বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫ ।। ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ ।। ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

শিরোনাম :
২১ নভেম্বর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী দিবস ২০২৫: বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ নামধারীদের বিরুদ্ধে উলামায়ে কেরামের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে: জাতীয় উলামা কাউন্সিল গাজায় ইসরায়েলের হামলায় কাতারের নিন্দা চট্টগ্রামে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে গাড়ি ছিটকে পড়ে পথচারী নিহত, আহত ৪ দক্ষিণ বাসাবো বালুর মাঠে শুরু হলো জাতীয় তাফসীরুল কুরআন মাহফিল আগামী ৩-৪ কার্যদিবসের মধ্যে গণভোট আইন করা হবে আন্দোলনরত ৮ দলের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচিতে আংশিক পরিবর্তন বিশ্ব পাইলস দিবস : কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে জটিলতা—সমাধানে সচেতন ও পরিকল্পিত জীবনধারা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহালের মধ্য দিয়ে জনগণের বিজয় অর্জিত হয়েছে - খেলাফত মজলিস  ‘আল্লাহকে নিয়ে কটূক্তি’র অভিযোগে মানিকগঞ্জের বাউল শিল্পী ডিবি হেফাজতে

বিশ্ব পাইলস দিবস : কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে জটিলতা—সমাধানে সচেতন ও পরিকল্পিত জীবনধারা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

||ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ||
 
আজ বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫—বিশ্ব পাইলস দিবস। মানবদেহের অন্যতম পরিচিত ও যুগধারাবাহিক একটি রোগ হলো পাইলস বা হেমোরয়েড। হাজার বছরের চিকিৎসা-ইতিহাসের পাতায় এ রোগের বর্ণনা পাওয়া যায়। আধুনিক বিশ্বেও এটি অন্যতম সাধারণ মলদ্বারজনিত সমস্যা। তবুও লজ্জা, কুসংস্কার, ভুল ধারণা এবং সচেতনতার অভাবে অনেকেই যথাসময়ে চিকিৎসা নিতে চান না—ফলে সহজ একটি রোগ জটিলতার দিকে এগিয়ে যায়।
 
বিশ্বে পাইলসের প্রাদুর্ভাব
 
বৈশ্বিক গবেষণা বলছে—বিশ্বের ৪-৫% মানুষ যেকোনো সময়ে পাইলসে ভুগছেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ রোগের ঝুঁকি আরও বাড়ে। ৫০ বছরের পরে প্রায় অর্ধেক মানুষের কখনো না কখনো পাইলসের অভিজ্ঞতা হয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতিবছর কয়েক মিলিয়ন মানুষ পাইলসজনিত কারণে চিকিৎসা নেন।
 
বাংলাদেশে এ রোগের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি। অনুমান অনুযায়ী আমাদের দেশের প্রায় ২০%–২৫% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কোষ্ঠকাঠিন্য, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, পানি কম পান, ফাস্টফুড গ্রহণ এবং দীর্ঘসময় বসে থাকার কারণে পাইলস বা সম্পর্কিত অন্য মলদ্বার রোগে আক্রান্ত হন। উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো—পাইলসের ৭০% ক্ষেত্রেই মূল কারণ হচ্ছে দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য।
 
নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় হরমোনগত পরিবর্তন, রক্তচাপ বৃদ্ধি এবং শিশুর চাপের কারণে ৩০%–৩৫% ক্ষেত্রে পাইলসের উপসর্গ দেখা দেয়। সব মিলিয়ে এটি কোনো বিরল রোগ নয়; বরং জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত একটি সাধারণ স্বাস্থ্যসমস্যা।
 
কোন বয়সে বেশি দেখা যায়?
 
সাধারণত ৩০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের মধ্যে পাইলস বেশি দেখা যায়। তবে আধুনিক জীবনধারা—কম চলাফেরা, ডেস্ক জব, ফাস্টফুড, তেলেভাজা খাবার—সব মিলিয়ে আজকাল তরুণদের মাঝেও পাইলসের হার বাড়ছে।
অনেকেই মনে করেন, মলদ্বারের যেকোনো রক্তপাত, ব্যথা বা গুটি মানেই পাইলস। বাস্তবে একই উপসর্গ ফিশার, ফিস্টুলা, সংক্রমণ বা এমনকি ক্যান্সারের কারণেও হতে পারে। তাই সঠিক পরীক্ষা ছাড়া রোগ নির্ণয় করা বিপজ্জনক।
 
পাইলস কীভাবে হয়—মলদ্বারের রক্তনালির ভূমিকা
 
মলদ্বার একটি ২–৩ ইঞ্চি লম্বা নালি, যার ভেতরে বিশেষ ধরনের রক্তনালি থাকে—রেকটাল ভেইন। এসব রক্তনালিতে চাপ বাড়লে ফুলে উঠে পাইলস তৈরি হয়। পাইলস সাধারণত দুই ধরনের—
 
১. এক্সটারনাল হেমোরয়েড
 
মলদ্বারের বাইরের অংশে ঘটে।
উপসর্গ— * তীব্র ব্যথা * ফোলা
* চুলকানি * রক্তপাত।অনেক সময় রক্ত জমাট বেঁধে থ্রম্বোসড পাইলস হয়, যা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক।
 
২. ইন্টারনাল হেমোরয়েড
 
মলদ্বারের ভেতরের অংশে ঘটে।
উপসর্গ—* টয়লেটে তাজা লাল রক্ত
* ব্যথা * টয়লেটের সময় মাংসপিণ্ড বের হয়ে আসা।ইন্টারনাল পাইলস আবার চার গ্রেডে ভাগ করা হয়—শুরুতে শুধু রক্তপাত, পরে পাইলস নিচে নেমে আসে, আর শেষ পর্যায়ে স্থায়ীভাবে বাইরে বের হয়ে থাকে।
 
পাইলস হওয়ার কারণ—যা আমাদের জীবনধারার সঙ্গে সম্পর্কিত
 
পাইলস একটি ‘লাইফস্টাইল ডিজিজ’। এর প্রধান কারণগুলো হলো—* দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য
* ঘনঘন ডায়রিয়া * গর্ভাবস্থা
* অতিরিক্ত ওজন * দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা * ডেস্ক জব
* কম আঁশযুক্ত খাবার * পর্যাপ্ত পানি না পান * টয়লেটে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা।এসব অভ্যাসে মলদ্বারের রক্তনালিতে চাপ পড়ে এবং সময়ের সঙ্গে পাইলস তৈরি হয়।
 
উপসর্গ—কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
 
নিম্নলিখিত উপসর্গ দেখলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি—* মলত্যাগের সময় তাজা রক্ত * তীব্র ব্যথা * মলদ্বারে চুলকানি বা জ্বালা * গুটি বা ফোলাভাব অনুভব * মলত্যাগে কষ্ট * মলদ্বার থেকে কিছু বের হয়ে থাকা।এসব উপসর্গ পাইলস ছাড়াও অন্য জটিল রোগের ইঙ্গিত হতে পারে।
 
সঠিক রোগ নির্ণয়—কেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ?
 
নিজে নিজে ধারণা করে চিকিৎসা শুরু করলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। গবেষণা বলছে—যারা ভাবেন তাদের পাইলস হয়েছে, তাঁদের প্রায় ৩০% ক্ষেত্রে ভিন্ন রোগ পাওয়া যায়। তাই প্রয়োজনীয় পরীক্ষা জরুরি। সাধারণত যে পরীক্ষাগুলো করা হয়— * ডিজিটাল রেক্টাল পরীক্ষা * প্রক্টোস্কপি * সিগময়ডোস্কপি * কোলোনোস্কোপি
* সঠিক রোগ নির্ণয়ই সঠিক চিকিৎসার প্রথম ধাপ।
 
পরিসংখ্যান যা বলে—পাইলস প্রতিরোধ করা সম্ভব
 
গবেষণায় দেখা গেছে— * ২৫–৩০ গ্রাম আঁশ প্রতিদিন গ্রহণ করলে কোষ্ঠকাঠিন্যের ঝুঁকি ৫০% কমে।
 
* যারা দৈনিক ২.৫–৩ লিটার পানি পান করেন, তাঁদের পাইলস হওয়ার সম্ভাবনা ৪০% কম। * ২০–৩০ মিনিট নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করলে ঝুঁকি ৩০% কমে।
 
অতএব প্রতিদিন যা মেনে চলা উচিত—* বেশি শাকসবজি, ফল, ডাল, শস্য খাওয়া * পর্যাপ্ত পানি পান
* অতিরিক্ত তেলেভাজা, ফাস্টফুড পরিহার * দীর্ঘসময় একভাবে বসে না থাকা * নিয়মিত ব্যায়াম * মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ * টয়লেটে অযথা সময় না বসা
 
চিকিৎসা—হোমিওপ্যাথির দৃষ্টিকোণ
 
হোমিওপ্যাথিতে রোগ নির্ণয় করা হয় রোগীর ব্যক্তিগত শারীরিক–মানসিক বৈশিষ্ট্য, খাদ্যাভ্যাস, জীবনধারা এবং উপসর্গের ভিত্তিতে। সাধারণত ব্যবহৃত কিছু ওষুধ হলো-এসকিউলাস হিপ,অ্যালো,সালফার
,নাক্স ভমিকা,কলিনসোনিয়া,অ্যাসিড নাইট্রিক,অ্যালুমিনা,আর্সেনিকাম অ্যালবাম,অ্যানটিম ক্রুড।যেকোনো হোমিও ওষুধ ব্যবহারের আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ থাকা জরুরি। ভুল ওষুধ রোগকে দীর্ঘায়িত করতে পারে।
 
জীবনযাপনে পরিবর্তন—চিকিৎসার ৮০% সাফল্য
 
বাংলাদেশে মলদ্বারজনিত রোগ দ্রুত বাড়ছে—যার মূল কারণ অতিরিক্ত বসে থাকা জীবনধারা, পানি কম পান করা, কোষ্ঠকাঠিন্য, জাঙ্কফুড এবং অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস। চিকিৎসকদের মতে—
পাইলসের প্রায় ৮০% ক্ষেত্রেই সঠিক জীবনযাপন ও ওষুধে চিকিৎসা সম্ভব; অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে খুব কম ক্ষেত্রে।
 
অনেকেই লজ্জা বা ভয় থেকে চিকিৎসা নেন না, যার ফলে রক্তস্বল্পতা, সংক্রমণ এমনকি স্থায়ী প্রলাপসের মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে।
 
মনে রাখতে হবে—মলদ্বারের রোগ একটাই নয়। পাইলস ছাড়াও ফিশার, ফিস্টুলা, পলিপ, প্রলাপস, এনাল অ্যাবসেস—এসবও হতে পারে। তাই সব ব্যথা বা রক্তপাতকে ‘পাইলস’ ভেবে নেওয়া ঠিক নয়।
 
পরিশেষে বলতে চাই, পাইলসের মূল কারণ জীবনযাপন—আর এর সমাধানও জীবনযাপনেই। নিয়মিত পানি পান, আঁশযুক্ত খাবার, প্রতিদিন হাঁটাহাঁটি, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ এবং টয়লেটে সঠিক অভ্যাস—এই পাঁচটি বিষয় মেনে চললে পাইলস প্রতিরোধ করা খুব সহজ। লজ্জা নয়, সচেতনতা—এই দুই শক্তিই পারে পাইলস থেকে আমাদের রক্ষা করতে। সবার জন্য স্বাস্থ্যময় ও আরামদায়ক জীবন কামনা করি।
 
লেখক: চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ইমেইল: drmazed96@gmail.com
 
এলএইস/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ