হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক আমির আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী রহ.-এর চলে যাওয়ার চার বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। ২০২১ সালের এই দিনে (১৯ আগস্ট) তিনি পরকালের উদ্দেশে পাড়ি জমান।
আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী একজন সাহসী ও বিপ্লবী আলেম ছিলেন। আওয়ামী দুঃশাসনের শিকার হয়ে তাকে কারাবরণও করতে হয়। হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ছাড়াও তিনি দারুল উলুম হাটহাজারীর দীর্ঘকালের মুহাদ্দিস ও শাইখুল হাদিস ছিলেন। আল্লামা আহমদ শফী রহ. পরবর্তী সময়ে তিনি সারাদেশের মানুষের আস্থা ও ভালোবাসার ঠিকানায় পরিণত হয়েছিলেন।
আল্লামা হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরী ১৯৫৩ সালের ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার বাবুনগর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবুল হাসান ও মাতা ফাতেমা খাতুন। হারুন বাবুনগরী তার নানা। মায়ের দিক দিয়ে তার বংশধারা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এর সাথে মিলিত হয়।
শিক্ষাজীবন: ৫ বছর বয়সে তিনি আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগরে ভর্তি হন। এখানে তিনি মক্তব, হেফজ ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। কুরআনের হেফজ শেষ করার পর আজহারুল ইসলাম ধর্মপুরীর কাছে তিনি পুরো কুরআন মুখস্থ শুনিয়েছিলেন। এরপর তিনি ভর্তি হন দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসায়। ১৯৭৬ সালে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।
হাটহাজারী মাদরাসায় তার উল্লেখযোগ্য শিক্ষকগণের মধ্যে রয়েছেন: আব্দুল কাইয়ুম, আহমদুল হক (মুফতি), আবুল হাসান, আব্দুল আজিজ, শাহ আহমদ শফীসহ প্রমুখ খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ।
তারপর উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি পাকিস্তান যান। ১৯৭৬ সালে করাচিতে অবস্থিত জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় তাখাচ্ছুছাত ফিল উলুমুল হাদিস তথা উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগে ভর্তি হন। ২ বছর হাদিস নিয়ে গবেষণা সম্পন্ন করে তিনি আরবি ভাষায় ‘সীরাতুল ইমামিদ দারিমী ওয়াত তারিখ বি শায়খিহী’ (ইমাম দারিমী ও তার শিক্ষকগণের জীবন বৃত্তান্ত) শীর্ষক অভিসন্দর্ভ জমা দেন। এই অভিসন্দর্ভ জমা দেওয়ার পর তিনি জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়া থেকে হাদিসের সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন।
জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় তার উল্লেখযোগ্য শিক্ষকগণের মধ্যে রয়েছেন: মুহাম্মদ ইউসুফ বিন্নুরী, ইদ্রিস মিরাঠী, আব্দুল্লাহ ইউসুফ নোমানীসহ প্রমুখ। পাশাপাশি তিনি ওয়ালী হাসান টুঙ্কির কাছে সুনান আত-তিরমিজী ও মুহাম্মদ ইউসুফ বিন্নুরীর কাছে সহীহ বুখারী দ্বিতীয় বারের মত অধ্যয়ন করেন।
কর্মজীবন: ১৯৭৮ সালের শেষের দিকে তিনি দেশে ফিরে বাবুনগর মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। বাংলাদেশের মাদরাসা সমূহের সর্বপ্রথম বাবুনগর মাদরাসায় তিনি উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগ চালু করেন। ২০০৩ সালে তিনি দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসায় যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি হাটহাজারী মাদরাসার সহকারী পরিচালক নিযুক্ত হন। ২০২০ সালের ১৭ জুন মাদরাসা কমিটি সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়। তার স্থলে মাদরাসার জ্যেষ্ঠ শিক্ষক শেখ আহমদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি হাটহাজারী মাদরাসার শাইখুল হাদীস এবং শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহ-সভাপতি, চট্টগ্রাম নূরানী তালীমুল কুরআন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং মাসিক মুঈনুল ইসলামের প্রধান সম্পাদক, মাসিক দাওয়াতুল হকের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
তাসাউফ: শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে আধ্যাত্মিক দীক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ১৯৭৮ সালে তিনি আব্দুল কাদের রায়পুরীর উত্তরসূরী আব্দুল আজিজ রায়পুরীর নিকট বায়’আত গ্রহণ করেন। রমযান মাসে তিনি রায়পুরীর খানকায় অবস্থান করে কিছুকাল তার সান্নিধ্যে ছিলেন।
বাংলাদেশে তিনি যাদের কাছে খেলাফত পেয়েছেন: হুসাইন আহমদ মাদানির দুই শিষ্য- আব্দুস সাত্তার, ফতেয়াবাদ, শাহ আহমদ শফী, রাঙ্গুনিয়া। আবুল হাসান আলী নদভীর শিষ্য সুলতান যওক নদভী
পরিবার: তিনি ৫ মেয়ে ও ১ ছেলের জনক। ছেলের নাম মুহাম্মদ সালমান।
রচনা: আরবি, উর্দু ও বাংলায় তার রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ত্রিশটি। দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামার আরবি পত্রিকা আল বাসুল ইসলামি, দারুল উলুম দেওবন্দের মাসিক পত্রিকা আদ দায়ী, দারুল উলুম হাটহাজারীর মাসিক আল মুঈনসহ বিভিন্ন সাময়িকীতে অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন তিনি।