বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫ ।। ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ ।। ২ জিলহজ ১৪৪৬


নিহত মাদরাসা শিক্ষককে যেভাবে সন্ত্রাসী তকমা দিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কাশ্মীরের পুঞ্চ শহরের বাসিন্দা মুহাম্মদ ইকবাল সীমান্তবর্তী একটি মাদরাসায় দুই দশকের বেশি সময় শিক্ষকতা করেছেন। ৭ মে সকালে ভারতীয় বাহিনীর গোলাবর্ষণে মাদরাসার ভেতরেই প্রাণ হারান তিনি। তবে মর্মান্তিক এই ঘটনার পর ইকবালের পরিবারকে আরেক ধাক্কা সামলাতে হয়—ভারতের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম তাকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে প্রচার করে।

ইকবালের ভাই ফারুক আহমেদ এখনো ক্ষোভে ফুঁসছেন। তিনি জানান, তার ভাই শুধুই একজন শিক্ষক ছিলেন, কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে তার কোনো যোগ ছিল না। ‘ওর দাড়ি আর টুপি দেখেই গণমাধ্যম তাকে সন্ত্রাসী বানিয়ে দিল,’—বেদনাভরা কণ্ঠে বলেন ফারুক।

ইকবালের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল তাকে সন্ত্রাসবাদী বলে মিথ্যা অভিযোগ করতে শুরু করে। তবে স্থানীয় পুলিশ একটি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, ওই অভিযোগ অসত্য।

‘কাটা ঘায়ে লবণের ছিটা’

ফারুক বলেন, ‘আমার ভাই একজন শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু তারা তার দাড়ি ও মাথার টুপি দেখেই তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে। এটা যেন আমাদের কাটা ঘায়ে লবণের ছিটা দেওয়া। আমরা ইকবালকে হারিয়েছি আর তার পরই গণমাধ্যম তাকে অসম্মান করল। মৃত মানুষ তো আর নিজের হয়ে কিছু বলতে পারে না!’

ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চার দিন ধরে চলতে থাকা সামরিক সংঘাতের সময়ে পাল্টাপাল্টি গোলাবর্ষণে ইকবালসহ মোট ১৬ জন নিহত হয়েছে।

অন্যদিকে পাকিস্তান ৪০ জন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছে। তবে এর মধ্যে কতজন সরাসরি গোলাবর্ষণের কারণে মারা গেছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

একদিকে যখন সামরিক সংঘাত বাড়ছিল, অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরেকটি লড়াই শুরু হয়—অনলাইন ও টেলিভিশনে ভুয়া খবর ছড়ানোর লড়াই। ইকবালের পরিচয় নিয়ে যেমন গুজব ছড়ানো হয়েছিল, তেমনই টিভি, সংবাদ পোর্টালসহ মূলধারার গণমাধ্যমে আরো নানা বিভ্রান্তিকর ও ভুল তথ্য ছড়িয়েছিল।

এসব ভুয়া তথ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল, পাকিস্তানের করারি বন্দর ধ্বংস করে দিয়েছে ভারত।

যদিও পরে ভারত সরকার নিজেরাই এই তথ্য ভুয়া বলে জানিয়েছিল। কিছু কিছু ভুয়া খবর আবার চিহ্নিত করাও কঠিন ছিল, যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বানানো একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল, যেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন জেনারেলের মুখে এ রকম কথা বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে তার দেশের দুটি যুদ্ধবিমান সংঘর্ষে ধ্বংস হয়েছে।

মাত্রা ছাড়া ভুয়া খবর

ভারতের একটি স্বাধীন সংবাদ পোর্টাল নিউজ লন্ড্রির ম্যানেজিং এডিটর মনীষা পাণ্ডে বলেন, ‘যে মাত্রায় ভুয়া তথ্য ও যাচাই না করা তথ্য প্রচার করা হয়েছে গণমাধ্যমে, তা দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়।’

তিনি অবশ্য মেনে নিয়েছেন, চ্যানেলগুলো দর্শক টানার প্রতিযোগিতায় কিছুটা যে আবেগ উসকিয়ে দেওয়ার মতো খবর করবে, এটা প্রত্যাশিত, তবে যে ‘উগ্র দেশপ্রেম ও দায়িত্বজ্ঞানহীন’ভাবে ওই সংঘাতের সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে, তার মাত্রা ছিল অভূতপূর্ব, অন্তত তিনি আগে কখনো এ রকমটা দেখেননি।

চ্যানেলগুলোর এই দায়িত্বজ্ঞানহীন সংবাদ প্রচারের ফল ফারুকের থেকে বেশি বোধ হয় আর কাউকে ভোগ করতে হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমি জানি না নিউজ চ্যানেলগুলো কোথা থেকে আমার ভাইয়ের ব্যাপারে খবর পেয়েছিল। কার সঙ্গে কথা বলেছেন তারা? আমার ভাই যে সন্ত্রাসবাদী তার কী প্রমাণ ছিল তাদের কাছে?’

ঘটনার পরে কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে, তবু ওই পরিবারটি এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে জানা যায়

ফারুক আহমেদ জানান, ৭ মে তার ভাই প্রতিদিনের মতোই সকালে মাদরাসায় যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হন। তবে ফিরে আসে তার প্রাণহীন দেহটা। দুপুরের মধ্যে তারা তাকে বাড়ির কাছেই একটি কবরস্থানে দাফন করেন। পরিবারের সদস্যরা ব্যস্ত ছিলেন ইকবালের জানাযায়, তাই বেশ কিছুটা সময় পর্যন্ত তারা জানতেনই না যে সংবাদমাধ্যমের একাংশে একটা মিথ্যা খবর দেখানো হচ্ছে।

বেশ কয়েক ঘণ্টা পর তাদেরই এক আত্মীয়ের কাছে একটি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ কেউ ফরোয়ার্ড করে। ওই মেসেজটি ছিল একটি নামকরা নিউজ চ্যানেলের একটি ভিডিও ক্লিপ। সেখানেই দাবি করা হয়, ভারতীয় সেনাবাহিনী একজন ‘সন্ত্রাসীকে’ হত্যা করেছে, খবরের সঙ্গে স্ক্রিনে ইকবালের ছবি ভেসে উঠেছিল।

ফারুক বলেন, ‘’আমরা হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তার পরই আরো মানুষ আমাদের ফোন করতে শুরু করে। তারা জানতে চাইছিল যে ঘটনাটা আসলে কী, কেন গণমাধ্যমে ইকবালকে সন্ত্রাসী বলে খবর দেখাচ্ছে!’

পুলিশের বিবৃতি

ইকবালকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে বর্ণনা করে খবর দেখিয়েছিল জি নিউজ, এবিপি, নিউজ ১৮ সহ আরো কয়েকটি চ্যানেল। এ বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে ওই চ্যানেলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বিবিসি। একটি চ্যানেল দাবি করেছিল, ইকবাল পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে ‘সন্ত্রাসী শিবিরের ওপরে ভারতীয় হামলায়’ নিহত হয়েছেন এবং তিনি পাকিস্তানভিত্তিক ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার একজন সন্ত্রাসী’ ছিলেন।

ফারুক বলেন, ‘আমাদের পরিবার কয়েক প্রজন্ম ধরে পুঞ্চে বসবাস করছে। এটা তারা কিভাবে বলল যে আমার ভাই পাকিস্তানে ছিল? তাদের (গণমাধ্যমের) লজ্জিত হওয়া উচিত।’

ইকবালের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো এত ব্যাপকভাবে ও এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল যে ৮ মে পুঞ্চ পুলিশ একটি বিবৃতি প্রকাশ করে স্পষ্ট করে, সীমান্তে পাল্টাপাল্টি গোলাবর্ষণের সময়ে মাদরাসার ভেতরেই মারা গেছেন তিনি। পুলিশ বলেছিল, ‘পুঞ্চ পুলিশ এই ধরনের মিথ্যা তথ্য দৃঢ়ভাবে খারিজ করছে। মৃত মাওলানা মুহম্মদ ইকবাল এলাকার একজন সম্মানিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং কোনো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে তার কোনো যোগ ছিল না।’

তবে এই বিবৃতিটা যখন আসে, ততক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। ফারুক বলেন, ‘তার আগেই তো ভুয়া খবরটা ভারতের লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে।’

তিনি আরো বলেন, নিউজ ১৮ চ্যানেলটি ছাড়া আর কেউই ওই ভুলের জন্য প্রকাশ্যে তার কাছে বা তাদের নিজেদের দর্শকদের কাছে ক্ষমা চায়নি।

আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ভাবনা

ফারুক আহমেদ বলেছিলেন, তিনি চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে চান, তবে তাতে কিছুটা সময় লাগবে, কারণ তার পরিবারকে তো দৈনন্দিন জীবনে টিকে থাকার লড়াইটা লড়তে হচ্ছে এখন।

ইকবালের দুই স্ত্রী ও আট সন্তান রয়েছে। তিনিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য। ফারুক জানান, সরকার যে কয়েক লাখ ভারতীয় রপি ক্ষতিপূরণ দিয়েছে, তা দিয়ে তো মাত্র এক বা দুই বছর চলতে পারে। তাই ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা-ভাবনা এখন থেকেই শুরু করতে হবে তাদের।

ফারুক বলেন, ‘পুরো পরিবার আমার ভাইয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল। সে খুবই শান্ত ও ভদ্র মানুষ ছিলেন, বাচ্চাদের পড়াতে খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু এসব কথা এখন দুনিয়ার মানুষকে কে জানাবে! অনেকের কাছে আমার ভাই তো এখনো একজন সন্ত্রাসী, তাই তাকে মেরে ফেলা সঠিক কাজ হয়েছে। তারা আর আমাদের কষ্ট বুঝবে কী করে?’

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ