শায়খ ড. মাহের বিন হামদ আল মুআইকিলি
(২০-০৩-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ১২-০৯-২০২৫ ঈসায়ি তারিখে বাইতুল্লাহ শরীফে প্রদত্ত জুমার খুতবা)
আমি নিজেকে ও আপনাদেরকে তাকওয়া অবলম্বন করার উপদেশ দিচ্ছি। যে আল্লাহকে ভয় করে, তার চিন্তা-ভাবনা হয় আখিরাত। আর যে আখিরাতকে অগ্রাধিকার দেয়, আল্লাহ তার অন্তরে তুষ্টি দেন, তার বিচ্ছিন্ন অবস্থা একত্র করেন এবং দুনিয়া নিজে থেকেই তার কাছে চলে আসে। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَنۡ یَّتَّقِ اللّٰہَ یَجۡعَلۡ لَّہٗ مَخۡرَجًا ۙ وَّیَرۡزُقۡہُ مِنۡ حَیۡثُ لَا یَحۡتَسِبُ
অর্থাৎ, 'যে কেউ আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার পথ করে দেবেন ও তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে রিযিক দান করবেন।' (সূরা তালাক, আয়াত: ২-৩)
ইমাম বুখারি রহ. তাঁর সহীহ গ্রন্থে হযরত কাব ইবনে মালিক রা.-এর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি তাবুক যুদ্ধ থেকে বিরত ছিলেন। তিনি বলেন, 'যখন শুনলাম, নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধ শেষে ফিরে আসছেন, তখন আমার মন দুঃশ্চিন্তায় ভরে গেল। আমি মিথ্যা কোনো অজুহাত দেওয়ার কথা ভেবে দেখছিলাম কীভাবে তাঁর রোষ থেকে বাঁচব? এ ব্যাপারে আমি পরিবারের জ্ঞানীদের সঙ্গেও পরামর্শ করেছিলাম। কিন্তু যখন খবর এলো যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় এসে গেছেন, তখন আমার মন থেকে মিথ্যার চিন্তা চলে গেল। বুঝলাম, মিথ্যার মাধ্যমে আমি কখনোই রক্ষা পেতে পারব না। তাই আমি সত্য বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ভ্রমণ শেষে ফিরে আসতেন, তখন প্রথমে মসজিদে গিয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন, তারপর মানুষের সঙ্গে বসতেন। আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গেলাম। সালাম দিলে তিনি হালকা হেসে উঠলেন, যেমন রাগের সময় হাসেন। তারপর বললেন, ‘এসো’। আমি গিয়ে তাঁর সামনে বসলাম। তিনি বললেন, ‘তোমাকে যুদ্ধে যাওয়া থেকে কী নিবৃত্ত রেখেছিল? তুমি কি বাহন প্রস্তুত কর নি?’ আমি বললাম, ‘জি, হে আল্লাহর রাসূল, বাহন তো ছিল। কিন্তু আল্লাহর কসম! আমি যদি দুনিয়ার অন্য কারো কাছে যেতাম, তবে মিথ্যা বলে হয়ত তাকে খুশি করতে পারতাম। আমি যুক্তি দেখাতে পারি, কিন্তু আপনার কাছে মিথ্যা বলে বাঁচতে চাই না। কারণ যদি আজ আমি মিথ্যা বলি, আপনি হয়ত খুশি হবেন, কিন্তু আল্লাহ আমাকে শিগগিরই ধরবেন। আর যদি সত্য বলি, আপনি রাগ করবেন, কিন্তু আমি আল্লাহর ক্ষমা আশা করব। হে আল্লাহর রাসূল! আমার কোনো অজুহাত নেই। আমি কখনোই এত শক্তিশালী ও সক্ষম ছিলাম না, যতটা তখন ছিলাম যখন আপনার সঙ্গে যাইনি।’ নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এ লোকটি সত্য বলেছে। যাও, আল্লাহ তোমার ব্যাপারে যা ঠিক করেছেন তা-ই হবে।’ পরে আল্লাহ তাআলা হযরত কাব ইবনে মালিক রা. ও তাঁর দুই সাথীর তওবা কবুল করলেন।
হযরত কাব রা. মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এলেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুশি হয়ে বললেন, 'তোমার জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত এটাই তোমার জীবনের সবচেয়ে উত্তম দিন।'
হযরত কাব রা. বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! এ কি আপনার পক্ষ থেকে, নাকি আল্লাহর পক্ষ থেকে?'
তিনি বললেন, 'না, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকেই।' যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুশি হতেন, তাঁর চেহারা চাঁদের মতো উজ্জ্বল হয়ে যেত, আমরা তা চিনে নিতে পারতাম। হযরত কাব রা. আরও বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ আমাকে সত্য বলার মাধ্যমেই রক্ষা করেছেন। তাই আমি প্রতিজ্ঞা করছি, যতদিন বেঁচে থাকব কখনো মিথ্যা বলব না।'
তিনি আরও বলেন, 'আল্লাহর কসম! যেদিন থেকে আমি এ প্রতিজ্ঞা করেছি, এরপর থেকে আর কোনোদিন ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বলিনি। আমি আশা করি, আল্লাহ আমায় শেষ পর্যন্ত সত্যবাদিতায় অটল রাখবেন।'
এরপর মহান আল্লাহ এই আয়াত নাজিল করলেন, لَقَدۡ تَّابَ اللّٰہُ عَلَی النَّبِیِّ وَالۡمُہٰجِرِیۡنَ وَالۡاَنۡصَارِ الَّذِیۡنَ اتَّبَعُوۡہُ فِیۡ سَاعَۃِ الۡعُسۡرَۃِ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا کَادَ یَزِیۡغُ قُلُوۡبُ فَرِیۡقٍ مِّنۡہُمۡ ثُمَّ تَابَ عَلَیۡہِمۡ ؕ اِنَّہٗ بِہِمۡ رَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ ۙ
অর্থাৎ, 'আল্লাহ অবশ্যই অনুগ্রহপরায়ণ হলেন নবীর প্রতি এবং মুহাজির ও আনসারদের প্রতি যারা তার অনুসরণ করেছিল সংকটকালে-এমনকি যখন তাদের একদলের চিত্ত-বৈকল্যের উপক্রম হয়েছিল। পরে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করলেন; তিনি তো তাদের প্রতি দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।' (সূরা তওবা, আয়াত: ১১৭)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰہَ وَکُوۡنُوۡا مَعَ الصّٰدِقِیۡنَ
অর্থাৎ, 'হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর ও সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও।' (সূরা তওবা, আয়াত: ১১৯)
হযরত কাব রা. বললেন, 'ইসলাম পাওয়ার পর আমার কাছে সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ হলো, আমি নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে সত্য বলেছি। যদি মিথ্যা বলতাম, তাহলে অন্যদের মতো ধ্বংস হয়ে যেতাম।'
আল্লাহ তাআলা কাব ইবনে মালিক রা., তাঁর সাথী ও সাহাবায়ে কেরামের প্রতি সন্তুষ্ট হোন। মহান আল্লাহ আমাদেরও তাঁদের সঙ্গে জান্নাতে একত্র করুন, ‘বাগান ও নদীর মধ্যে, সত্যের আসনে, সর্বশক্তিমান বাদশাহর সান্নিধ্যে।’ (সূরা কামার, আয়াত: ৫৪-৫৫)
সত্যবাদিতা হলো একজন মুমিনের সবসময়কার পরিচয়চিহ্ন। কথা, কাজ ও ব্যবহারে একজন মুমিন সত্যের ওপর অটল থাকে। ধীরে ধীরে সত্য তার স্বভাব হয়ে যায়, এমনকি কখনোই তা থেকে বিচ্যুত হয় না। সে কোনো কথা অযথা বলে না, মিথ্যা ধারণার ওপর ভিত্তি করে কোনো রায় দেয় না। বরং সত্যকে খোঁজে, চেষ্টা করে সত্যের জন্য, যতক্ষণ না আল্লাহ তার নাম 'চরম সত্যবাদী' হিসেবে লিপিবদ্ধ করেন। এটি এমন এক উচ্চ মর্যাদা, যা নবুয়ত ও শাহাদতের মধ্যে স্থান পেয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, وَمَنۡ یُّطِعِ اللّٰہَ وَالرَّسُوۡلَ فَاُولٰٓئِکَ مَعَ الَّذِیۡنَ اَنۡعَمَ اللّٰہُ عَلَیۡہِمۡ مِّنَ النَّبِیّٖنَ وَالصِّدِّیۡقِیۡنَ وَالشُّہَدَآءِ وَالصّٰلِحِیۡنَ ۚ وَحَسُنَ اُولٰٓئِکَ رَفِیۡقًا ؕ
অর্থাৎ, 'আর কেউ আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করলে সে নবী, সত্যনিষ্ঠ, শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণ-যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন-তাদের সঙ্গী হবে। আর তারা কত উত্তম সঙ্গী!' (সূরা নিসা, আয়াত: ৬৯)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সত্যকে ধারণ করা তোমাদের একান্ত কর্তব্য। কেননা সততা নেক কর্মের দিকে পথপ্রদর্শন করে। আর নেককর্ম জান্নাতের পথপ্রদর্শন করে। কোন ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বললে ও সত্য বলার চেষ্টায় রত থাকলে, অবশেষে আল্লাহর নিকট সে সত্যবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়। আর তোমরা মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকো! কেননা মিথ্যা পাপের দিকে পথপ্রদর্শন করে। আর পাপ নিশ্চিত জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করে। কোন ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা বললে ও মিথ্যার উপর অবিচল থাকার চেষ্টা করলে, অবশেষে সে আল্লাহর নিকট মিথ্যাবাদীরূপে লিপিবদ্ধ হয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৬৫৩৩) অতএব ধন্য সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর সঙ্গে সত্যবাদী থাকে, আল্লাহও তাকে সম্মানিত করেন। অনুরূপভাবে ধন্য সেই ব্যক্তি, যে মানুষের সঙ্গে সত্যবাদী থাকে, ফলে আল্লাহ তাকে মর্যাদা দেন। ধন্য সেই ব্যক্তি, যে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সত্যবাদীদের পথে অটল থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ رِجَالٌ صَدَقُوۡا مَا عَاہَدُوا اللّٰہَ عَلَیۡہِ ۚ فَمِنۡہُمۡ مَّنۡ قَضٰی نَحۡبَہٗ وَمِنۡہُمۡ مَّنۡ یَّنۡتَظِرُ ۫ۖ وَمَا بَدَّلُوۡا تَبۡدِیۡلًا ۙ
অর্থাৎ, 'মুমিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সঙ্গে তাদের কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে, এদের কেউ কেউ শাহাদত বরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে। এরা তাদের অঙ্গীকারে কোন পরিবর্তন করে নাই।' (সূরা আহযাব, আয়াত: ২৩)
সত্য একটি মহৎ গুণ। আল্লাহ তাআলা নিজেকে সত্যবাদী হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, وَمَنۡ اَصۡدَقُ مِنَ اللّٰہِ قِیۡلًا
অর্থাৎ, 'আল্লাহ অপেক্ষা কথায় কে অধিক সত্যবাদী?' (সূরা নিসা, আয়াত: ১২২) রাসূলদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণও হলো সত্যবাদিতা। আল কুরআনে এসেছে, وَاذۡکُرۡ فِی الۡکِتٰبِ اِبۡرٰہِیۡمَ ۬ؕ اِنَّہٗ کَانَ صِدِّیۡقًا نَّبِیًّا
অর্থাৎ, 'স্মরণ কর, এই কিতাবে উল্লিখিত ইবরাহিমের কথা; সে ছিল সত্যনিষ্ঠ, নবী।' (সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৪১) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, وَاذۡکُرۡ فِی الۡکِتٰبِ اِسۡمٰعِیۡلَ ۫ اِنَّہٗ کَانَ صَادِقَ الۡوَعۡدِ وَکَانَ رَسُوۡلًا نَّبِیًّا ۚ
অর্থাৎ, 'স্মরণ কর, এই কিতাবে ইসমাঈলের কথা, সে তো ছিল প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী। আর সে ছিল রাসূল, নবী।' (সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৫৪)
আর আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো 'সৎ ও আমানতদার' হিসেবে খ্যাত ছিলেন নবুয়ত পাওয়ার আগেই। তিনি সত্যের সঙ্গে এসেছেন, সত্যের কথাই বলেছেন, সত্যের আদেশ দিয়েছেন। তিনি সবচেয়ে সত্য প্রতিশ্রুতিদাতা, সবচেয়ে সত্য চুক্তি রক্ষাকারী। আল্লাহ তাঁকে বাহ্য ও অন্তরে সত্যের সৌন্দর্যে শোভিত করেছেন এবং তাঁকে দোয়া করতে শিখিয়েছেন যে, وَقُلۡ رَّبِّ اَدۡخِلۡنِیۡ مُدۡخَلَ صِدۡقٍ وَّاَخۡرِجۡنِیۡ مُخۡرَجَ صِدۡقٍ وَّاجۡعَلۡ لِّیۡ مِنۡ لَّدُنۡکَ سُلۡطٰنًا نَّصِیۡرًا
অর্থাৎ, 'বল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে প্রবেশ করাও কল্যাণের সঙ্গে ও আমাকে নিষ্ক্রান্ত করাও কল্যাণের সঙ্গে। আর তোমার নিকট হতে আমাকে দান কর সাহায্যকারী শক্তি।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৮০) মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শরিয়ত সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁর সাহাবীরা সত্যবাদী। মহান আল্লাহ বলেন, وَالَّذِیۡ جَآءَ بِالصِّدۡقِ وَصَدَّقَ بِہٖۤ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُتَّقُوۡنَ
অর্থাৎ, 'যারা সত্য এনেছে ও যারা সত্যকে সত্য বলে মেনেছে তারাই মুত্তাকী।' (সূরা যুমার, আয়াত: ৩৩)
সত্য হচ্ছে নিয়ত, কথা, কাজ ও অবস্থার ভিত্তি। এটি মনকে শান্তি দেয়, দুশ্চিন্তা দূর করে ও দোয়া কবুলের পথ খুলে দেয়। সত্যবাদী সম্মানিত হয়, আর মিথ্যাবাদী লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়। এ কারণেই বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিথ্যাকে ঘৃণা করতেন; এমনকি ছোট বিষয়ে শিশুর সঙ্গেও। তিনি শিশুদেরকেও সত্যের অভ্যাস করাতেন, মিথ্যা থেকে দূরে রাখতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমের রা. ছোট্ট শিশু ছিলেন। একদিন তাঁর মা তাঁকে ডাকলেন, আর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের ঘরে বসেছিলেন। মা বললেন, 'এদিকে আসো, আমি তোমাকে কিছু দেব।' নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, 'তুমি তাকে কী দিতে চেয়েছিলে?' মা বললেন, 'একটা খেজুর।' বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, أما إنك لو لم تعطيه شيئا كتبت عليك كذبة
অর্থাৎ, 'যদি তুমি তাকে কিছুই না দিতে, তবে তোমার নামে একটি মিথ্যা লেখা হতো।' (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪৯৯১) অতএব, হে আল্লাহর বান্দারা, মিথ্যাকে কোনো ব্যাপারেই হালকাভাবে নেবেন না। কারণ একবার মিথ্যার দরজা খোলা হলে তা বন্ধ করা কঠিন হয়ে যায়।
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিথ্যা থেকে সতর্ক করেছেন, এমনকি যদি তা মজা করার জন্যও হয়। তিনি নিজে পরিবার ও সাহাবীদের সঙ্গে রসিকতা করতেন, কিন্তু কখনো সত্য ছাড়া কিছু বলতেন না। ইমাম আহমাদের মুসনাদে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ويلٌ للذي يُحدِّثُ فيكذِبُ ليُضحِكَ به القومَ، ويلٌ له، ويلٌ لهم
অর্থাৎ, ধ্বংস তাদের জন্য, যারা মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে। ধ্বংস তার জন্য, ধ্বংস তাদের জন্য।
যত বড় বিষয়ে মিথ্যা বলা হয়, তার ক্ষতি ও শাস্তিও তত বড় হয়। বিশেষ করে আজকের যুগে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে দ্রুত খবর ছড়িয়ে যায়। অভিযোগ, গুজব বা অপবাদ এক মুহূর্তেই পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়ে, যা সমাজ ও নিরাপত্তার জন্য ভয়ংকর ক্ষতি ডেকে আনে। তাই বুদ্ধিমান মানুষ যেন কখনো শত্রুর হাতিয়ার না হয় এবং সমাজ ও দেশকে ক্ষতির মুখে না ঠেলে দেয়। আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, كفى بالمرء إثما أن يحدث بكل ما سمع
অর্থাৎ, 'কোনো মানুষ যা শুনে, সব যদি বলে বেড়ায় এটিই তার মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।' (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪৯৯২)
অতএব, ভেবে দেখুন, যারা নিজেরাই গুজব বানায় ও মিথ্যা ছড়ায়, তাদের অবস্থা কত ভয়াবহ হবে! আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি স্বপ্নের বর্ণনায় এসেছে, وأما الرجل الذي أتيت عليه يشرشر شدقه إلى قفاه ومنخره إلى قفاه وعينه إلى قفاه فإنه الرجل يغدو من بيته فيكذب الكذبة تبلغ الآفاق
অর্থাৎ, 'আমি দেখলাম এক ব্যক্তিকে, যার মুখের এক পাশ কান পর্যন্ত, নাক কান পর্যন্ত, আর চোখ কান পর্যন্ত ছিঁড়ে দেওয়া হচ্ছে। তিনি হলেন, সেই ব্যক্তি, যে নিজের ঘর থেকে বের হয়ে মিথ্যা বানায়, আর তা দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।' (সহীহ বুখারী, হাদিস: ৭০৪৭)
মিথ্যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নামে মিথ্যা বলা। মহান আল্লাহ বলেন, وَیَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ تَرَی الَّذِیۡنَ کَذَبُوۡا عَلَی اللّٰہِ وُجُوۡہُہُمۡ مُّسۡوَدَّۃٌ ؕ اَلَیۡسَ فِیۡ جَہَنَّمَ مَثۡوًی لِّلۡمُتَکَبِّرِیۡنَ
অর্থাৎ, 'যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, তুমি কিয়ামতের দিন তাদের মুখ কালো দেখবে। উদ্ধতদের আবাসস্থল কি জাহান্নাম নয়?' (সূরা যুমার, আয়াত: ৬০) বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, من تعمد على كذبا فليتبوأ مقعده من النار
অর্থাৎ, 'যে ইচ্ছাকৃতভাবে আমার নামে মিথ্যা বানাবে, সে যেন জাহান্নামে নিজের আসন প্রস্তুত করে নেয়।' (সহীহ বুখারি, হাদীস: ১০৮)
সুতরাং হে আল্লাহর বান্দারা, তোমরা সত্যকে আঁকড়ে ধরো, সত্যকে তোমাদের পোশাক ও অলংকার বানাও এবং গোপনে ও প্রকাশ্যে সত্যকে মেনে চলো। আল্লাহ তোমাদের অন্তরে তাকওয়া দান করবেন, জীবনের পথে দিশা দেবেন। মনে রেখো, সত্য ও আন্তরিকতা একসঙ্গে থাকে। কিয়ামতের দিন কেবল সত্যবাদীরাই রক্ষা পাবে।আল্লাহ তাআলা বলেন,
قَالَ اللّٰہُ ہٰذَا یَوۡمُ یَنۡفَعُ الصّٰدِقِیۡنَ صِدۡقُہُمۡ ؕ لَہُمۡ جَنّٰتٌ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَاۤ اَبَدًا ؕ رَضِیَ اللّٰہُ عَنۡہُمۡ وَرَضُوۡا عَنۡہُ ؕ ذٰلِکَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ
অর্থাৎ, 'আল্লাহ বলবেন, ‘এই সে দিন যেদিন সত্যবাদীগণ তাদের সত্যতার জন্যে উপকৃত হবে, তাদের জন্যে আছে জান্নাত যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে; আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন আর তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট; এটা মহাসফলতা।’ (সূরা মায়েদা, আয়াত: ১১৯)
অনুবাদ: আবদুল কাইয়ুম শেখ
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, পোস্তা, চকবাজার, ঢাকা-১২১১
এমএইচ/