষে ঈমান-আকিদা বজায় রেখে এই বীমা পদ্ধতিতে অংশ গ্রহণ করা অসম্ভব। তাই প্রচলিত সনাতন বীমা মুসলিম সমাজে গ্রহণযোগ্য নয় বলে ইসলামি শরিয়াহ বিশেষজ্ঞগণ সর্বসম্মত অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
প্রচলিত বীমায় শরিয়াহবিরোধী উপাদানগুলো হচ্ছে
ক. আল্-ঘারার (অজানা/অনিশ্চয়তা): প্রচলিত বীমা ব্যবস্থায় বীমা গ্রহীতা বীমা কোম্পানীর সাথে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার পলিসি গ্রহণের চুক্তি সম্পন্ন করে টাকা অনেকগুলো সমান কিস্তিতে প্রিমিয়াম হিসাবে নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে জমা দিয়ে থাকেন।এ ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রিমিয়াম জমা দেওয়ার পর বীমা গ্রহীতা দুর্ঘটনা কবলিত হলে বা মৃত্যুবরণ করলে বীমা কোম্পানী পলিসির চুক্তি অনুসারে পুরো টাকাটাই বীমা গ্রহীতা বা তার নোমিনীকে প্রদান করে থাকে। কিন্তু এই টাকা কোথা থেকে কিভাবে প্রদান করা হলো তা বীমা গ্রহণকারীর কাছে অজানা বা অজ্ঞাত থাকে। প্রচলিত সাধারণ বীমা ও জীবন বীমা উভয় ক্ষেত্রেই এই অজ্ঞতা বা অনিশ্চয়তার উপাদান বিদ্যমান। শরীয়াহর পরিভাষায় একে বলা হয় আল-ঘারার।
খ. আল্-মাইসির (জুয়া): জীবন বীমার ক্ষেত্রে আল-ঘারার বিদ্যমান থাকার কারণেই জুয়া বা আল-মাইসির-এর উদ্ভব ঘটে। উদাহরণতঃ যখন জীবন বীমার কোন পলিসি গ্রহীতা তার বীমার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন তখন চুক্তিবদ্ধ প্রিমিয়ামের আংশিক পরিশোধ করা হলেও তার নোমিনী বা মনোনীত ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ অর্থের পুরোটাই পেয়ে থাকেন। শরীয়াহর দৃষ্টিতে এটা জুয়া।
গ. আলরিবা (সুদ): প্রচলিত বীমা কোম্পানীগুলোর কার্যক্রমে সুদের লেনদেন, সুদভিত্তিক বিনিয়োগ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আদান-প্রদান অব্যাহত থাকে যা শরীয়াহ আইন ও অনুশাসনের পরিপন্থী বলে ফকীহ্গণ সর্বসম্মত রায় দিয়েছেন।
ঘ. শরীয়াহবিরোধী নমিনী মনোনয়ন: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সুরা আল-নিসায় মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের চিহ্নিত এবং তাদের হক নির্ধারিত করে দিয়েছেন। কিন্তু প্রচলিত বীমা ব্যবস্থায় বীমা গ্রহীতা তার ইচ্ছামাফিক যে কোন ব্যক্তিকে নমিনী নির্ধারণ করতে পারে। সকল ওয়ারিশকে বঞ্চিত করে এই নোমিনীই বীমার পুরো অর্থ পাবে যা শরীয়াহর সুস্পষ্ট বরখেলাপ। এটা আদল ও ইহসানবিরোধী।
ঙ. প্রিমিয়াম প্রদানের বিদ্যমান শর্ত: বিদ্যমান বীমা আইনে (জীবনবীমা ব্যতীত) বীমা পলিসি কার্যকর হওয়ার জন্যে নির্দিষ্ট একটি মেয়াদ নির্ধারিত রয়েছে। ঐ মেয়াদের মধ্যে একটি কিস্তিও যদি অনাদায়ী থাকে তাহলে বীমা গ্রহীতা ঐ সময় পর্যন্ত যত টাকা প্রিমিয়াম হিসাবে দিয়েছেন তার পুরোটাই মার যায়। উদাহরণস্বরূপ, প্রচলিত সাধারণ বীমা ব্যবস্থায় বীমা কার্য়কর হওয়ার জন্যে কমপক্ষে দুই বছর প্রিমিয়াম দেওয়া বাধ্যতামূলক। কোন বীমা গ্রহীতা যদি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে প্রিমিয়াম দেন তাহলে তাকে দু’বছর মোট আটটি কিস্তি দিতে হবে। কিন্তু তিনি যদি সাতটি কিস্তি জমা দেওয়ার পর বাকী কিস্তিটি কোন কারণে দিতে না পারেন তাহলে ঐ পলিসিটি কার্যকর বলে গণ্য হবে না এবং সংশ্লিষ্ট বীমা গ্রহীতা বা তার নোমিনী কিছুই পাবেন না। অর্থাৎ, বীমা গ্রহীতার মূলধনই খোয়া যাবে। এটা আদল ও ইহসানের পরিপন্থী।
কিন্তু বিপদ-মুসিবত ও আকস্মিক দুর্যোগ মুকাবিলা ও সন্তান-সন্ততিদের জন্যে নিরাপদ ভবিষ্যত তৈরীর ক্ষেত্রে ইসলামে কোন আপত্তি নেই। রাসূলে করীম (স) বলেছেন-“তোমাদের উত্তরাধিকারীদের নিঃস্ব, পরমুখাপেক্ষী ও অপর লোকদের উপর নির্ভরশীল করে রেখে যাওয়া অপেক্ষা তাদেরকে সচ্ছল, ধনী ও সম্পদশালী রেখে যাওয়া তোমাদের পক্ষে অনেক ভাল।” (সহীহ আল্-বুখারী)
তিনি আরও বলেন- “যে ব্যক্তি কোন সংকটাপন্ন লোকের সংকট নিরসন করার উদ্যোগ নেয় আল্লাহ তা’য়ালা তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে সংকট হতে অব্যাহতি দেবেন।” (মুসলিম)
নানাবিধ সংকট ও সমস্যার কথা ভেবে মুসলিম উম্মাহর প্রয়োজন পূরণ ও ইসলামে গ্রহণযোগ্য একটি বিকল্প বীমা ব্যবস্থার সন্ধানে ইসলামী আইনবেত্তা ও বীমা বিশেষজ্ঞগণ দীর্ঘদিন ধরে চিন্তা-ভাবনা, গভীর গবেষণা ও পর্যালোচনা করেন। শেষ পর্যন্ত তারা ইসলামী পদ্ধতির বীমা ব্যবস্থা উদ্ভাবনে সমর্থ হয়েছেন। ইসলামী শরীয়াহসম্মত বীমা পরিচালনা প্রসঙ্গে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৬১ সালে দামেস্কে, ১৯৬৫ সালে কায়রোয়, ১৯৭৫ সালে মরোক্কো ও লিবিয়ায় এবং ১৯৭৫ সালে মরোক্কা ও লিবিয়ায় এবং ১৯৭৬ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত সম্মেলন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অবশেষে ১৯৮০ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে সংস্থাভুক্ত দেশসমূহে ইসলামী বীমা চালূ করার সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। উল্লেখ্য বাহরাইনে সর্বপ্রথম ইসলামী বীমার কার্যক্রম শুরু হয়। এজন্যে সে দেশে পৃথক আইনও প্রণীত হয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামী বীমা বিস্তৃতি লাভ করে। আফ্রিকায় এর কার্যক্রম প্রথম শুরু হয় সুদানে। দূর প্রাচ্যে মালয়েশিয়া এ ব্যাপারে এগিয়ে রয়েছে। ইসলামী বীমার প্রসারের জন্য মালয়েশিয়া ’তাকাফুল এ্যাক্ট, ১৯৮৪” নামে পৃথক আইন প্রণীত করেছে।
ইসলামি বীমা তাকাফুল নামেই বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। আরবি কাফালা শব্দ থেকে এটি উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ যৌথ জামিননামা বা সমষ্টিক নিশ্চয়তা, অর্থাৎ পারস্পারিক দায়িত্ব গ্রহণ। বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাকাফুল হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট সদস্য গ্রুপের যৌথ নিশ্চয়তার অঙ্গীকার যা দুর্ঘটনা বা অন্য কোন কারণে ক্ষতিগ্রস্থ সদস্য বা সদস্যদের ক্ষতিপূরণে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার নিশ্চয়তা প্রদান করে। গ্রুপের সদস্যগণ এমন একটি যৌথ নিশ্চয়তার চুক্তিকে আবদ্ধ হন যাতে কোন সদস্য দুর্ঘটনা বা দুর্যোগের শিকার হলে তার ক্ষতিপূরণের জন্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ লাভ করতে পারেন। বস্তুতঃ এটি হচ্ছে গ্রুপের সদস্যগণ তাদেরই একজনের বিপদে সাহায্য করার জন্যে সকলেই একযোগে সুনির্দিস্ট পরিকল্পনা অনুসারে এগিয়ে আসেন। তাকাফুল ব্যবস্থার ভিত্তি হলো ভ্রাতৃত্ব,সংহতি ও পারস্পরিক সহযোগিতা। তাই ইসলামি তাকাফুল অর্থাৎ ইসলামি বীমা একটি সহায়তামূলক ও কল্যাণধর্মী প্রতিষ্ঠান এবং এক মুমিন ভাইয়ের আপদকালে তার সাহায্যে এগিয়ে আসার গোষ্ঠীবদ্ধ উপায়ই বটে।
আরআর
 
                              
                           
                              
                           
                         
                              
                           
                        
                                                 
                      
                                                  
                                               
                                                  
                                               
                                      
                                         
                                      
                                         
                                      
                                        