রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের তিনটি প্রধান ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করেছে: ভিভিআইপি (VVIP - Very Very Important Person), ভিআইপি (VIP - Very Important Person), এবং সিআইপি (CIP - Commercially Important Person)। শব্দগুলোর সঙ্গে কিছুটা পরিচিত থাকলেও আমরা অনেকেই জানি না এই তিন শীর্ষ ক্যাটাগরির ব্যক্তিকে কীভাবে নির্ধারণ করা হয়।
রাষ্ট্রীয় বিবেচনায় কীভাবে তাদের মর্যাদা নির্ধারিত হয় এবং তাদের সুরক্ষায় কী ধরনের প্রটোকল অনুসরণ হয় সে সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। ভিভিআইপি হলেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যাদের পরের ধাপে আছেন ভিআইপিরা। এই দুই ধরনের ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামোর কেন্দ্রীয়তে অবস্থান করে থাকেন।
যেসব ব্যক্তি অবস্থান, দায়িত্ব ও মর্যাদার দিক দিয়ে বিশেষ কোনো গুরুত্ব বহন করেন এবং যাদের নিরাপত্তাহানী হলে দেশ ও জাতি গভীর সংকটে পতিত হয় তাদের ভিভিআইপি এবং ভিআইপি বলা হয়।
কারা পান ভিভিআইপি মর্যাদা?
রাষ্ট্রীয় সম্মান ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্তরের মর্যাদা হলো ভিভিআইপি। বাংলাদেশের প্রটোকল বা ‘অর্ডার অফ প্রিসিডেন্স’ (Order of Precedence) অনুযায়ী, এই ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’র মর্যাদা শুধুমাত্র রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদাধিকারীদের জন্য সংরক্ষিত। এর মাধ্যমে তাদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা এবং সর্বোচ্চ প্রটোকল নিশ্চিত করা হয়।
প্রটোকল অনুযায়ী ভিভিআইপি হিসেবে গণ্য হবেন যারা
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রটোকল অনুযায়ী, ভিভিআইপি ক্যাটেগরিতে নির্দিষ্টভাবে নিম্নলিখিত পদাধিকারীরা অন্তর্ভুক্ত:
১. রাষ্ট্রপতি (President): দেশের সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে তিনি এই প্রটোকলের সর্বোচ্চ স্থানে থাকেন।
২. প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টা: তিনি হলেন সরকারের নির্বাহী প্রধান। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী অথবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এই মর্যাদা ভোগ করেন।
আন্তর্জাতিক ও বিশেষ ক্ষেত্রে ভিভিআইপি মর্যাদা
দেশিয় উচ্চপদাধিকারী ছাড়াও আরও কিছু ক্ষেত্রে ভিভিআইপি মর্যাদা প্রযোজ্য হয়:
বিদেশি রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান: অন্য দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানগণ যখন বাংলাদেশ সফর করেন, তখন তারাও ভিভিআইপি প্রটোকল পেয়ে থাকেন।
বিশেষ প্রজ্ঞাপনে মর্যাদা: তবে সরকার যদি বিশেষ পরিস্থিতিতে মনে করে যে কোনো ব্যক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে প্রজ্ঞাপন জারির (Gazette Notification) মাধ্যমে তাদের ভিভিআইপি মর্যাদা প্রদান করার ক্ষমতা রাষ্ট্র সংরক্ষণ করে।
ভিআইপি কারা?
রাষ্ট্রীয় প্রটোকল অনুযায়ী ভিআইপি মর্যাদা প্রাপ্তদের তালিকায় আছেন রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীরা:
জাতীয় সংসদের স্পিকার
মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ (মন্ত্রীবর্গ)
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিবৃন্দ
জাতীয় সংসদের সদস্যবৃন্দ (সংসদ সদস্য বা এমপি)
সিনিয়র সচিব ও সচিববৃন্দ
তিন বাহিনী প্রধান (সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী)
পুলিশের প্রধান (আইজিপি)
এছাড়া, সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তিকে ভিআইপি মর্যাদা দিতে পারে।
ভিআইপিদের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ পুলিশের দুটি বিশেষ বিভাগ থেকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়: একটি হলো পুলিশের প্রটেকশন টিম এবং আরেকটি স্পেশাল ব্রাঞ্চ। এছাড়া বিদেশি দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছে চ্যান্সারি পুলিশ।
তবে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর জন্য আলাদা বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও গার্ড রেজিমেন্ট রয়েছে।
রাষ্ট্রপতি: প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট (পিজিআর), যা তার সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে।
প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টা ও ভিভিআইপি: স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ)। এর পাশাপাশি পুলিশের সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়নও এই নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং পুলিশ ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা এসএসএফের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে।
সড়ক প্রটোকল: ভিআইপি বনাম ভিভিআইপি-
বাংলাদেশে ভিআইপি (VIP) এবং ভিভিআইপি (VVIP) ব্যক্তিদের চলাচলের ক্ষেত্রে ট্রাফিক প্রটোকল নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা ধারণা থাকলেও, সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী ভিআইপিদের জন্য সড়কে কোনো বিশেষ অগ্রাধিকার নেই। এই প্রটোকলের উদ্দেশ্য হলো নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তবে সাধারণ জনগণের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা নয়।
ভিআইপিদের জন্য সড়ক বন্ধ করা নিষিদ্ধ
বাংলাদেশের কোনো সড়কেই কোনো ভিআইপির জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থাপনা থাকার কথা নয়। বিধি অনুযায়ী, তাদের জন্য নিরাপত্তা প্রটোকল থাকবে, কিন্তু তাদের চলাচলের জন্য কোনো সড়ক বন্ধ বা অন্য কোনো যানবাহনের চলাচল বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। তারা কোনো অগ্রাধিকারও পাবেন না। উল্টো পথে চলা বা অন্য গাড়ি সরিয়ে চলাচলের কোনো সুযোগ নেই কোনো ভিআইপির।
ভিভিআইপিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দুই পদাধিকারী—অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টা—এর ক্ষেত্রে সড়কে সীমিত বিশেষ ব্যবস্থাপনার বিধান রাখা হয়েছে। এরা ভিভিআইপি হিসেবে বিবেচিত।
ভিভিআইপিদের চলাচলের সময় সড়কের একপাশ ফাঁকা করে চলাচলের বিধান রয়েছে। ভিভিআইপিদের যাতায়াতের নির্দিষ্ট সড়কটির এক পাশ ফাঁকা করে দেওয়া হয় এবং সেখানে সাধারণ যানচলাচল বন্ধ থাকে। তাদের চলাচলের ১৫ মিনিট আগে এ সম্পর্কিত তথ্য এসএসএফ এবং ট্রাফিক বিভাগের মধ্যে আদান-প্রদান করা হয়, যা তাদের দ্রুত ও নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করে।
ভিআইপিরা তাদের নিরাপত্তার জন্য গানম্যান ও বডিগার্ড পেয়ে থাকেন, যা মূলত থ্রেট অ্যাসেসমেন্টের (হুমকি বা ঝুঁকি বিবেচনায়) ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়। নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অন্য কোনো ব্যক্তির জন্যও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারে।
এসএসএফের ক্ষমতা ও দায়িত্ব: আইনের বিধান
বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (এসএসএফ) আইনের বিধান অনুযায়ী ভিভিআইপিদের সুরক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে বাহিনীর ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট ও কঠোরভাবে সংজ্ঞায়িত। এসএসএফ আইনের ক্ষমতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে:
১. দৈহিক নিরাপত্তা: রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী (বা প্রধান উপদেষ্টা) যেখানেই অবস্থান করুন না কেন, তাদের দৈহিক নিরাপত্তা প্রদান করাই বাহিনীর প্রধান দায়িত্ব।
২. বিদেশি ভিভিআইপি: বাহিনী বাংলাদেশে অবস্থানরত অতি গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি ব্যক্তিকেও দৈহিক নিরাপত্তা প্রদান করবে।
৩. গোয়েন্দা তথ্য: তাদের নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটাতে পারে এমন গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, আদান-প্রদান এবং প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা এসএসএফের কাজ।
৪. গ্রেফতার ও বলপ্রয়োগের বিশেষ ক্ষমতা: আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান অনুযায়ী, যদি এসএসএফের কোনো কর্মকর্তার বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে, ভিভিআইপি অবস্থান করছেন বা অতিক্রম করছেন এমন স্থানে কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি তাদের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর, তাহলে উক্ত কর্মকর্তা বিনা গ্রেফতারি পরোয়ানায় সেই ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করতে পারবেন। এ ক্ষমতা দেশের সকল প্রান্তে প্রযোজ্য।
শুধু তাই নয়, যদি ওই ব্যক্তি গ্রেফতার প্রচেষ্টায় বলপ্রয়োগক্রমে বাধা দেন বা এড়ানোর চেষ্টা করেন, তাহলে কর্মকর্তা গ্রেফতার কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল উপায় অবলম্বন করতে পারবেন এবং প্রয়োজনে, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ হুঁশিয়ারি প্রদানের পর তার ওপর গুলি বর্ষণ বা এমন বলপ্রয়োগও করতে পারবেন, যাতে তার মৃত্যু হয়।
এই আইনি বিধান ভিভিআইপিদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এসএসএফকে একচ্ছত্র ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য।
এলএইস/