শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


আবিদের বাবা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মোস্তফা ওয়াদুদ : সাপ সাপ বলে চিৎকার করে উঠলো আবিদ। দৌড়ে বাবার ঘরে প্রবেশ করে সে। বাবা ততক্ষণে বুয়ার কাছে রান্নাঘরে গিয়েছেন। আবিদের মা নেই। ছোটো আবিদকে বাবাই মানুষ করে তুলছেন। চিৎকার শুনে খন্দকার মুশতাক সাহেব দৌড়ে এলেন। সাপটিকে হাত দিয়ে ধরে ফেললেন।

০২
কর্ণফুলি মার্কেট থেকে খন্দকার সাহেব আবিদের জন্য খেলনা এনেছেন। প্লাটিকের সাপ। উড়োজাহাজ ও পাজারো গাড়ী। ব্যাটারীর সাহায্যে চলে এসব। প্লাস্টিকের সাপটি একদম জেন্তো সাপের মতো চলে। বড়ো বড়ো ফনা তুলে। সাপের রংয়ের মতো লাল ডোরাকাটা গায়ের রং। সিলভার রংয়ের পাজারো। বাংলাদেশের পতাকা আঁকা উড়োজাহাজ। সামনে ঈদ। তাই ঈদের মার্কেটও করে এনেছেন। লাল পাঞ্জাবী, সাদা পায়জামা, টুপি ও জিনসের প্যান্ট। নীল কালারের ফতুয়া। আবিদ এবার আইডিয়াল স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। তাই কম্পিউটার শিখার জন্য ডেস্কটপ নিয়ে এসেছেন।
ঘরে প্রবেশ করেই খন্দকার সাহেব সাপটি ছেড়ে দেন । আবিদের দিকে। আবিদ প্রথমে দেখেনি। তাই হঠাৎ দেখে ভয় পেয়েছে।

আবিদ ভালো কম্পিউটার শিখেছে। সারাদিন গেমস নিয়ে বসে থাকে। মোস্তফা গেমস ওর কাছে এখন আর ভালো লাগে না। নতুন নতুন রাজকুমারী গেমস খেলে আবিদ।
ওর বাবা ওকে অনেক আদর করেন। ভালোবাসেন। আবিদ যা চায় তাই এনে দেন। আজ আবিদকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছেন খন্দকার সাহেব। তাই না জানিয়েই মার্কেট করেছেন। কিন্তু আবিদের কম্পিউটার ছাড়া আর কিছুই পছন্দ হয়নি। ওর পছন্দ সাদা চেকের সবুজ পাঞ্জাবী আর কালো প্যান্ট। সাথে সাদা কেড্স। কিন্তু এনেছে ভিন্ন রংয়ের। তাই ও কান্না শুরু করে দিয়েছে। বাবা আবিদের কান্না দেখে স্থির বসে থাকতে পারেন নি। তিনি আবিদকে তাঁর বুকে জড়িয়ে নিলেন। গালে চুমু এঁকে দিলেন। আদর করলেন। ওকে নিয়ে মার্কেটে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। ওর কান্না থেমে যায়। বাবা খুশি হোন।
পরদিন সকাল। আকাশে রিমঝিম বৃষ্টি বইছে। সকাল থেকে আকাশ ঘুমোট অন্ধকার ।সারাদিন টিপটিপ করে ঝরণা ঝরছে। আজ খন্দকার সাহেবের অফিস ছুটি। তাই আবিদকে নিয়ে মার্কেটে যাবেন। কিন্তু অবিরাম বৃষ্টির কারণে এখনো বাসা থেকে বের হতে পারছেন না।
ইতিমধ্যে আবিদকে না জানিয়ে ব্যাগের ভিতর সবগুলো খেলনা ও পোষাক ভরে নিলেন।

আবিদ ব্যাগ দেখে তার আব্বুকে জিজ্ঞেস করে "আব্বু ব্যাগের ভিতর কি?"
খন্দকার সাহেব বললেন, "সেদিনের জিনিসগুলো।"
"কি করবে বাবা?"
"ফেরত দিবো।"
"না বাবা অগুলো ফেরত দিতে হবে না। রেখে দাও।"
"কেনো?" বাবার প্রশ্ন।
"আমার অনেক ক্লাসবন্ধু আছে। যারা ঈদে ভালো কাপড় পড়তে পারে না। সুন্দর পোষাক পায়না। নতুন জামা জোগাড় করতে পারেনা। জামাগুলো আমি ওদেরকে দিবো।
আমার বন্ধু রবিনের ছোটোবোন মাঝে মাঝে স্কুলে আসে। খেলনা গুলো তাকে দিবো। ওরা অনেক খুশি হবে। আনন্দ পাবে। মজা করে ঈদ করতে পারবে।"
খন্দকার সাহেব আট বছরের ছেলের মুখে এমন দরদমাখা কথা শুনে চমকে উঠলেন। তিনি বিস্মৃত হলেন। এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন আবিদের দিকে।
মনে মনে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন। আনন্দে চোখের কোণে হালকা জল গড়িয়ে পড়লো।
আবিদ একমনে খেলনাগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলো। ও কোন বন্ধুকে কোনটি দিবে তা নির্ণয করছিলো। আর আলাদা আলাদা করে ভাঁজ করছিলো।
অনেকক্ষণ বাবার কোনো সারাশব্দ না পেয়ে বাবার দিকে তাকালো আবিদ।
বাবার চোখে জল ভাসতে দেখে ও কাছে গেলো। বললো, আমি খেলনাগুলো দিতে চাই দেখে তুমি কাঁদছো।
তুমি দিতে চাওনা। তুমি কি আমার বন্ধুদের ভালোবাসোনা। বন্ধুদের খুশিতে খুশি হওনা।
খন্দকার সাহেব চুপ করে আছেন। কিছু বলেন না। তার মুখে কোনো ভাষা নেই। কিন্তু অবুজ বালক আবিদ বাবাকে চুপ থাকতে চায়না। কিছু একটা বলুক এমনটিই চায়। তাই বারবার জিজ্ঞোস করে। জবাব না পেয়ে একসময় সেও কেঁদে দেয়। তখন বাবা আবিদ বুকে টেনে নেয়। আদর দেয়। জড়িয়ে ধরে আবিদকে । কান্নাময় কণ্ঠে বাবা বলেন, "আজ যদি তোর মা বেঁচে থাকতো? তবে তোকে নিয়ে তোর মায়ের সামনে দাড়িয়ে বলতাম দেখো তোমার সন্তানকে আমি পরপকারের শিক্ষা দিয়েছি। সাম্যের শিক্ষা দিয়েছি। মানবতার শিক্ষা দিয়েছি।
বাবা ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছে। আবিদ বাবার কান্না দেখে জোরে জোরে চিৎকার করছে।
আবিদের কান্না থামাতে খন্দকার সাহেব বলেন,
"আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে। আর কেঁদো না। কালই তোমাকে নিয়ে স্কুলে যাবো। তোমার বন্দুদেরকে জামাগুলো উপহার দিবো। খেলনাগুলো দিবো রবিনের ছোটোবোনকে।"
আবিদ খুশি হয়। শান্ত হয়।
সেদিন আর মার্কেটে যাওয়া হয়না।

০৩
আবিদ পরদিন স্কুলে যায়। বন্ধুদের সাথে ওর বাবার কিনে আনা খেলনা ও জামাকাপড় নিয়ে গল্প করে।
আবিদ বলে জানিস, "আমার বাবা আমার জন্য সাপ কিনে এনেছে। সাপটি শরীর মুড়িয়ে মুড়িয়ে চলে। মাঝে মাঝে ফনা তুলে আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমি ভয় পেয়ে যাই তখন। গা শিউরিয়ে উঠে। আমি ভয়ে চিৎকার দেই। তখন বাবা দৌড়ে এসে আমাকে রক্ষা করেন।"
ওর বন্ধুদের থেকে রবিন কম কথা বলে। ও একটু দরিদ্র। তাই এসব শুধু শুনতেই পারবে। কোনোদিন বাস্তবে এসব খেলনার মুখ দেখবেনা। এতো দামি খেলনা কে কিনে দিবে ওকে? তাই সব সময় চুপ করে থাকে ও।
আবিদ দেখলো রবিনের মন খারাপ। তাই রবিনকে ওর ছোটো বোনটির কথা জিজ্ঞেস করে ওর দুঃখ কমাতে চাইলো। রবিন কিছুই বললো না।
তখন আবিদ বললো, "আমি বাবাকে বলেছি, খেলনাগুলো রবিনের বোনকে দিবো। বাবা রাজী হয়েছেন। খুশিতে রবিন বললো, সত্যিই।
আবিদ বললো, হ্যাঁরে সত্যি।

আমার আব্বু আমাকে অনেক ভালোবাসেন । আদর করে। আমি যা বলি আব্বু তাই করেন। যাই চাই তাই কিনে দেন। আমার খেলনাগুলো অনেক পছন্দ হয়েছিলো। কিন্তু আব্বুকে বলেছি পছন্দ হয়নি। যেনো আব্বু আবার কিনে দেন। আর এগুলো বন্ধুদের দিতে পারি। আমার আব্বু অনেক ভালো। ওর বন্ধুরা এসব কথা শুনে আবিদের জন্য অনেক দোয়া করে। ক্লাস ছুটি হলে সেদিনের মতো বাড়ী যায় আবিদ।

০৪
পরদিন স্কুলের দিকে রওয়ানা হয়। গাড়ীতে রাখা হয় নতুন জামা ও প্লাস্টিকের খেলনা।
মতিঝিল ট্রাফিক সিগন্যালে দাড়ায় ওদের গাড়ী। একটু পর জ্বলে উঠে নীল বাতি। সচল হয়ে উঠে ইঞ্জিল। হঠাৎ করে একটি ট্রাকের সাথে ধাক্কা লাগে গাড়ীটি। দুমড়ে মুচড়ে যায় ওদের গাড়ী। ছিটকে পড়ে আবিদের বাবা খন্দকার সাহেব। ড্রাইভারের দেহ থেতলে যায়। গাড়ীতে রয়ে যায় আবিদ। আবিদের শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে। হাসপাতালে নেয়া হয় আবিদ কে। আবিদের বাবা আবিদকে বাঁচাতে পাগলের মতো ডাক্তারের কাছে ছুটে যান। ডাক্তার খন্দকার সাহেবকে শান্তনা দেন। সুস্থ হয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেন। বাবা বাইরে দাড়িয়ে আবিদের কথা ভাবতে থাকেন। আবিদকে হৃদয় থেকে আদর করতে থাকেন। আবিদের স্মৃতি আওড়াতে থাকেন।

ইতিমধ্যে আবিদের রোড এক্সিডেন্টের খবর পৌঁছে যায় স্কৃলে। দৌড়ে ছুটে আসে আবিদের বন্ধুরা। ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞা ছিলো প্রবেশে। তাই ভিতরে ঢুকতে পারেনা ওরা। আবিদের বাবাকে বাইরে দাড়িয়ে কাঁদতে দেখে ওরা। তাঁর কাছে গিয়ে ওরা তাকে শান্তনা দিতে থাকে। মুশতাক সাহেব ওদের জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে আরো জোরে কেঁদে দেন। চোখের অশ্রু সংবরণ করতে পারেন না তিনি। ধূসর অন্ধকারের মতো মনে হয় তাঁর কাছে। রবিনরা খন্দকার সাহেবের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। তবু তার কান্না থামেনা। খন্দকার সাহেবের কান্না দেখে কচি বাচ্চারাও কান্না জুড়ে দেয়। তাদের কান্নায় হাসপাতালের পরিবেশ ঘোলাটে হয়ে যায়। এক থমথমে দুঃখময়ী পরিবেশ হাসপাতাল জুড়ে বিরাজ করতে থাকে। একটু পর বেরিয়ে আসেন ডাক্তার সাহেব। খন্দকার সাহেব দৌড়ে ছুটে যান ডাক্তারের কাছে। সাথে আবিদের বন্ধুরা। ডাক্তার সাহেব কালো চশমার ভিতর দিয়ে কাদু কণ্ঠে সরি বলে চলে গেলেন। ডাক্তারের চলে যাওয়া দেখে নিথর বসে থাকেন আবিদের বাবা খন্দকার মুশতাক সাহেব ও আবিদের প্রিয় বন্ধু রবিন ও অন্যরা।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ