শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫ ।। ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ ।। ১০ জিলহজ ১৪৪৬

শিরোনাম :

লোহমানবীকে পতন, ইসরায়েলকে প্রত্যাখ্যান, বিপ্লব বদলে দিচ্ছে বাংলাদেশকে!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| আল জাজিরা এরাবিক থেকে অনুবাদ: মুহাম্মাদ শোয়াইব ||

২১শ শতাব্দীতে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে নাটকীয় রাজনৈতিক মুহূর্তগুলোর একটি প্রায় এক বছর অতিক্রম করতে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে, বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল স্বৈরশাসিত দেশ থেকে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে থাকে, যেখানে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় – এক গণবিপ্লবের ফলস্বরূপ, যা তার প্রেরণা খুঁজে পায় পশ্চিম এশিয়ার এক প্রান্ত থেকে – গাজার অবরুদ্ধ ভূখণ্ডে ঘটে যাওয়া 'তুফান আল-আকসা' অভিযান থেকে।

২০২৪ সালের আগস্টে, রক্তক্ষয়ী দমন-পীড়নের কয়েক সপ্তাহ পরে – যাতে এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয় – শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, যার মাধ্যমে তার দুই দশকের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে।

এরপর দ্রুত শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নির্বাসিত জীবন শেষে তার দেশে প্রত্যাবর্তন কেবল একজন অর্থনীতিবিদের রূপে নয়, বরং একজন নৈতিক এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে হয়। তার প্রথম বক্তৃতা ছিল শান্তস্বরে, কিন্তু এই শান্ত স্বরে ছিল একটি প্রতিশ্রুতি এবং হুঁশিয়ারি—হত্যাকারীদের জবাবদিহি, দমন যন্ত্র ভেঙে ফেলা এবং রাষ্ট্র ও সমাজের সম্পর্ক পুনর্গঠনের ঘোষণা।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, গাজার বোমাবর্ষণের দৃশ্য থেকেই বাংলাদেশের বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে। ২০২৩ সালের শরতে, ৭ অক্টোবর হামলার পর ইসরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজপথে ফিলিস্তিনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বিশাল বিক্ষোভ শুরু হয়।

কিন্তু ‘গাজার সঙ্গে সংহতি’র স্লোগান খুব দ্রুত পরিণত হয় ‘দেশীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে’ হুঙ্কারে। গাজায় নিহত এক শিশুর ছবি যেন ঢাকার রাস্তায় পুলিশের বুটের নিচে চাপা পড়া এক গরিব বাঙালি শিশুর প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। ফলে এই বিক্ষোভ আন্দোলন ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থান থেকে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ সরকারের পতনের দাবিতে।

ছাত্ররা এই আন্দোলনের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেয়। আন্দোলন গ্রীষ্মে তীব্রতর হয়। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা দেশ ছাড়েন, আর ড. ইউনুস ফিরে আসেন এমন এক বাংলাদেশে, যার রাস্তায় তখনো প্রতিবাদকারীদের রক্ত শুকায়নি, আর মর্গগুলোতে স্তূপ হয়ে ছিল এক হাজারের বেশি নিহত ছাত্র ও শিশুদের মৃতদেহ, যাদের শরীরে ছিল পুলিশের গুলির ক্ষত।

যদিও ড. ইউনুসের শাসন শুরু থেকে সংযত, শান্ত কণ্ঠস্বর এবং কোনো অভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক পক্ষকে উস্কে না দেওয়ার কৌশলে পরিচালিত, তবুও বিপ্লব-পরবর্তী কয়েক মাসে বাংলাদেশে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে – অভ্যন্তরীণ নীতিতে যেমন, তেমনি পররাষ্ট্রনীতিতেও।

পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক দৃশ্যপট

প্রথম দিন থেকেই, ড. ইউনূস বাংলাদেশে জনপরিসর পুনরায় খুলে দেন। তিনি হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেন এবং গণমাধ্যমের ওপর থেকে সেন্সরশিপ তুলে নেন। সামগ্রিকভাবে দেশে রাজনৈতিক জীবন নতুন উদ্যমে ফিরে আসে, তবে এই উন্মুক্ত পরিবেশ নতুন ধরনের মেরুকরণও সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশের রাজপথে এমন কিছু রক্ষণশীল ইসলামী শক্তির আবির্ভাব ঘটে, যেগুলো শেখ হাসিনার আমলে নিষিদ্ধ ছিল। এর মধ্যে রয়েছে ‘হেফাজতে ইসলাম’, ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’, ও ‘হিযবুত তাহরীর’। এই সংগঠনগুলো প্রকাশ্যে এসে ইসলামকে আইন, শিক্ষা ও জনজীবনের মূল ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল সমাবেশে এ চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেখানে ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন দল ও সংগঠন ফিলিস্তিনি পতাকা উড়িয়ে গাজার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী সংগঠনগুলো যেমন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, নাগরিক ঐক্য, জামায়াতে ইসলামি, আমার দল, হেফাজতে ইসলাম এবং বিএনপি—তারা কেউই নিজেদের দলীয় পতাকা বা স্লোগান ব্যবহার করেনি। বরং শুধুমাত্র ফিলিস্তিন ও বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের জন্য তীব্র নিন্দা জানানো হয়।

গত কয়েক মাস ধরে রাজপথে চলমান এই ফিলিস্তিনপন্থী প্রবণতা এবং ইসরায়েল ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের আবহে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার পাসপোর্টে পুরনো সেই বাক্যটি পুনঃস্থাপন করে: ‘সব দেশ ভ্রমণের জন্য বৈধ, ইসরায়েল ব্যতীত’—যা আগে শেখ হাসিনার সরকার মুছে দিয়েছিল।

বিক্ষোভের এই জোয়ারে ঢাকার রাজপথে বিশাল জমায়েত করে হেফাজতে ইসলাম, যারা দেশের ধর্মীয় রক্ষণশীল ধারা জোরদারের পক্ষে। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিটি বাতিলের দাবি তোলে, তাদের ভাষায় এ কমিটি ইসলামী শরিয়তের পরিপন্থী এবং কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী চিন্তাধারায় প্রভাবিত।

হেফাজতের পক্ষ থেকে বিকল্প হিসেবে প্রস্তাব করা হয়, একটি নতুন নারী উন্নয়ন কমিটি গঠন করতে হবে যেখানে ইসলামি চিন্তাবিদ ও ধর্মীয় নারীরা থাকবেন। তারা ঘোষণা দেয়, ইসলামই বাংলাদেশের সমাজের মূল উৎস ও পরিচিতি, এবং পশ্চিমা ধাঁচের কোনো সংস্কারকে তারা মেনে নেবে না।

অন্যদিকে, ‘জামায়াতে ইসলামী’ও মে দিবস উপলক্ষে এক বিশাল বিক্ষোভ আয়োজন করে, যেখানে তারা বাংলাদেশি শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার দাবি তোলে এবং শ্রমিক শোষণ বন্ধের আহ্বান জানায়।

এই বিক্ষোভগুলো প্রমাণ করে, দীর্ঘদিনের দমন-পীড়নের পর এখন বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের মত প্রকাশ করতে চায়, এবং তারা চায় একটি নতুন, ইসলামি ও জাতীয়তাবাদী ধাঁচের রাষ্ট্র গড়ে তুলতে—যেটি শ্রমিক ও দরিদ্রদের অধিকার রক্ষা করবে, ভারত থেকে দূরে থাকবে এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবে।

তবে এই প্রবণতা বিদেশে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে, যেমনটি অতীতেও দেখা গেছে। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার মতে, ড. ইউনুস এখন এমন এক অভিযোগের মুখোমুখি—তিনি নাকি দেশে ‘রক্ষণশীল ইসলামি ডানপন্থার উত্থান’ ঠেকাতে যথাযথ পদক্ষেপ নেননি, যেখানে এর আগে শেখ হাসিনা ইসলামি দলগুলিকে নিষিদ্ধ করেছিল এবং ইসলামপন্থী নেতাদের দমন করেছিল।

বর্তমানে ড. ইউনূস ইসলামপন্থীদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন, যাতে তারা তাদের কার্যক্রম চালাতে ও জনভিত্তি গড়ে তুলতে পারে। গার্ডিয়ান দাবি করেছে, এমনকি ইসলামপন্থীদের বিরোধিতার কারণে মেয়েদের ফুটবল ম্যাচ পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে।

অন্যদিকে ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন এক নিবন্ধে ড. ইউনুসের সমালোচনা করে বলেছে—তিনি তথাকথিত ‘ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের’ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছেন এবং তাদের নেতৃত্বে আসতে সুযোগ দিয়েছেন। ম্যাগাজিনটি সন্দেহ প্রকাশ করেছে, ড. ইউনূস কি তাদের দমন করতে পারছেন না, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবেই করছেন না।

তারা দাবি করেছে, কিছু ধর্মীয় কট্টরপন্থী নাকি দেশে আহমদিয়া ও হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করেছে, যা জাতিগত বিভাজন বাড়িয়েছে। নিবন্ধটি সতর্ক করে বলেছে, বাংলাদেশে ‘জনজীবনের ইসলামিকরণ’ হলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক চরমভাবে খারাপ হতে পারে।

পররাষ্ট্রনীতি বদলাচ্ছে

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান ইসলামি জাতীয়তাবাদী চেতনার পাশাপাশি, ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশের পররাষ্ট্রনীতিতেও সতর্কভাবে নতুন করে রূপরেখা আঁকা হচ্ছে। এই নতুন নীতির সবচেয়ে স্পষ্ট দিক হলো—ভারত থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া, যাকে সাধারণ বাংলাদেশিরা নিজেদের দমন-পীড়নের এক বড় সহযোগী হিসেবে দেখেন, বিশেষ করে শেখ হাসিনার শাসনামলে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে। এর বিপরীতে, বাংলাদেশ পাকিস্তানের প্রতি তুলনামূলকভাবে সদয় মনোভাব দেখাতে শুরু করেছে—যে দেশের সঙ্গে ১৯৭১ সালের বিচ্ছেদের পর থেকে সম্পর্ক সবসময়ই টানাপোড়েনপূর্ণ ছিল।

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ১৫ বছর পর প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক আলোচনা করে। পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা হয়, এবং বাংলাদেশিদের পাকিস্তান সফরের বিষয়েও নমনীয়তা দেখানো হয়। দুই দেশের এই রাজনৈতিক উষ্ণতা ব্যবসায়ী মহলেও প্রতিফলিত হয়, ফলে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন চালু হয়।

এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো—ইউনূস সরকার স্পষ্টভাবে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। মার্চ মাসে বেইজিং সফরে ইউনুস চীনের কাছে প্রস্তাব দেন—বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা প্রভাব বিস্তারের কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তর করতে, বিশেষ করে ভারতের খরচে।

ইউনুস খোলাখুলিভাবে বলেন, উত্তর-পূর্ব ভারত পুরোপুরি স্থলবেষ্টিত, এবং এ অঞ্চলের সমুদ্রগমনের পথ বাংলাদেশই নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি চীনকে আহ্বান জানান যেন তারা ওই অঞ্চলে তাদের বিনিয়োগ জোরদার করে। এটা ছিল একপ্রকার জিওপলিটিক্যাল মোসাহেবা, যার মধ্যে ভারতের জন্য একধরনের স্পষ্ট বার্তাও ছিল—বিশেষ করে ২২ কিলোমিটার চওড়া সিলিগুড়ি করিডোর, যা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জীবনরেখা, এবং যা চীন ও মিয়ানমারের সীমান্ত ঘেঁষা রাজ্যগুলোর সঙ্গে ভারতের সংযোগ রক্ষা করে।

চীনও বাংলাদেশ সরকারের এই আহ্বানকে হাতছাড়া করেনি। তারা বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর থেকে সম্পূর্ণ শুল্ক অব্যাহতি দেয় এবং আরও বেশি পণ্য আমদানির প্রতিশ্রুতি দেয়।

ইউনূস এই সফরে ২.১ বিলিয়ন ডলারের চীনা অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি পান, সঙ্গে অবকাঠামো ও সামরিক খাতে সহযোগিতার চুক্তি হয়। এই বিষয়গুলো ভারতের জন্য একপ্রকার কৌশলগত দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে—বাংলাদেশ যদি চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে শত্রুতে পরিণত হয়, তবে তা ভারতের জন্য সিলিগুড়ি করিডোরকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে, যা উত্তর-পূর্ব ভারতকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে।

এটা কল্পনা নয়। ২০১৭ সালের জুনে ভারত চীনা সীমান্তে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছিল ঠিক এই করিডোর ঘিরেই, যেখানে তারা চীনা শ্রমিকদের রাস্তা নির্মাণ থামিয়ে দিয়েছিল—কারণ সিলিগুড়ি করিডোর নিয়ে তাদের দীর্ঘদিনের নিরাপত্তা সংশয় ছিল। এখন ভারতের কাছে স্পষ্ট যে, ইউনুসের বাংলাদেশও এক নতুন কৌশলগত দিকে এগোচ্ছে।

প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায়, ভারত শেখ হাসিনাকে ভারতীয় মাটি থেকে বক্তব্য দেওয়া বন্ধ করেনি, যেটিকে ইউনূস প্রশাসন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নকারী বলে মনে করে। এছাড়া ভারত বাংলাদেশকে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানিতে তাদের বন্দর ও বিমানবন্দর ব্যবহারে যে সুবিধা দিত, তাও প্রত্যাহার করে নেয়। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই পদক্ষেপ শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিকও—কারণ ভারত আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ এখন সিলিগুড়ি করিডোরের কাছে একটি চীনা-সমর্থিত ঘাঁটি নির্মাণ করতে পারে।

এমন প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, ইউনূস সরকার দেশের পররাষ্ট্রনীতি পুনঃনির্দেশনার চেষ্টা করছে, তবে সে চেষ্টা অত্যন্ত হিসেব করে এবং কূটনৈতিক ভাষায়। ইউনুস তাঁর সাক্ষাৎকারগুলোতে কখনোই ‘বড় প্রতিবেশী’ ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করেন না। তিনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ‘উত্তেজনা’ শব্দটি ব্যবহার না করে বলেন—‘উভয় দেশ সবসময় একে অপরের জন্য ভালো কিছু করার চেষ্টা করছে এবং কিছু কিছু বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।’ এর মধ্যে রয়েছে, শেখ হাসিনার ভারতের মাটি ব্যবহার করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টার মতো ইস্যু।

এই নমনীয়তা সত্ত্বেও, ইউনুস ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে থাইল্যান্ডে একটি আঞ্চলিক সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে মোদি বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক, প্রগতিশীল এবং সংখ্যালঘুবান্ধব রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।

দ্য ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিন অনুযায়ী, ইউনূস এখন পর্যন্ত তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপকভাবে সফল। তিনি যেমন চীনের সঙ্গে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সম্পন্ন করেছেন, তেমনি ভারতের সঙ্গেও বাস্তববাদী আলোচনায় লিপ্ত হয়েছেন, এবং পাশাপাশি মার্কিন প্রশাসনের কাছেও সমর্থন আদায় করতে পেরেছেন।

বিভাজন প্রবল... সেনাবাহিনী সক্রিয়

পররাষ্ট্রনীতিতে ইউনুস সরকারের সাফল্য মানেই যে দেশের সবকিছু ঠিকঠাক চলছে—তা নয়। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ বর্তমানে গভীর রাজনৈতিক বিভক্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ ম্যাগাজিন জানায়, দেশে রাজনৈতিক মেরুকরণ আরও তীব্রতর হচ্ছে। বিপ্লবী তরুণরা চান, নির্বাচন হবার আগে সংবিধান, আইন ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় মৌলিক সংস্কার আনা হোক, কারণ তাদের মতে, যদি বিদ্যমান শাসনব্যবস্থা অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদ নতুন মুখোশে ফিরে আসবে। তাদের দৃষ্টিতে, পরিবেশ বদলানোই এখন সবচেয়ে জরুরি, নির্বাচন নয়।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) চাইছে দ্রুত নির্বাচন হোক, কারণ তারা বিশ্বাস করে, তারা এই নির্বাচনে জয়ী হবে। তাদের অভিযোগ—ইউনুস সরকার পরিকল্পিতভাবে নির্বাচন পিছিয়ে দিতে নানা কৌশল অবলম্বন করছে।

এই দ্বন্দ্বপূর্ণ পরিস্থিতি আবারও রাজপথে সংঘর্ষের ঝুঁকি তৈরি করছে, যেমনটি ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ উল্লেখ করেছে। যদিও ইউনূস ঘোষণা দিয়েছেন—২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।

উল্লেখযোগ্য, ‘জুলাই সনদ’ নামে একটি নথি তৈরির কাজ চলছে—যেটি তৈরি করছে একটি জাতীয় কমিটি, যার সদস্যরা দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছে। এই সনদের লক্ষ্য হলো—একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য কাঠামো নির্ধারণ করা, যা নাগরিকদের অধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে, নির্বাচন যারাই জিতুক না কেন।

এই উত্তাল রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কণ্ঠস্বরও অনুপস্থিত নয়। সেনাপ্রধান ওয়াকার জামান সম্প্রতি বলেছেন, দেশ অরাজকতার মধ্যে আছে, এবং এই বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা চলতে থাকলে জাতীয় সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে। ইউনূস এই মন্তব্যে কোনো কঠোর প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে বরং বলেন—তিনি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে কোনো চাপ অনুভব করছেন না, এবং তাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মজবুত।

নিরাপত্তা পরিস্থিতিও অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও ইউনুস সরকার শেখ হাসিনার আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে বহু পুলিশ কর্মকর্তার বিচার করে, এবং গোপন নির্যাতন কেন্দ্রে বন্দি বিরোধীদের মুক্ত করে, যার ফলে নিরাপত্তা পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নত হয়েছে—যেমনটি ‘ফরেন পলিসি’ পত্রিকায় বলা হয়েছে।

এই অগ্রগতির কারণে, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ইউনুস সরকারের প্রশংসা করে, বিশেষ করে গোপন বন্দিশিবির চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকার জন্য। সেনাবাহিনীও এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়, জড়িত কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে এবং সরকার তাৎক্ষণিকভাবে নিন্দা জানায়—যা পূর্ববর্তী সরকারগুলো সাধারণত করত না।

তবে, এই সব সত্ত্বেও সাধারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও উদ্বেগজনক। ইউনুস তা অস্বীকার করলেও, পুলিশ বাহিনী কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহী, ঠিক যেমনটি ২০১১ সালের মিশরীয় বিপ্লবের পর দেখা গিয়েছিল। এই সুযোগে চরমপন্থী গ্যাং ও অপরাধী গোষ্ঠী রাজপথে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এমনকি, ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ বলছে, প্রদর্শনকারীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়—সাবেক সরকারের পতনের পরেও নিরাপত্তা বাহিনী এখনো অনেক ক্ষেত্রে পূর্বের মতো নির্যাতনের ধারা অব্যাহত রেখেছে।

আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো—ইউনূস ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, যদিও বিনার নিউজ বলছে, এখনো বড় জনগোষ্ঠীর কাছে ইউনুসের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল, এমনকি সমালোচনাকারী বিএনপিও তাঁর সরকারের আপেক্ষিক স্থিতিশীলতা ও সফলতা স্বীকার করে। তবে ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ বলছে, এই অভিযোগগুলো—যদিও দুর্নীতি দমন কমিশন গুরুত্ব সহকারে দেখছে—তবু ঘন ঘন এমন খবর সরকারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে এবং এই রূপান্তরপর্বকে জটিল করে তুলছে।

অর্থনীতিতে.. নোবেলজয়ী বিশেষজ্ঞের ভূমিকা কী?

বছরের শুরুতে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছিল, বর্তমান অর্থবছরে (যা জুনে শেষ হবে) বাংলাদেশ ৪.১% অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার অর্জন করবে। কিন্তু সম্প্রতি তাদের পূর্বাভাস হ্রাস করে ৩.৩%-এ নিয়ে আসা হয়েছে, যা গত ৩৬ বছরে দেশের সবচেয়ে ধীর অর্থনৈতিক বৃদ্ধি।

বিশ্বব্যাংকের মতে, এই হ্রাসের কারণ হলো রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিনিয়োগের কমতি, মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি এবং আর্থিক খাতের অস্থিরতা। উল্লেখ্য, প্রত্যেক একটি শতাংশ হ্রাস লক্ষ লক্ষ বাঙালি নাগরিকের কর্মসংস্থান হুমকির মুখে ফেলে।

তবুও, অনেক অর্থনীতিবিদ ইউনূস প্রশাসনকে দোষারোপ করেন না, কারণ তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও পক্ষ থেকে কোটি কোটি ডলারের সহায়তা পেয়েছেন। ‘ব্রাসেলসের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ জানিয়েছে, ইউনুসের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় দেশ ব্যাপক ‘লুটপাটের’ শিকার ছিল। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ খুবই কম, খাদ্যদ্রব্যের মুদ্রাস্ফীতি ছিল প্রায় ১৫%। তবে ‘বিনার নিউজ’ জানিয়েছে, ইউনুস সক্ষম ও যোগ্য মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়ে অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলা করেছেন, যা আরও গভীর হবার আশঙ্কা ছিল।

ভারতের "দি ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস" অনুসারে, ইউনুস সরকার ধ্বংসপ্রাপ্ত আর্থিক খাত পুনর্গঠন করেছে এবং আর্থিক নীতি ব্যবস্থার মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছে। একই সাথে সরকারি ব্যয় সাশ্রয় এবং বিদেশে রাখা অর্থ ফেরানোর জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

তদুপরি, কয়েক বছর পর প্রথমবারের মতো, গত রমজানে বাংলাদেশে খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পায়নি। উল্লেখযোগ্য যে, ইউনুস প্রশাসন ৩৮৫ পৃষ্ঠার একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা দেখিয়েছে শেখ হাসিনার সময়ের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ছিল হেরফের ও বাড়ানো, এবং আগের সরকার যেভাবে অর্থনৈতিক "মিরাকল" দাবি করেছিল তা বাস্তবতা নয়, যেমনটি ব্রিটিশ ম্যাগাজিন "দি ইকোনোমিস্ট" জানিয়েছে।

এছাড়া, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক আশাবাদী, মধ্যমেয়াদে বাংলাদেশ অর্থনীতি ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার করবে, যদি দেশ সঠিক পরিকল্পনা ও বিবেকের সাথে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারে।

দেশের জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক ‘ঢাকা ট্রিবিউন’-কে বাঙালি পলিসি এক্সচেঞ্জ নামের চিন্তাবিদ সংস্থার প্রধান ও বিশিষ্ট ম্যাক্রোইকোনমিক্স বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘অর্থনীতি যদিও ধীরে চলছে, কিন্তু আসলে উন্নতির দিকে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক পূর্বাভাসকে বাংলাদেশের জন্য কোনো আসন্ন আর্থিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত হিসেবে দেখা উচিত নয়।’

এমএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ