মাওলানা মামুনুল হক
রাত দুইটায় ফ্লাইট । সৌদি এয়ারলাইন্সের বিমানযোগে পবিত্র বাইতুল্লাহর নগরী মক্কা মোয়াযযামা গন্তব্য । সাধারণত ভি আই পি গেট দিয়ে ঢুকে যাই । তাই এখানে সময় কিছুটা কম লাগে ।
রাত এগারোটারও আগে বসিলা থেকে বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা করি । রাস্তাঘাট প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ফাঁকা ছিল। দ্রুতই পৌঁছে যাই বিমানবন্দরে । ভিআইপি লাউঞ্জে এক কাপ চায়ের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করি । হাতে তখনো সময় দুই ঘণ্টার মত। তাই ধীরে সুস্থেই বোর্ডিং পাস নেওয়ার জন্য এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে যাই ।
পাসপোর্ট এর সাথে তারা ভিসার কাগজ চায় । আমার কাছে তো ভিসার কোন কাগজ নেই । এক বছরের মাল্টিপল ভিসা নিয়েছিলাম ২৪ এর ডিসেম্বর মাসে । আমার ধারণা ছিল পাসপোর্ট স্ক্যান করলেই ভিসার কপি চলে আসবে । কিন্তু কাউন্টারের লোকজন বলল ভিসার নম্বর লাগবে । আমার কাছে তো তা নেই। তারা জানতে চাইল অন্তত কোন ছবি আছে কিনা । কয়েকদিন আগে মোবাইল সেট পরিবর্তন করায় সেটাও নাই । তখন কী করি উপায় ?
কতক্ষণ ফোন গ্যালারিতে হাতরালাম, ভিসার কোন ছবি পাওয়া যায় কিনা। পেলাম না। মনে হল আমার ভিসা প্রসেসিং এর জন্য যে ছেলেটা সহযোগিতা করেছিল, ওকে ফোন দিয়ে দেখি। কিন্তু সমস্যা হল সে আমার এমন একজন ছাত্র, যার নাম আমি স্মরণে রাখতে পারিনি । আমি সাধারণত খুব কম মানুষেরই নাম স্মরণ রাখতে পারি। এটা সম্ভবত উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার কাছ থেকে পাওয়া ।
আব্বাজান হযরত শায়খুল হাদীস রাহিমাহুল্লাহর এই সংক্রান্ত মজার একটা গল্প আছে । তিনি একবার হযরত মাওলানা হিফজুর রহমান মুমিনপুরী হুজুরদের ছাত্র জামানায় দরসে বলেছিলেন, আমার তো ছাত্রদের নাম তেমন একটা মনে থাকে না, ফজলুর রহমান তোমার নামটা শুধু মনে আছে !! এই হল অবস্থা ! হিফজুর রহমানকে বলছেন ফজলুর রহমান তোমার নামটা মনে আছে !
যাই হোক আমার এই ছাত্রের নাম মনে না থাকায় ফোন দিলাম বন্ধুবর ইসমাইল শরীফ ভাইকে । কারণ সেই ছাত্র ওনার শ্যালক । কিন্তু ইসমাইল শরীফ ভাই ফোন রিসিভ করলেন না । ফোন দিলাম আমাদের সহপাঠী আলালপুরের মাওলানা মুস্তফাকে । মুস্তফা হলো আবার শরীফের বন্ধু । সেও ফোন রিসিভ করল না । কি করি বুঝে উঠতে পারলাম না ।
পুরনো ফোন সেটটাতে খুঁজে দেখা যেত কিনা । কিন্তু পুরনো ফোন সেটটা রেখে এসেছি এমন এক জায়গায়, যেটা তালাবদ্ধ । সেই তালার চাবি আবার আরেক জায়গায় । সেই চাবি নিয়ে তালাবদ্ধ জায়গা থেকে ফোন সেট বের করে সেটা হাতরে সেখান থেকে ভিসা খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব রকম ব্যাপার । তবুও সেটা চেষ্টা করা যেত, কিন্তু চাবি হলো আমার গাড়িতে । গাড়ি তখনো বাসায় পৌঁছেনি ।
এদিকে কিছু করতে না পেরে ফোন দিলাম আল আকসা ট্রাভেলসের মুফতি মোহাম্মদ উল্লাহ ভাইকে । যার মাধ্যমে উক্ত ভিসায় ইতিপূর্বে ওমরার সফর করেছি । তিনি ময়মনসিংহের মানুষ। চিন্তা করলাম তিনি হয়তো আমার সেই ছাত্রের নাম বলতে পারবেন । কিন্তু তিনি ইসমাইল শরীফ ভাইকেই চিনেন না তার শ্যালকের নাম বলবেন তো দূর কি বাত ।
বাসায় ফোন দিয়ে আহলিয়া মুহতারামাকে বললাম পুরনো ওমরার কাগজপত্র ঘেটে ভিসার কোন হদিস পাওয়া যায় কিনা । কিছুক্ষণ পর "না" বাচক উত্তর এলো বাসা থেকে ।
হতাশ হয়ে ফোন দিলাম আমাদের ছাত্র মাওলানা গাজী সানাউল্লাহ রাহমানীকে । এম্বাসির লোকজনের সাথে তার যোগাযোগ আছে । তার মাধ্যমে কোনোভাবে ভিসার কোন লিংক খুঁজে পাওয়া যায় কিনা । মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠিয়ে তাকে দিয়ে চেষ্টা করলাম । সে এম্বাসির কোন লোকের সাথে ফোনে যোগাযোগ করল । কিন্তু সেখান থেকে তখন কোন প্রতিউত্তর পাইনি ।
এদিকে আমি চারিদিকে যোগাযোগ করছি ওদিকে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘুরছে ঘড়ির কাঁটা ।
এয়ারলাইন্সের কাউন্টারের লোকজন তাগাদা দিচ্ছে কোনো একটা ব্যবস্থা করার । সেখানে আবার এক দুজন ভাই যুক্ত হলেন আমার সাথে । তারা সহযোগিতা করার চেষ্টা করলেন । এক ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন যাত্রী সেবা কক্ষের একটা কাউন্টারে । সেখানে আমার পাসপোর্ট স্ক্যান করে ভিসার কাগজ খুঁজে দেখা হলো ।
এর মধ্যেই ফোনে কথা হলো মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী সাহেবের সাথে । তিনি বললেন পাসপোর্টের ছবি পাঠাতে । তিনি নিজেই সফটওয়্যারের মাধ্যমে খুঁজে বের করে দিবেন । তাকে পাসপোর্টের ছবি পাঠিয়ে দিলাম ।
ইতিমধ্যে কাউন্টারের লোক স্ক্যান করে একটা ভিসা পেয়ে গেল এবং দ্রুতই প্রিন্ট করে দিল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। টিকেট কাউন্টারের দিকে আসতে আসতে ফোন করে আইয়ুবী সাহেব মোহাম্মদ উল্লাহ ভাই গাজী সানাউল্লাহ এবং বাসা সব জায়গায় জানিয়ে দিলাম ভিসা পাওয়া গিয়েছে। সমস্যা সমাধান হওয়য় সবাই আশ্বস্ত হল । শুকরিয়া আদায় করলাম মহান আল্লাহর দরবারে।
নিশ্চিন্ত মনে কাউন্টারে এনে ভিসার কাগজ দিলাম। কাউন্টারের লোকজন একটু হাতরে কিছুক্ষণ পর জানালো এটা তো হজের ভিসা, এটা দিয়ে কাজ হবে না।
হাতে তখন সময় খুবই কম। মাথায় যেন আকাশটা ভেঙ্গে পড়ল।
আবার ছুটে গেলাম প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কে। তারা কিছু করতে পারে কিনা। কিছুই করা গেল না। ঐদিকে পবিত্র মক্কা থেকে বন্ধুজনরা ফোন দিয়ে জানতে চাচ্ছে, আমি বোর্ডিং পেয়েছি কিনা। এমন পরিস্থিতিতে আবার ফোন দিলাম সানাউল্লাহকে। সে কনফারেন্স করে এম্বাসিতে কর্মরত মনির ভাইকে সংযুক্ত করল। তিনি আমাকে বললেন, সৌদি এয়ারলাইন্সের অফিস আছে বিমানবন্দরে, সেখানে খোঁজ নিতে। দৌড়ে গেলাম সেখানে। টিকেট কাউন্টারে গিয়েও কোন কাজ হলো না।
সবদিক থেকে নিরাশ হয়ে একে একে আবার সবাইকে জানাতে লাগলাম, আমার আর যাওয়া হচ্ছে না সম্ভবত।
এমন সময় মোহাম্মাদুল্লাহ ভাই ফোন করে জানালেন যে, তিনি দুইএক মিনিটের মধ্যেই তার অফিস থেকে আমার ওমরার সফরের টিকেট নম্বর এবং ভিসা পাঠাচ্ছেন। এক মিনিট দুই মিনিট পাঁচ মিনিট দশ মিনিট চলে যায়। আমি বারবার মোহাম্মাদুল্লাহ ভাইকে ফোনে আগাদা দিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখান থেকেও ভালো কোন সংবাদ এলো না।
কাউন্টারের লোকজন তাগাদা দিচ্ছিল কাউন্টার ক্লোজ করার। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা রাত একটার ঘর অতিক্রম করে এগিয়ে চলছে। মনে হচ্ছিল সময়ের চেয়ে দ্রুতগতিতে চলছে ঘড়ির কাঁটা। সবদিক থেকে নিরাশ হয়ে যখন একরকম হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে যাওয়া মনস্থ করলাম। কাউন্টারের লোকজনও দুঃখমাখা বদনে বলে দিচ্ছিল হযরত ভিসা না পাওয়া গেলে আমাদের কিছুই করার নেই। আমরা আর দেরি করতে পারছি না। এক্ষুনি কাউন্টার ক্লোজ করতে হবে।
বাইতুল্লাহর সফরের উদ্দেশ্যে এহরামের কাপড় পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এসে ব্যর্থ মনোরথে ফিরে যাওয়ার বেদনা তখন আমাকে গ্রাস করছিল।
হতাশার কালো মেঘে যেন ঝাপসা হয়ে আসছিল আমার চোখের দৃষ্টি। এমন সময় যেন হঠাৎ রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ হলো আর আমি সেই বৃষ্টিতে যেন স্নাত হলাম।
মনের ঈষৎ কোণে ভেসে উঠল একটা নামের অংশ বিশেষ। আমার সেই প্রিয় ছাত্র, অক্লান্ত পরিশ্রম করে যে ভিসার আয়োজন করে দিয়েছিল। তার নামের অংশবিশেষ তাহমিদ ! দীর্ঘ সময় মনে করতে চেয়েও যেটি মনে করতে পারিনি, বহু জনকে খুঁজেও হদিস পাইনি যে নামের, শেষ মুহূর্তে সে নামটির অংশবিশেষ আপনা আপনি ভেসে উঠলো মনের ক্যানভাসে। আমি তখনও নিশ্চিত নই তাহমিদ নাম কিনা। ফোন বুকের কন্টাক্ট লিস্টে সার্চ দিলাম। নাম ভেসে উঠলো তাহমিদ তাহসিন। নামটা দেখে এবার আমার পুর্ণ মনে পড়ে গেল তার কথা।
ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত সোয়া একটা। কল করলাম। শংকা ছিল এত রাতে ফোন বন্ধ থাকে কি না। খোলা থাকলেও কল রিসিভ হবে কি না। আল্লাহর মেহেরবানী রিং হল। দু-তিনবার রিং বাজতেই রিসিভও হল । আমি সংক্ষেপে ঘটনা বলে জানতে চাইলাম তার মোবাইলে আমার ভিসার কপি আছে কিনা। থাকার সম্ভাবনার কথা জানালো। আমি লাইন কাটতে কাটতে বললাম থাকলে পাঠাও। মুহূর্তের মধ্যেই সে ভিসার ছবি আমার ইনবক্সে পাঠিয়ে দিল।
আকাশের পূর্ণিমার চাঁদ যেন এসে ধরা দিল আমার হাতের মুঠোয়। তৎক্ষণাৎ আমি কাউন্টারে সেটা দেয়ার পরেই কাউন্টার থেকে আমার বোর্ডিং পাস নিশ্চিত করা হলো।
বোর্ডিং পাস নিয়ে ছুটলাম ইমিগ্রেশনের উদ্দেশ্যে । ইমিগ্রেশনের পুলিশরা সহযোগিতা করল। কাউন্টারে দ্রুতই আমার ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ হলো। ইমিগ্রেশন পার হওয়ার পরেই চেকিংয়ের দায়িত্বরত অফিসার আমার হাত থেকে পাসপোর্টটা নিয়ে বললেন স্যার ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ হয়নি, একটু পাসপোর্ট টা দিন। পাসপোর্ট নিয়ে আরেক জায়গায় চলে গেল সে। তার চেহারার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল কোনো প্রব্লেম আছে। বুঝতে চাইলাম কি বিষয়। যতটুকু বুঝলাম, ঊর্ধ্বতন কোথাও যোগাযোগ করতে হচ্ছে। প্রথমে আশঙ্কা করলাম যে, হয়তো পুরোনো দিনের আমলের কোন কালো রেখা আমার পাসপোর্টের সাথে এখনো জড়িয়ে থাকতে পারে। আবারো চিন্তার ভাজ পড়তে লাগলো কপালে। পুলিশের সেই কর্মকর্তা ছোটাছুটি করছিলেন, কিন্তু আমাকে কিছু বলছিলেন না পরিষ্কার ভাবে। তিনি আবার ছুটে গেলেন ইমিগ্রেশনের সেই কাউন্টারে, যেখান থেকে আমার পাসপোর্ট ইমিগ্রেশন করে দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে হাসতে হাসতে ফিরে এলেন নিজেই।
এতক্ষণের ছোটাছুটি ও অবশেষে স্বস্তির রহস্য উন্মোচন করলেন নিজেই, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা পাসপোর্টে ইমিগ্রেশন ওকে করে তিনি একটা সংখ্যা লিখে দিয়েছেন 710। কিন্তু ঘটনাচক্রে চেক করার সময় তিনি পাসপোর্ট উল্টো করে ধরে শূন্যটাকে মনে করেছেন ইংলিশ বর্ণ O লেখা আর 7 টাকে মনে করেছেন C লেখা। মধ্যখানে 1 সংখ্যাটাকে তিনি ধরেছেন একটা বিরতি চিহ্ন। এতে দাঁড়ায় O,C । হয়তো তিনি এতে মনে করেছেন যে, আমার ইমিগ্রেশনের জন্য ওসির সাথে যোগাযোগ করতে হবে । তাই কিছুটা ইতস্তত করছিলেন। তার এই ইতস্তত ভাব আমাকেও কিছুটা বিচলিত করে শঙ্কায় ফেলে দিচ্ছিল। অবশেষে আল্লাহর মেহেরবানীতে সকল শংকা-দুশ্চিন্তা দূরীভূত হল।
আমি সামনে অগ্রসর হলাম। হাতে তখনও কিছুটা সময় আছে। ওইদিকে আমার এশার নামাজ আদায় করা হয়নি। দ্বিতীয় তলায় গিয়ে প্রথমে এশার নামাজ আদায় করলাম। ফ্লাইটের সময় তখন আধাঘন্টারও কম বাকি আছে । তাই আর সেখানে এহরামের নামাজ না পড়ে ছুটে চললাম বিমানের গেটের দিকে। সেখানে গিয়ে সর্বশেষ তল্লাশি অতিক্রম করে ভিতরে গিয়ে বসলাম। যাত্রীরা ততক্ষণে প্রায় সকলেই বিমানে উঠে গিয়েছে। আর কিছু মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে। সময় পেয়ে দু রাকাত এহরামের নামাজ পড়ে এহরামের নিয়ত ও তালবিয়া পড়ে নিলাম। অতঃপর ধীর কদমে চললাম সৌদি এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৮০৩ এর দিকে। নির্ধারিত আসন গ্রহণ করলাম। আল্লাহ পাকের শোকর গুজারির অনুভূতি তখন আমার মন ও মানসজুড়ে। আল্লাহই মহান কুদরতের মালিক।
তিনি জীবিত থেকে মৃতকে আবার মৃত থেকে জীবিতকে বের করে আনেন।
তিনি দিনের আলোকে ঢেকে দেন রাতের নিকষ কালো অন্ধকারে। আবার তিমির রাতের আঁধার চিরে তিনিই বের করে আনেন শুভ্র সকালের প্রভাত রশ্মি।
সম্ভাবনাকে ঢেকে দেন শংকার চাদরে। আবার সকল শংকার ঘন কুয়াশা ভেদ করে উদ্ভাসিত করেন সম্ভাবনার আশার আলো।
বিমান ছুটে চলল আমাদের সেই মহান রবের পবিত্র ঘর কাবার পাণে......
লেখক: আমির, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস; যুগ্ম মহাসচিব, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ
এসএকে/