রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫ ।। ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ ।। ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭


শীতের শুরুতেই নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম: পেঁয়াজ–সবজিতে নাজেহাল পরিবারগুলো

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

||ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ||
 
শীতের আগমন সাধারণ মানুষের জন্য নতুন সবজির বাজার, রান্নাঘরের বৈচিত্র্য এবং স্বাস্থ্যকর খাবারের আনন্দ নিয়ে আসে। তবে চলতি বছর শীতের শুরুতেই সেই আনন্দ হারিয়ে গেছে। দেশের প্রায় সব অঞ্চলের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম আগের তুলনায় তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে পেঁয়াজ ও সবজির ঊর্ধ্বমুখী দাম মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারকে গভীর অর্থনৈতিক চাপে ফেলেছে।
 
বর্তমানে বাজারে অধিকাংশ সবজির দাম বেড়ে ৮০–১৪০ টাকা কেজির মধ্যে পৌঁছেছে। বেগুন, বরবটি, শিম, করলা—মধ্যবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন রান্নার অপরিহার্য উপাদান—এসবের দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে। টমেটোর দাম বর্তমানে ১০০ টাকা, গাজর ও শিম ১৪০ টাকা, বরবটি ১২০ টাকা এবং বেগুনও ১০০ টাকার কোঠায়। এই দামবৃদ্ধি পরিবারগুলোকে কম খরচে খাবার তৈরি করতে বাধ্য করছে, যা খাদ্য বৈচিত্র্য হ্রাস এবং শিশু ও বৃদ্ধদের পুষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
 
পেঁয়াজ: রান্নাঘরের বড় সমস্যা
 
পেঁয়াজ, যা প্রায় প্রতিটি রান্নার অপরিহার্য উপাদান, তার দাম এখন ১২০–১৩০ টাকা কেজি। নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসলেও দাম কমছে না। ব্যবসায়ীদের মতে, উৎপাদন কম এবং আমদানির ওপর নির্ভরতা বেশি থাকায় দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এক পরিবারের মা জানালেন, "পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার স্বাদ থাকে না, কিন্তু দাম এত বেড়ে গেছে যে আমরা ব্যবহার কমাচ্ছি।" পেঁয়াজের এই উর্ধ্বমুখী দাম পরিবারগুলোর বাজেট এবং খাদ্য পরিকল্পনাকে জটিল করে তুলেছে।
 
সস্তা সবজির সীমিত স্বস্তি
 
কিছু কম দামের সবজি যেমন পটোল, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, ঢেঁড়শ পাওয়া যাচ্ছে ৭০–৮০ টাকায়। ফুলকপি ও বাঁধাকপি ৪০–৫০ টাকায় এবং আলু ২০–২৫ টাকায়। তবে এই সবজিও সবসময় পর্যাপ্ত পরিমাণে বাজারে পাওয়া যায় না। ফলে খাদ্য বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে, শিশু ও বৃদ্ধদের পুষ্টির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
 
প্রোটিনের বাজার: আপাত স্থিতিশীলতা
 
ডিম, মুরগি ও গরুর মাংসের দাম আপাতদৃষ্টিতে স্থিতিশীল। লাল ডিম ১৩০ টাকা, সাদা ডিম ১২০ টাকা। ব্রয়লার মুরগি ১৮০–২০০ টাকা, সোনালি মুরগি ২৮০–৩০০ টাকা, দেশি মুরগি ৫৫০–৬০০ টাকা। তবে সবজির অতিরিক্ত দাম পুরো পরিবারের বাজেট এলোমেলো করে দিচ্ছে। মানুষ প্রোটিন কিনতে গিয়ে আগে খরচ কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
 
মানুষের অভিজ্ঞতা
 
শহর-গ্রাম দুইপাশের মানুষই একই ধরনের অসহায়তার মুখোমুখি। এক গ্রামীণ নারী বললেন, "যা কিনতে গেছি, তার অর্ধেক নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয়।" শহরের এক ক্রেতা জানিয়েছেন, "সবজির দাম এত বেড়ে গেছে যে রান্নার রেসিপি পর্যন্ত পরিবর্তন করতে হয়েছে। শীত মানেই বাজারে স্বস্তি—এবার তা নেই।"
 
শুধু অর্থনৈতিক চাপই নয়, এই পরিস্থিতি সামাজিক ও মানসিক চাপও বাড়াচ্ছে। কম খরচে খাবার তৈরি করতে গিয়ে পরিবারগুলো একে অপরের মধ্যে তিক্ততা বা দুশ্চিন্তার শিকার হচ্ছে। অনেক মা–বাবা শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারছেন না, যা ভবিষ্যতে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে প্রভাবিত করতে পারে।
 
মূল কারণসমূহ
 
নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার পেছনে একাধিক কারণ কাজ করছে:
 
১. আবহাওয়ার অস্থিরতা ও ফসলহানি: অতিবৃষ্টি, কুয়াশা এবং শৈত্যপ্রবাহ ফসলের উৎপাদনে প্রভাব ফেলেছে।
 
২. পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি: জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপণ্য পরিবহনের খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে।
 
৩. মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি: উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত অতিরিক্ত লাভের চেষ্টা দামকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে গেছে।
 
৪. সরবরাহ চেইনের অসামঞ্জস্য: উৎপাদন থাকলেও বাজারে পণ্য ঠিকমতো পৌঁছায় না।
 
৫. আমদানিনির্ভরতা: বিশেষ করে পেঁয়াজের ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে আমদানি হওয়ার কারণে দাম বেড়ে গেছে।
 
৬. বাজার তদারকির দুর্বলতা: কার্যকর তদারকি না থাকায় দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
 
৭. সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সীমাবদ্ধতা: ফসল দ্রুত বিক্রি করতে না পারায় ক্ষতি বৃদ্ধি পায়, যা দাম বৃদ্ধির কারণ।
 
৮. আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব: বিশ্ববাজারে পেঁয়াজ ও তেলের দাম বাড়ার প্রভাব সরাসরি অভ্যন্তরীণ বাজারে পড়ছে।
 
স্বাস্থ্যগত প্রভাব
 
উচ্চমূল্য এবং খাদ্য বৈচিত্র্য হ্রাস স্বাস্থ্য সমস্যাকে প্রকট করেছে। পুষ্টিকর সবজি কম খাওয়ার কারণে ভিটামিন ও খনিজের অভাব দেখা দিচ্ছে। শিশুদের বৃদ্ধির হার কমতে পারে, বৃদ্ধদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হতে পারে। খাদ্যে সীমিত পছন্দের কারণে মনোযোগ কমে যেতে পারে, অ্যানিমিয়া বা হাড়ের সমস্যা বৃদ্ধি পেতে পারে।
 
সামাজিক প্রভাব
 
যে পরিবারগুলো অর্থনৈতিকভাবে কম সক্ষম, তারা বাজারের অতিরিক্ত দাম সামলাতে পারছে না। এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তা সংকট দেখা দিচ্ছে। সামাজিক বৈষম্য আরও প্রকট হচ্ছে। একই এলাকার ধনী ও দরিদ্র পরিবারদের মধ্যে খাদ্য গ্রহণের ব্যবধান বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক সমস্যা তৈরি করতে পারে।
 
কৃষি ও পরিবহন ব্যবস্থার বিশ্লেষণ
 
কৃষি খাতের আধুনিকায়ন কম থাকায় উৎপাদন বৃদ্ধি হয়নি। প্রযুক্তি ও উন্নত বীজ ব্যবহার সীমিত। পরিবহন খরচ বাড়ার কারণে গ্রামের কৃষক থেকে শহরের বাজারে পণ্য পৌঁছানো ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো ও সরাসরি বাজার সংযোগ স্থাপন করলে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
 
আন্তর্জাতিক তুলনামূলক দিক
 
বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার ঘটনা অনেক দেশেই দেখা যায়। তবে উন্নত কৃষি ব্যবস্থার দেশ যেমন থাইল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও ইজরায়েলে কৃষকরা সরাসরি বাজারে পণ্য সরবরাহ করে দাম স্থিতিশীল রাখতে সক্ষম। এ ধরনের কার্যকর সরবরাহ চেইন এবং স্টক ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশেও প্রয়োগ করা সম্ভব।
 
সমাধানের প্রস্তাবনা
 
এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অপরিহার্য:
 
১. সরকারি মজুদ বৃদ্ধি ও দ্রুত সরবরাহ: বাজারে পণ্য সরবরাহ বাড়ালে স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব।
 
২. স্বল্পমূল্যের লজিস্টিক ব্যবস্থা: জ্বালানি ব্যয় কমাতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রয়োজন।
 
৩. কৃষক প্রণোদনা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা: আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত বীজ এবং সার প্রদানের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
 
৪. মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণে কঠোর তদারকি: অতিরিক্ত লাভ নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
 
৫. টিসিবি কার্যক্রম সম্প্রসারণ: দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য পৌঁছে দেওয়া।
 
৬. দীর্ঘমেয়াদি কৃষি পরিকল্পনা: দেশীয় উৎপাদন বাড়ালে বাজারে দামের উত্থান-পতন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
 
৭. জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে খাদ্য ব্যয় নিরীক্ষণ: স্থানীয় পর্যায়ে দাম তদারকি করে বাজার স্থিতিশীল রাখা।
 
৮. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: ভোক্তাদের সচেতন করলে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা কমবে এবং দামের চাপ হ্রাস পাবে।
 
৯. প্রাতিষ্ঠানিক কৃষি সহায়তা: কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান উৎপাদন বৃদ্ধি ও রোগমুক্ত ফসল নিশ্চিত করতে কাজ করতে পারে।
 
১০. খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন: বাজারে পণ্যের ক্ষতি কমিয়ে স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব।
 
১১. বহুবার্ষিক ফসল চক্র উন্নয়ন: ফসলের মৌসুম ভেঙে নতুন চাষের প্রবর্তন করে সরবরাহ বাড়ানো।
 
১২. আন্তর্জাতিক বাজার তথ্য ব্যবহার: বৈদেশিক বাজারের ওঠাপড়ার তথ্য ব্যবহার করে আমদানি ও রপ্তানি পরিকল্পনা করা।
 
পরিশেষে,শীতের শুরুতে বাজারের উচ্চমূল্য সাধারণ মানুষের ঘরে স্বস্তি ফিরতে দিচ্ছে না। পেঁয়াজ ও সবজির ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধি, বাজারে অনিয়ম এবং অপরিকল্পিত সরবরাহ চেইন প্রতিদিনের খাবারের খরচকে জটিল করে তুলেছে। নিত্যপণ্যের দাম শুধু অর্থনীতির সংখ্যা নয়, এটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামের অংশ। পরিবারের বাজেট, রান্নার তালিকা এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হচ্ছে।
 
সচেতন উদ্যোগ, কার্যকর নীতি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা এবং জীবনযাত্রার মান ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। শীতের স্বস্তি ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার, উৎপাদক, ব্যবসায়ী এবং ক্রেতাদের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। খাদ্যের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা প্রতিটি পরিবারের পুষ্টি, স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং সামাজিক সমতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
 
লেখক: জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
 
এলএইস/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ