।। ইফতেখার জামিল।।
মালয়েশিয়ায় বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিকে ‘জঙ্গিবাদের’ অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য কোনো দেশ হলে ‘বানানো’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যেত—মালয়েশিয়ায় এমন আশঙ্কা খুবই কম। মালয়েশিয়ায় ইসলামকে খুবই সম্মানের চোখে দেখা হয়। আপনি পাঞ্জাবি-টুপি পরলে সবখানেই কিছু বাড়তি সুবিধা পাবেন। সবাইকে চেক করলেও পুলিশ আপনাকে ছেড়ে দেবে—সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে অবশ্য আলাদা কথা। কাজেই, ‘জঙ্গিবাদের’ অভিযোগকে সত্য বলে ধরে নেওয়াই ভালো।
আমাদের এখানে সবচেয়ে বড় জটিলতা হলো, আমরা এখনো ‘রেডিকালাইজেশনের’ সংজ্ঞা-বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারিনি। মনে রাখা ভালো, রেডিকালাইজেশনকে’ হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। খারেজিদের বিষয়ে নবীজি অত্যন্ত শক্ত ভাষায় সতর্ক করেছেন, সাহাবায়ে কেরামের ভূমিকাগুলোও কারো অজানা থাকার কথা নয়। সর্বোপরি, আফগান-সিরিয়ার মতো দেশ নিয়েও কি রেডিকালরা খুব একটা সন্তুষ্ট? মোটেই না। সিরিয়ায় গেল সপ্তাহে খ্রিস্টান চার্চে ‘আত্মঘাতী বোমা হামলা’ চালানো হলো, নিহত হলেন পঁচিশজনের মতো। কী পরিমাণ ‘ব্রেইনওয়াশড’ হলে এমন একটা অপরাধমূলক কাজে কেউ নিজেকে উড়িয়ে দিতে পারে?
শুধু মালয়েশিয়াই নয়, বাংলাদেশের ডায়াস্পোরা কমিউনিটিগুলোতে ‘রেডিকালাইজেশনের’ সংকটটা অনেক প্রকট। এর একটা বড় কারণ, প্রবাসীদের একটা বড় অংশ ‘অশিক্ষিত শ্রমিক’। যাদের পক্ষে কমপ্লিকেটেড ইস্যুগুলো ডিল করা একটু কঠিন। প্রবাসী শ্রমিকরা সাধারণত হোস্ট সমাজে মিশতে পারেন না, ফলে তাদের নিজেদের মধ্যে একটা বিচ্ছিন্নতাবোধ কাজ করতে থাকে। তারা একটা কাল্পনিক জগত নির্মাণ করার চেষ্টা করেন—তারা খুব দ্রুত ইউটোপিয়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
এগুলোর সমাধান কী? বাংলাদেশের আলেম/স্কলারদেরকে এসব নিয়ে আরও সিরিয়াসলি ভাবতে হবে। রাষ্ট্র + ইসলামিক স্টাডিজ + মাদরাসার মধ্যে একটা ত্রিমুখী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে: রিলিজিয়াস গভরনেন্স নিশ্চিত করতে হবে—কেন্দ্রীয় ফতোয়া বিভাগ (সবধারার আলেমদের নিয়ে ইফতা কাউন্সিল), বিশেষজ্ঞ বিভাগ (জ্ঞানের প্রতিটা শাখার লোকজন নিয়ে পরামর্শ কমিটি), বিচারবিভাগীয় অডিট (দুইজন আলেম-চারজন বিচারপতি মিলে আইনি বোর্ড) তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশকে ইসলামি স্কলারশিপের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করতে হবে। মালয়েশিয়া-কাতার-কুয়েত-সৌদি আমাদের জন্য খুবই ভালো দৃষ্টান্ত।
একটা নুক্তা বলে লেখাটা শেষ করি—তাবলিগ ও জামাতকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রবাসীদের মধ্যে তাবলিগে যুক্ত হবার প্রবণতা অনেক বেশি। জামাতের সমর্থকও নেহায়েত কম নয়, দলটি প্রবাসীদের থেকে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা উত্তোলন করে। ফলে তাবলিগ-জামাতের দায়িত্বটাও অনেক বেশি। দুঃখজনক বিষয় হলো, এ দুটি অংশই শক্তিশালী ‘বয়ান’ নির্মাণ করতে পারছে না। ফলে প্রবাসীদের একটা অংশ তাবলিগ ও জামাত থেকে রেডিকালে পরিণত হচ্ছে। তাবলিগ/জামাতের আন্তরিকতা নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলব না, তবে ইসলামি স্কলারশিপ যে ডেপথ-কমপ্লেক্সিটি দাবি করে, তাবলিগ/জামাত সেই প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পারছে বলে মনে হয় না।
অবশ্য তাদের ব্যর্থতাটা একটা বৃহত্তর সংকটের রিফ্লেকশন—মাদরাসা-ইসলামিক স্টাডিজ-ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিভেদমূলক সম্পর্কের দায়ও কোনো অংশে ছোট নয়।
লেখক: গবেষক ও অ্যাকটিভিস্ট
এনএইচ/