হজ ও ওমরাহ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হজ ফরজ এবং ওমরাহ সুন্নত হলেও উভয়ই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর জন্য হজ ও ওমরাহ সম্পন্ন করো।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৯৬)
তবে অজ্ঞতা বা ভুল ধারণার কারণে অনেক হাজি হজ-ওমরাহর সময় এমন কিছু ভুল করে ফেলেন, যা তাঁদের ইবাদতের পূর্ণতা বা গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করতে পারে।
এই প্রবন্ধে আমরা কিছু ভুল নিয়ে আলোচনা করব।
১. প্রস্তুতির অভাব
অনেক হাজি হজ বা ওমরাহর নিয়ম-কানুন সম্পর্কে জানার আগেই যাত্রা শুরু করেন। ফলে তাঁরা ইহরামের নিয়ম, হজের ফরজ-ওয়াজিব, এবং ওমরাহর সুন্নত সম্পর্কে অজ্ঞ থাকেন। এ জন্য হজে যাওয়ার আগে স্থানীয় আলেম বা হজ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে নিয়ম শিখে নিন।
২. কাতার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দাঁড়ানো
মসজিদে হারাম বা তার চত্বরের সীমানার মধ্যে যদি দুই কাতারের সমান বা তার চেয়েও বেশি দূরত্ব থাকে, তবু ইমামের মুকতাদি হওয়া সঠিক হবে। তবে কোনো ওজর ছাড়া এতটা দূরত্ব রেখে নামাজ পড়া মাকরুহ। কিন্তু মসজিদের বাইরের রাস্তার অংশে, নামাজ সঠিক হওয়ার জন্য কাতারগুলো পরস্পর সংযুক্ত হওয়া জরুরি। কাতারগুলো সংযুক্ত না হলে ইমামের ইকতিদা করে নামাজ সহিহ হবে না।
তবে হারামের বাকি তিন পাশে যাঁরা মাতাফে কাতার করে দাঁড়ান, তাঁরা ইমামের চেয়ে সামনে নয়, বরং পাশে বা পেছনে বলে ধরা হয়, তাই তাঁদের নামাজ হবে।
উপরোক্ত ব্যাখ্যার ভিত্তিতে, যাঁরা মসজিদে নববীতে ইমামের চেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েন, তাঁদের নামাজ সহিহ হবে না। তাঁদের উচিত ইমামের পেছনে কাতার করা। কখনো ইমামের সামনে কাতার করা যাবে না। মদিনায় প্রচুর মানুষকে দেখা যায় ইমামের সামনে দাঁড়িয়ে জামাতে শরিক হচ্ছে।
মসজিদে নববীতে ইমাম যেখানে দাঁড়ান তার বরাবর আরবি, ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় লেখা আছে, ‘এই বরাবর ইমাম দাঁড়ায়’ তাই এর সামনে দাঁড়ালে নামাজ সহিহ হবে না।’
(আল-মাবসুত, সারাখসি : ১/৪৩)
৪. জুমার সুন্নত
জুমার নামাজের সময় সেই সময়, যা জোহরের সময়, অর্থাৎ সূর্য হেলে পড়ার (জাওয়াল) পর শুরু হয়। সুতরাং, জাওয়ালের আগেই জুমার আজান দেওয়া হানাফি মাজহাব অনুযায়ী সঠিক নয়। তবে যদি এমনটি হয়, তবু জুমার নামাজ আদায় হয়ে যাবে।
এ ছাড়া এই আগেভাগে দেওয়া আজানের পর যদি কেউ কিছু নফল নামাজ পড়ে, তবে তা কেবল সাধারণ নফল নামাজ হবে। কারণ জুমার ফরজের আগে যে চার রাকাত সুন্নত নামাজ পড়া হয়, সেটি সময় প্রবেশের আগে আদায় করা যায় না; বরং সময় প্রবেশ করার পর। এখন যদি খুতবার আগে চার রাকাত পড়ার মতো সময় না পাওয়া যায়, তাহলে সেই চার রাকাত সুন্নত নামাজ ফরজের পর আদায় করা যাবে। (দুররে মুখতার : ১/৪২১)
৫. আসরের নামাজ
মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীতে নামাজ আদায়ের বিষয়ে হাদিসে বিশেষ ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। তাই হারামাইন শরিফাইনে (মক্কা ও মদিনার দুই পবিত্র মসজিদে) প্রথম ছায়া (মিসল আওয়াল) হয়ে যাওয়ার পরও আসরের নামাজ জামাতে আদায় করার সুযোগ আছে। সুতরাং হানাফি মাজহাবের অনুসারী যদি হারামাইন শরিফাইনে ইমামের পেছনে প্রথম ছায়া (মিসল আওয়াল) হওয়ার পরই আসরের নামাজ আদায় করে, তবে তা সঠিক।
কারণ ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ রহ.-এর মত অনুযায়ী, মিসল আওয়ালের (প্রথম ছায়া) পরও আসরের নামাজ আদায়ের ফতোয়া দিয়েছেন।
তবে সাধারণ স্থান ও পরিস্থিতিতে হানাফি মাজহাবের মূল ফতোয়া হচ্ছে, আসরের নামাজ দ্বিতীয় ছায়া (মিসল সানি) হওয়ার পর আদায় করা উচিত। (আল-বাহরুর রায়েক : ১/২৫৭)
৬. স্মরণীয় মুহূর্তে অহেতুক সেলফি
অনেকেই এই বরকতপূর্ণ জায়গাকে স্মরণীয় রাখতে কাবার সামনে ও রওজা শরিফ জিয়ারতে ছবি উঠিয়ে থাকেন। হজ বা ওমরাহর সময় অহেতুক ছবি তোলা ইবাদতের রুহানিয়াত নষ্ট করে। তাই এসব পরিহার করা কর্তব্য। এসব স্থান মোবাইলে ধারণ নয়, বরং হূদয়ে ধারণ করতে হয়। এসব ছবি আর সেলফির কারণে মূল ইবাদতের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে হয় আমাদের। এ জন্য এসব থেকে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক থাকব।
৭. তাওয়াফের সময় উঁচু আওয়াজে জিকির
তাওয়াফের সময় নির্ধারিত কোনো দোয়া নেই। যেকোনো দোয়া পড়া যাবে। তবে যে দৃশ্যটি সবচেয়ে বিরক্তিকর—কিছু লোক একসঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে উচ্চৈঃস্বরে দোয়া পড়তে থাকেন। অবশ্য এটি তাঁরা ভালো নিয়তে করে থাকেন। অথচ এমনটি করা একদম উচিত নয়। প্রথমে এভাবে উঁচু আওয়াজে দোয়া পড়ার বিষয়টি প্রমাণিত নয়। দ্বিতীয়ত, এর কারণে অন্যদের তাওয়াফে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। এ জন্য প্রত্যেকে নিচু আওয়াজে দোয়া পড়বেন।
৮. তাওয়াফে অজু ভেঙে গেলে
অজু ছাড়া তাওয়াফ করা বৈধ নয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, তাওয়াফ সালাতেরই অনুরূপ, শুধু এ পার্থক্য যে এতে কথা বলা যায়। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৯৬০; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৯২০)
যদি তাওয়াফের সময় অজু ভেঙে যায়, তাহলে সেই জায়গা থেকেই তাওয়াফ থামানো আবশ্যক। তারপর অজু করে সেই স্থান থেকেই তাওয়াফ সম্পন্ন করা যায়। তবে উত্তম হচ্ছে, তাওয়াফ শুরু থেকেই পুনরায় করা।
(হজ ও ওমরাহর মাসায়েলের বিশ্বকোষ)
৯. রিয়াজুল জান্নাতে অহেতুক কাজ
অনেক হাজিকে দেখা যায় রিয়াজুল জান্নাতে গিয়ে সেখানে যে খুঁটিগুলো আছে সেগুলো ধরে চুম্বন করেন। অথচ এটি সুন্নাহসম্মত নয়। নিরাপত্তাকর্মীরা ডাক দিলেও হাজিরা কর্ণপাত করেন না। নিজের সবটুকু আবেগ ঢেলে দিয়ে খুঁটি জড়িয়ে ধরে থাকেন। অথচ শরিয়তের বিধানকে আবেগের ওপর প্রাধান্য দিতে হবে।
আর এখানে ‘সংযুক্ত’ থাকার মানে হলো, কাতারগুলোর মধ্যে দুই কাতারের সমান বা তার বেশি ফাঁকা যেন না থাকে।
তবে যদি ইমাম ও মুকতাদির মধ্যে কোনো দেয়াল বা বাধা থাকে, আর মুকতাদি ইমামের নামাজের অবস্থা পরিবর্তনের (এক রুকন থেকে অন্য রুকনে যাওয়া) সম্পর্কে সঠিকভাবে জানে, তাহলে ওই মুকতাদির নামাজ সহিহ হবে।
(আল-বাহরুর রায়েক : ১/৫৮৫)
৩. ইমামের আগে দাঁড়ানো
ইমামের ইকতিদা বা অনুসরণ সহিহ হওয়ার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ যে মুকতাদি যেন ইমামের সামনে চলে না যান। ইমামের সামনে অবস্থান নিলে মুকতাদির নামাজ সহিহ হবে না।
তাই যদি মসজিদে হারামে ইমাম মাতাফে না দাঁড়িয়ে হারামের ভবনের ভেতরে দাঁড়ান, তাহলে যেসব নামাজি ইমামের দিকের সামনে অর্থাৎ মাতাফে দাঁড়ান, তাঁরা ইমামের চেয়ে সামনে অবস্থানকারী হিসেবে গণ্য হবেন, ফলে তাঁদের নামাজ সহিহ হবে না।
এনএইচ/