মুহাম্মদ মিজানুর রহমান
দিনের পর দিন আমাদের অর্থনৈতিক লেনদেনের একটি সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো—ভাংতি বা খুচরা অর্থের ঘাটতি। ছোট ছোট এই লেনদেনেই অনেক সময় অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু ইসলাম এই খুচরা লেনদেন বা ভাংতি প্রদানের মতো সূক্ষ্ম আচরণ সম্পর্কেও দিকনির্দেশনা দিয়েছে। শুধু লেনদেনের ক্ষেত্রে নয় লেনদেনের বাইরেও যে কোনো সময় যে কারো ভাংতির প্রয়োজন হতে পারে। এই ভাংতি দেয়াটাও ইবাদতের অংশ। ইসলাম শুধু বড় বড় ইবাদত নয়, বরং প্রতিদিনের জীবনযাপনের প্রতিটি খুঁটিনাটিতেও ন্যায়, সততা ও সদাচরণের গুরুত্ব আরোপ করে।
ভাংতি না দেওয়া একটি অন্যায়ের শামিল হতে পারে
বর্তমানে অনেক দোকানে বা পরিবহনে দেখা যায়, বিক্রেতা ভাংতি না দিয়ে "ভাংতি নেই" বলে দায় এড়ান। এটি কখনো কখনো ইচ্ছাকৃত হয়ে থাকে, যা ইসলাম অনুযায়ী প্রতারণার অন্তর্ভুক্ত। রাসুল (সা.) বলেন—“যে প্রতারণা করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। (সহিহ মুসলিম)
মানুষ বিপদে পড়েই ভাংতি চায়। আপনার কাছে থাকলে খুচরা টাকা দিয়ে উপকার করাটা মুমিন হিসেবে আপনার নৈতিক ও ইমানি দায়িত্ব। কেউ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা না করলে পরকালে শাস্তি পেতে হবে। তাছাড়া আমরা অনেক সময় খুচরা টাকা থাকা সত্ত্বেও মিথ্যা বলে গুনাহ কামিয়ে নিই।
ইসলাম চায় সদাচরণ ও সহজতা
ইসলামের শিক্ষা হলো মানুষের জন্য সহজতা সৃষ্টি করা। রাসুল (সা.) আরও বলেন—আল্লাহ দয়া করেন সেই বান্দার প্রতি, যে বিক্রয় ও ক্রয়ে, পাওনা ও আদায়ে নম্রতা ও সহজতা প্রদর্শন করে।” (সহিহ বুখারি) রাসুল (সা.) বলেন: "যে ব্যক্তি মানুষকে সহজ করে, আল্লাহ তার জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে সহজ করে দেবেন।"- (মুসলিম)
ভাংতি প্রদান করা ভোক্তার জন্য সহজতা সৃষ্টি করে এবং এটি একটি নেক আমল হিসেবেও বিবেচিত। এখানে “সহজতা”র মধ্যে ভাংতির ব্যবস্থা করাও অন্তর্ভুক্ত। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিত দোকানে বা বাসে ভাংতির ঝামেলা এড়াতে নিজের পক্ষ থেকেও খুচরা রাখা এবং অপরকে তার পাওনা পুরোপুরি দেওয়া। ব্যবসায়ী বা বিক্রেতার দায়িত্ব হলো, যথাযথভাবে লেনদেন করা এবং ক্রেতাকে তার প্রাপ্য প্রদান করা। ভাংতি না দেওয়া বা "ভাংতি নেই" বলে নিজের সুবিধামতো বাকি রেখে দেওয়া ইসলাম সম্মত নয়।
হাজত পূরণও ইবাদতের শামিল
কেউ ভাংতি চাইলে অনেক সময় আমরা ভাংতি থাকা সত্বেও ভাংতি দিতে চাই না। এর একটি কারণ, পরবর্তিতে ভাংতির প্রয়োজন হতে পারে ভেবে খুচরা টাকা হাতছাড়া করতে চাই না। অথচ অন্যকে সাহায্য করার বিষয়ে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এসেছে কতই না সুসংবাদ। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে নবী (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের পার্থিব দুর্ভোগ দূর করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দুর্ভোগগুলোর কোনো একটি দূর করে দেবেন। আর যে কোনো ঋণ পরিশোধে অক্ষম ব্যক্তির (দায়) সহজ করবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার (দায়) সহজ করবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইকে সহযোগিতা করতে থাকে, আল্লাহও তার সাহায্য করতে থাকেন।” রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা বান্দার সাহায্যে ততক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ সে অপর ভাইয়ের সাহায্যে থাকে।-(মুসলিম, হাদিস : ২৩১৪)
হাদিস শরীফে আছে, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের হাজত পূরণের জন্য শুধু নিয়ত করে আল্লাহ তায়ালা তাকে ১০ বছর নফল ইতিকাফের সওয়াব দান করেন।’ রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে অপরের একটি প্রয়োজন মিটিয়ে দেবে, পরকালে আল্লাহ তার ৭৩টি প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন এবং বান্দার দুঃখ-দুর্দশায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে আল্লাহ তার প্রতি করুণার দৃষ্টি দেন।-(মুসলিম, হাদিস : ২৪১৯)
তিরমিযি শরীফে আছে, ‘তোমরা জগদ্বাসীর উপর সদয় হও, তাহলে আসমানের মালিক আল্লাহ তায়ালাও তোমাদের প্রতি সদয় হবেন।’ আরেক হাদিসে আছে,যে ব্যক্তির মনে মানুষের কল্যাণের চিন্তা-ফিকির ও মানসিকতা থাকে না, সে মুসলমানের অন্তর্ভুক্ত নয়।’
কেউ যদি সামান্য ভাংতি চায়, অনেকে সেটা দিতে সংকোচ করেন বা বিরক্তি দেখান। অথচ ইসলাম বলে—“তুমি কোনো ভালো কাজকে তুচ্ছ মনে করো না— যদি তা হয় তোমার ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা’ (সহিহ মুসলিম)। তাহলে সামান্য ভাংতি দেওয়া তো আরও বড় সদাচরণ।
ভাংতি দেওয়া শুধু লেনদেন নয়, বরং তা হতে পারে সহানুভূতির প্রকাশ, ইসলামী ভ্রাতৃত্বের চর্চা ও একটি ছোট নেক কাজ। ইসলাম এ ধরনের সহযোগিতাকে উৎসাহিত করে এবং এটিকে ইবাদতের অংশ মনে করে। সততা, সদাচরণ ও ন্যায্যতার ছোট ছোট এই চর্চাগুলোই সমাজে শান্তি, আস্থা ও ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে।
এনএইচ/